ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফিনিস গেজের দুর্ঘটনা যেভাবে মস্তিষ্ক বিজ্ঞানকে পাল্টে দিয়েছে

মাহমুদুল হাসান আসিফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ২ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিনিস গেজের দুর্ঘটনা যেভাবে মস্তিষ্ক বিজ্ঞানকে পাল্টে দিয়েছে

মাহমুদুল হাসান আসিফ : বর্তমানে আমরা সবাই জানি যে, মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ আমাদের বিভিন্ন রকম আচরণের জন্য দায়ী। কিন্তু ১৮০০ সালের দিকে বিজ্ঞানীদের গবেষণা বলা যায় কেবল মস্তিষ্কের উদ্দেশ্য বোঝায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তা সম্পূর্ণ পাল্টে যায় ১৮৪৮ সালের এক দিনে ফিনিস গেজ নামে এক তরুণ রেলকর্মীর ভয়ানক এক দুর্ঘটনার পর। একটি লোহার রড তার মাথার ভেতর দিয়ে মস্তিষ্ক ভেদ করে চলে যায়। এ ঘটনার পরে মানুষের আচরণে মস্তিষ্কের প্রভাব নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা সারাজীবনের জন্য বদলে যায়।

ফিনিস গেজের দুর্ঘটনা
১৮৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ভারমন্টের রাজ্যের ক্যাভেন্ডিশ শহরে একটি নতুন রেললাইন স্থাপনের কাজ চলছিল। গেজ সেখানে বিস্ফোরকের মাধ্যমে পাথর সরানোর কাজ করছিলেন। কাজটা ছিল সহজ কিন্তু বিপজ্জনক। তার কাজ ছিল পাথরের ভেতর গর্ত খোড়া এবং তাতে বিস্ফোরক দিয়ে তা লোহার রড দিয়ে ঠেসে তার ওপর বালু চাপা দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই কাজে গেজ সামান্য ভুল করে ফেলেন। তিনি বিস্ফোরক দিয়ে গর্ত পূর্ণ করে লোহার রড দিয়ে তা ঠেসে দেন এবং ওই মুহূর্তেই তার সহকর্মীদের দিকে তাকিয়ে মনের ভুলে লোহার রড দিয়ে আরেকটি গুতা দিয়ে ফেলেন। এর ফলে লোহা আর পাথরের ঘর্ষণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয় এবং ভেতরে থাকা বিস্ফোরক প্রবল বেগে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। ফলে ১ মিটার দীর্ঘ, ১.২৫ ইঞ্চি চওড়া এবং ৬ কেজি ওজনের একটি লোহার রড গেজের মাথা ভেদ করে ঢুকে যায়। রডটি তার বাম গালের ভেতর দিয়ে চোখ ভেদ করে মাথার খুলি ছিন্ন করে বের হয়ে যায়।

আশ্চর্যজনক ভাবে, এ দুর্ঘটনায় গেজ শুধু বেঁচেই যাননি, বরং তিনি চেতনা না হারিয়ে সজ্ঞানে নিজ পায়ে হেটে চিকিৎসকের কাছে যান এবং চিকিৎসককে ঠাট্টা করে বলেন যে, ‘আপনার পর্যাপ্ত আয়ের জন্য কিছু নিয়ে এসেছি।’

গেজের এমন ব্যক্তিত্ব তাকে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অনন্য হিসেবে আখ্যায়িত করে ফেলে। ডা. জন মার্টিন হার্লো কয়েকমাস যাবত এক চোখ হারানো গেজের চিকিৎসা করেন এবং পরবর্তীতে তার ব্যক্তিত্ব পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপারগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখেন। ডা. হার্লো গেজের পূর্বপরিচিত মানুষজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, দুর্ঘটনার আগে গেজ ভারসাম্যপূর্ণ মনের বিচক্ষণ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি বেশ কর্মক্ষম ছিলেন এবং তার সকল কাজ গুছিয়ে করতেন। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার পর গেজ একদম পাল্টে যান। তিনি আর সেই গেজ ছিলেন না।

দুর্ঘটনার পর ফিনিস গেজ একজন ছন্নছাড়া মানুষে পরিণত হন এবং ডাক্তার হার্লো তার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের বিষয়গুলো ‘ম্যাসাচুসেটস মেডিকেল সোসাইটি’-কে লিখে পাঠান। ডাক্তার হার্লোর ভাষ্যমতে, ‘গেজ তার পরিচিত মানুষদের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন, কোনো কথা না শুনে যা খুশি তাই করার চেষ্টা করেন, প্রচন্ড খামখেয়ালী এবং অস্থির স্বভাবের হয়ে যান, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভিত্তিহীন নানান চিন্তাভাবনা এবং পরিকল্পনা করা শুরু করেন।’

মস্তিষ্কের একটি আঘাত গেজের ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

নিউরোলজি গ্রাউন্ড জিরো
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ু বা নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ অ্যালেন রোপার বলেন, ‘আপনি যদি হার্ডকোর স্নায়ুবিজ্ঞান এবং মস্তিষ্কের কাঠামোগত আঘাতের সঙ্গে আচরণগত পরিবর্তনের সম্পর্কের বিষয়ে আলোচনায় যান তাহলে সেটা হচ্ছে গ্রাউন্ড জিরো (জীবন শুরু করতে হয় বর্তমান থেকে অর্থাৎ যা আছে তা নিয়ে, এটিই গ্রাউন্ড জিরো)। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, মস্তিষ্কের কোনো অংশে পরিবর্তন ঘটলে আচরণগত পরিবর্তন ঘটা খুবই স্বাভাবিক।’ ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনে মস্তিষ্ক ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য এটি ছিল একটি আদর্শ কেস।

এরপর থেকে স্নায়ুবিজ্ঞানীরা ১৮৪৮ সালে গেজের সঙ্গে ঘটা ঘটনাটি নিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে গবেষণা এবং পুনর্বিবেচনা শুরু করেন। ১৯৪০ এর দশকে একজন স্নায়ুবিশেষজ্ঞ গেজের মাথায় ঢুকে যাওয়া লোহার রডটির সঠিক অবস্থান জানার জন্য তার মাথার খুলির একটি নকশা তৈরি করেন। ১৯৮০-র দশকে একদল বিজ্ঞানী গেজের মাথার খুলির নকশা তৈরিসহ সিটি স্ক্যান করেন। ১৯৯০-র দশকে একদল বিজ্ঞানী গেজের মাথার খুলির সিটি স্ক্যানসহ ত্রিমাত্রিক নমুনা তৈরি করতে সক্ষম হন। ২০১২ সালে তারা গেজের মাথার খুলির সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই করে তার মস্তিষ্কের কোন অংশ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল তার একটা নকশা তৈরি করে ফেলেন।

দুর্ঘটনার পর গেজ ১২ বছর যাবত জীবিত ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার আচরণগত সমস্যা থেকে প্রায় বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ১৫০ বছর আগে সেপ্টেম্বরের একদিনে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক সেই দুর্ঘটনা যেন আজও তার অস্তিত্বকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক খেলোয়াড় আছেন যারা মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ার ফলে আচরণগত সমস্যা, হতাশা এবং বুদ্ধিবৈকল্যে ভুগে থাকেন। তারকারা সাধারণত তাদের ব্যক্তিত্বের জন্যই বিখ্যাত হয়ে থাকেন। গ্যারি ব্যসি এবং ট্রেসি মর্গান নামে দুজন তারকা সড়ক দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়ার ফলে নাটকীয়ভাবে পাল্টে যান। মস্তিষ্কে আঘাত লাগার ঘটনা যে কারো সঙ্গে ঘটতে পারে এবং ফিনিস গেজের ঘটনার মাধ্যমে মস্তিষ্কের আঘাতের প্রভাবটি গভীরভাবে আমাদের জানা হল।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়