ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

বই নয়, কাজের পাঠই গুরুত্বপূর্ণ

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ২৫ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বই নয়, কাজের পাঠই গুরুত্বপূর্ণ

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : দ্বীপের দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরাও পড়তে চায়। বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। অভিভাবকদেরও আশাবাদ কষ্ট হলেও সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন। কিন্তু সুযোগ না থাকায় অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। লেখাপড়া করাতে না পেরে বাবা-মায়েরা তাই শিশুদের আগেভাগেই কাজে পাঠিয়ে দেন। বইয়ের চেয়ে কাজের পাঠই তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন উড়িরচরের শিক্ষাচিত্রটা এমনই। প্রাথমিক বিদ্যালয় আর দ্বীপের একমাত্র নিম্ন  মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিভিন্ন শ্রেণির অভিভাবকদের সঙ্গে আলাপে পাওয়া গেল এমন তথ্য।

দ্বিতীয় শ্রেণির মো. ইলিয়াছ, প্রথম শ্রেণির শারমিন আক্তার, একই শ্রেণির বিবি ময়না, পঞ্চম শ্রেণির মুসলিমা আক্তারসহ আরো  কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো। ওরা পড়ছে উড়িরচরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে আলহাজ্জ মাহফুজুর রহমান মিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। শিশুদের শিক্ষার পথ দেখানোর কথা ভেবে তিন মাস আগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সিডিএসপি প্রোগ্রামের আওতায় একটি ভবন নির্মিত হলেও শিক্ষক, আসবাবপত্র ইত্যাদি সংকট রয়েছে।

বিদ্যালয়ের প্রাধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা মো. সালাহউদ্দিন বলছিলেন, এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে এই এলাকার ছেলে-মেয়েদের ৩-৪ কিলোমিটার দূরে গিয়ে মেঘনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে হতো। ফলে অনেকের পক্ষেই স্কুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আর স্কুলে দিতে না পারায় অভিভাবকেরা শিশুদের পাঠাতেন কাজে।



বিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের একজন এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি রবিউল আলম বলেন, ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হতে না পারলে আমরা পিছিয়েই থাকবো। উড়িরচরের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত এলাকা এটি। এখানে ছিল না কোনো বিদ্যালয়। এই এলাকায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ই প্রয়োজন। কিন্তু তার আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। এর ফলে কিছু ছেলে-মেয়ে অন্তত বিদ্যালয়মুখী হবে।

উড়িরচর ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে এই দ্বীপটি অনেক পিছিয়ে আছে। দ্বীপে পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই; আছে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস শিক্ষার্থীদের এটিই ভরসা। স্কুলের শিক্ষার চেয়ে দ্বীপের বাসিন্দাদের মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহ বেশি। এখানে ২টি এবতেদায়ি মাদ্রাসা, ৪টি হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও ৩৪টি মক্তব রয়েছে। তবে দ্বীপের একমাত্র নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী চোখে পড়ে।

শিক্ষার সমস্যা নিয়ে আলাপ হয় উড়িরচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দ্বীপের ছাত্র-ছাত্রীরা ৪-৫ কিলোমিটার দূর থেকে স্কুলে যায়। এখানে আরো অন্তত ৪-৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেই সঙ্গে দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, শিক্ষক স্বল্পতা, অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা আর অভিভাবকদের অসচেতনতা শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ।    



উড়িরচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকে মাধ্যমিকে উন্নীত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী নিয়ে এ বিদ্যালয়টি চলছে। ১০জন শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফ নিয়ে বিদ্যালয়টি পরিচালিত। ছাত্র-ছাত্রীরা সরকার থেকে শুধু বই পায়। অন্যান্য সব খরচ স্থানীয়ভাবে চালাতে হয়। বিদ্যালয়ের ৫ একর নিজস্ব সম্পত্তি থেকে কিছু আয় আসে, এর সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন মিলিয়ে কোনোমতে বিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে। মাধ্যমিকে উন্নীত হলে এখানকার ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ বাড়বে।

শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, উড়িরচরে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে নানান সমস্যা। অনেকের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। বর্ষাকালে মেয়েদের পক্ষে স্কুলে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো কোনো এলাকার ছেলে-মেয়েরা অতিকষ্টে প্রাথমিদের চৌকাঠ পেরোতে পারলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশুনা সম্ভব হয় না।

উড়িরচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই স্থানীয়। দ্বীপে থেকে তারা কিভাবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলেন-এমন প্রশ্নই করেছিলাম বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. শামীম উদ্দিনের কাছে। তার বাড়ি উড়িরচরের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। বাবা আনোয়ার হোসেন কৃষি কাজ করেন। ২ ভাই ৫ বোনের মধ্যে শামীম ৫ম। বড়ভাই অস্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে বিদেশে চলে যান। বোনদের লেখাপড়া হয়নি মোটেই। শামীম অতিকষ্টে, হাজারো সংকট মোকাবিলা করে দ্বীপের গন্ডি পেরিয়ে সন্দ্বীপ এবং চট্টগ্রামে গিয়ে লেখাপড়া করেন।



শামীম উদ্দিন বলেন, প্রাথমিক থেকেই লেখাপড়ায় সংকট মোকাবিলা করেন তিনি। উড়িরচরের জিইও সৈকত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর সন্দ্বীপে লজিং থেকে পড়াশুনা করেন কাঠগড় হাইস্কুলে। একইভাবে সন্দ্বীপ ডিগ্রি কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর চট্টগ্রামের এমইএস কলেজে ভর্তি হন। এভাবে এই পর্যায়ে আসেন তিনি।

উড়িরচর থেকে লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা মেয়েদের সংখ্যা খুবই কম। দু’একজন যারা কলেজের গন্ডি পেরোতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে একজন উড়িরচর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাহিদা বেগম। স্বামী মো. আবছার কৃষি কাজ করেন। প্রাথমিক শেষ করে লেখাপড়ার জন্য তাকে দ্বীপের বাইরে যেতে হয়েছে। বাবার আর্থিত অনটন ছিল; তার ওপর সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা তো আছেই।

শিক্ষক অভিভাকেরা বলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে এখানে যাতায়াত সমস্যা প্রধান। এলাকাটি সরকারি সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় প্রভাব পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। অভিভাবকদের ইচ্ছা থাকলেও ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করাতে পারেন না। এখানকার নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি মাধ্যমিকে উন্নীত না হওয়া এবং এটি এমপিওভুক্ত না হওয়া শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার আরেকটি কারণ। অভিভাবকদের অসচেতনতাও শিক্ষা ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা। মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেদেরকে স্কুলে পাঠানোর চেয়ে কাজে পাঠানো অভিভাবকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।



উড়িরচর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বলেন, অন্যান্য এলাকা থেকে এই এলাকাটি শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। এখানে আরো  প্রাথমিক বিদ্যালয় দরকার। একইসঙ্গে অন্তত দুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় দরকার। আমরা বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েছি। উপজেলা পরিষদের মিটিংয়েও অনেকবার বলা হয়েছে।   

আরো পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৮/মন্টু/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়