ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের পথে

পালকি চলে উড়িরচরে হুন হুনা

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৫, ৮ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পালকি চলে উড়িরচরে হুন হুনা

রফিকুল ইসলাম মন্টু, সন্দ্বীপের উড়িরচর ঘুরে : একে একে দু’দল বেহারার সঙ্গে দেখা। একদল ভর দুপুরে বরের বাড়ির দিকে ছুটছে, আরেক দল কনের অপেক্ষায়। সারাবছর ডাক না পড়লেও বিয়ের মৌসুমে বেহারাদের ব্যস্ততা বাড়ে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যখন পালকির প্রচলন উঠে যেতে বসেছে, তখন উপকূলের দ্বীপ উড়িরচরে মাত্র কয়েকটি পরিবার এখনও টিকিয়ে রেখেছে পালকির ঐতিহ্য।

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বিচ্ছিন্ন ইউনিয়ন উড়িরচরে শুধু নয়, সন্দ্বীপে এখনও পালকির ঐতিহ্য টিকে আছে। তবে আগের তুলনায় সংখ্যা অনেক কমে গেছে। পালকির সংখ্যা কমে যাওয়ার পাশাপাশি কমেছে বেহারার সংখ্যা। এক সময় পালকির স্থানে ছিল গরুর গাড়ি। সেই স্থান বহু বছর পালকির দখলে ছিল। সে ঐতিহ্যও এখন বিলুপ্তির পথে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে আধুনিক বাহন। অনেক পরিবার পালকির বদলে বর-কনে আনা নেওয়ায় ব্যবহার করেন গাড়ি। এসেছে আরও অনেক পরিবর্তন। ফলে পালকির সেই পুরনো প্রচলন অনেকটাই কমে এসেছে। এক সময় পালকির জাঁকজমক ব্যবহার দেখা গেলেও এখন আর তা খুব বেশি চোখে পড়ে না।

উড়িরচরের পথে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ দেখা দু’জন পালকি বেহারা মানিকচন্দ্র কাহার (৭০) আর কৃষ্ণলাল কাহারের (২৮) সঙ্গে। একটা খালি পালকি নিয়ে তারা যাচ্ছিলেন বরের বাড়ি। দুপুরের খাওয়া শেষে কনে নিয়ে তারা যাবেন কনের বাবার বাড়ি। দ্বীপের এক নাম্বার ওয়ার্ডের আবুল কালামের ছেলে মো. জুয়েল (২৮) বিয়ে করছেন তিন নাম্বার ওয়ার্ডের কৃষক মো. সেলিমের মেয়ে আমেনা বেগমকে (১৮)। এই বিয়েতে অন্যান্য আয়োজনের সঙ্গে রয়েছে পালকি। একটু বাড়তি খরচ হলেও পালকি ব্যবহারে বিয়ে কিছুটা জাঁকজমক হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। এ প্রসঙ্গে বরের বাবা আবুল কালাম বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পালকির ব্যবহার বহু বছরের। বাপ-দাদার বিয়েতে পালকি ছিল, আমাদের বিয়েতেও পালকি ছিল, ছেলের বিয়েতেও তাই পালকি রেখেছি।’
 


বেহারাদের দেখা পেতে শেষ বেলায় আরেক বাড়ির সামনে অপেক্ষা। কনে ফারজানা বেগম (১৮) এসেছেন শ্বশুড়বাড়ি। বৌভাতের পর পালকি করে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে বাবার বাড়ি। অপেক্ষা করছিলেন পরিক্ষিত কাহার (৩৫) ও কৃষ্ণ মাঝি কাহার (৪৮)। বাপ-দাদার পেশার ধারাবাহিকতায় তারা পালকি বহন করছেন। অপেক্ষার পালা শেষে উড়িরচরের কলোনি বাজার লাগোয়া এই বাড়ি থেকে দুই বেহারা পালকি করে কনে নিয়ে যাবেন তারা। যদিও এখানকার বেহারাদের পালকি একেবারেই সাদামাটা। গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়া দু’জন বেহারা কনে নিয়ে চলছেন। একজনের পায়ে নেই জুতো। আশপাশে নেই আর কোনো লোক। আর পালকি ঘিরে দেওয়া হয়েছে চাঁদর দিয়ে। নির্জন পথে হেঁটে চলেছেন তারা। জাঁকজমক সেই আয়োজন থেকে এই পর্যায়ে নেমে এসেছে পালকির ব্যবহার।

কথা হলো কনে ফারজানা বেগমের চাচা নিজামউদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পালকিতে করে কনে নিয়ে যাওয়া একটা পুরনো ঐতিহ্য। আমার বিয়ের সময়ও পালকির ব্যবহার ছিল। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে পালকির ব্যবহার অনেকটাই নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। অনেকে খরচ কমাতে পালকির বদলে অন্যান্য বাহন ব্যবহার করেন। আলাপ হলো এলাকার আরও কয়েকজন বয়সী ব্যক্তির সঙ্গে। এদের একজন এক নাম্বার ওয়ার্ডের মো. একসির আলম, আরেকজন চার নাম্বার ওয়ার্ডের মো. নিজাম। একজন পালকি করে কনে তুলে এনেছেন। আরেকজন এনেছেন গরুর গাড়িতে। তারা জানান, এক সময় এ এলাকায় মালামাল বহনে গরুর গাড়ির ব্যবহার ছিল। সেখান থেকে গরুর গাড়ির ব্যবহার শুরু হয় বর-কনে আনা নেয়ায়। কিন্তু প্রায় এক যুগ আগে থেকে বিয়েতে গরুর গাড়ির ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরে আসে পালকি। এটি এখনও টিকে আছে।

পালকির এই অন্তিম সময়ে বেহারাদের অবস্থা কী? এই প্রশ্নের জবাব জানতে কথা হলো বেহারাদের সঙ্গে। জানা গেল, উড়িরচরে মাত্র ৭টি কাহার পরিবার টিকে আছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কাহার সম্প্রদায়ের পুরুষরা পালকি বহন করেন। এই পরিবারগুলোর মধ্যে বয়সী মানিকচন্দ্র কাহার। ৭০ বছর বয়সেও তিনি পালকি বহন করছেন। মানিকচন্দ্র বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে পালকির ব্যবহার কমে গেছে। যে সব বাড়িতে গাড়ি ঢুকতে পারে, সেসব বাড়িতে বিয়েতে পালকি নেয় না। আগে বিয়ের মৌসুমে আমাদের বিশ্রামের সুযোগ ছিল না। প্রতিদিন কয়েক স্থানে পালকি নিয়ে যেতে হতো। এখন আমাদের হাতে তেমন কোনো কাজই নেই। উড়িরচরে ৭টি পরিবারে মাত্র দু’টি পালকি আছে।’
 


বেহারাদের মজুরি প্রসঙ্গে মানিক বলেন, অবস্থা ভেদে পালকির মজুরি নির্ধারণ করা হয়। প্রতিটি বিয়েতে ৩ থেকে ৭ হাজার টাকা মজুরি পাওয়া যায়। মজুরি বেশি চাইলে অনেকে পালকি নিতে অসম্মতি জানায়। এক সময় বিয়ে মৌসুমে কাহার সম্প্রদায়ের লোকজন পালকি বহন করে অনেক টাকা আয় করতো। এখন আয় হয় নামমাত্র। কথা প্রসঙ্গে আরো জানা গেল, পালকি বাহকদের জীবনেও নেমে এসেছে বিপন্নতা। এই পরিবারের লোকজন দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অনেকে কাঁকড়া ধরে আয় রোজগারের চেষ্টা করছেন। পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বিয়ে মৌসুম এলে কিছু বাড়তি রোজগার হয়। 

‘পালকি চলে হুন হুনা’- পালকি বহনকারী বেহারাদের কণ্ঠে এখন আর নেই এই মধুর ধ্বনি। পালকির ঐতিহ্য কোনো মতে টিকে থাকলেও পালকি নিয়ে হন হন করে ছুটে চলা বেহারাদের মনে সেই আনন্দ ফুরিয়েছে অনেক আগেই। নতুন করে পালকি বানানোর কথা তারা এখন আর ভাবতেও পারেন না। হয়তো অবশিষ্ট দু’টি পালকিই উড়িরচরে পালকি যুগের শেষ চিহ্ন হয়ে থাকবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়