ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

নৌকাবাইচ : শ্রমজীবী মানুষের উৎসব

দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নৌকাবাইচ : শ্রমজীবী মানুষের উৎসব

দীপংকর গৌতম : ভূমিকেন্দ্রিক সভ্যতার এই দেশ আবহমান কাল থেকে নদীবিধৌত। সঙ্গত কারণেই বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গের একটি নৌকাবাইচ। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আবার নৌকাবাইচ দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিভিন্নভাবে। এক সময় এ দেশে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল নদী, খাল। বাহন ছিল নৌকা। এখানে নৌ-পথ এবং নৌ-শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব শিল্প-কারখানায় যুগ যুগ ধরে তৈরি হয় দক্ষ ও অভিজ্ঞ কারিগর। তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের নৌযান। এভাবে একসময় বিভিন্ন ধরনের  নৌযানের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়।  অতীতে ফিরে তাকালে আমরা দেখি নৌযান নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে করতে কালের পরিক্রমায় মেসোপটেমিয়ার মানুষদের শুরু করা নৌকাবাইচ আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কারো মতে, মেসোপটেমিয়া থেকেই কিছুটা ভিন্নভাবে হলেও আমাদের এখানে বাইচ শুরু হয়। অনুমান করা যায় যে, বাণিজ্যিক কারণে মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিলো। সেখান থেকে নৌকাবাইচ আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্ত হতেই পারে। যে কোনোভাবেই হোক, শুরু হয় নৌকাবাইচ।

এখনও এ দেশে শিশু-কিশোর থেকে বৃদ্ধ, সবাই বাইচের কথা শুনলে পুলকিত হন। বিপুল আগ্রহ নিয়ে সবাই বাইচ দেখতে যান। প্রমত্তা নদীবক্ষে সঙ্গীতের তাল-লয় নিয়ে বেজে ওঠে টিকারা, কাশি। মাল্লাদের ছন্দময় বৈঠা প্রক্ষেপনের মধ্য দিয়ে মনোহর জলতরঙ্গ তৈরি হয়। নদীর জলের উদ্বেলতা আন্দোলিত হয়ে ওঠায় জলের সাহস বেড়ে ওঠে। তখন জলভারে নদী যেন কুমারী হয়ে ওঠে। বৈঠার ছোঁয়ায় জ্বলে ওঠে তার কৌমার্য। তখন যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা হয় তা অতুলনীয়। আবেগ-উত্তেজনার নৌকাবাইচ হয়ে ওঠে আপামর মানুষের নির্মল আনন্দের সপ্রাণ প্রতিভূ। নদীমাতৃক বাংলাদেশ নদীর তরঙ্গভঙ্গের সঙ্গে এ মাটির মানুষের আশৈশব মিতালি। নদী তাই হয়ে উঠেছে এখানে মানুষের  প্রাণোচ্ছ্বল ক্রীড়াসঙ্গী। এই প্রেক্ষাপটে নদীবক্ষে নৌকা শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, হয়ে উঠেছে জলক্রীড়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নৌকাবাইচ তারই একটি দৃষ্টিনন্দন রোমাঞ্চময় দৃষ্টান্ত।

নৌকাবাইচের দেশীয় প্রেক্ষাপটটাও বিবেচনার বিষয়। সাধারণত ধান কাটার পরে কৃষকরা এ উদ্যোগ নেয়। কৃষকের জমিতে ধান পাকলে ভূমিহীন মজুর ধান কাটে। বর্ষার জলে ডুবে থাকা ধান কেটে ক্লান্ত জীবনের গতি আনতেই কৃষকদের এই আয়োজন। কৃষকরা মজুরদের নিয়ে বাইচের আয়োজন করে। গ্রামীণ কৃষক মজুরদের উপর যে পরিমাণ নির্ভরশীল, সেজন্য তারা তাকে শুধুমাত্র শ্রমের মূল্যে মূল্যায়িত করে না। ধান কাটা শেষে তারা আনন্দ পেতে বিভিন্ন আয়োজন করে। পাইট খেলা, লাঠি খেলা হয়। নৌকাবাইচ এরই অংশ। কৃষকের নৌকায় যে মজুররা যায় তাদের ‘বাইচা’ বলে। বাইচের দিন বাইচাদের খাবার আয়োজন হয় সকাল থেকে। তারা খেয়ে কৃষকের দেয়া এক রঙা পোশাক পরে বাইচে অংশ নেয়। টিকারা ও কাশির তালে চলে নৌকা। বাইচের স্বাভাবিক রীতি এমন ছিলো। কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে সামন্ত জমিদাররা বাইচের সংস্কৃতিতে ঘুণ ধরায়। তারা বাইচাদের হাতে ঢাল সড়কি ধরিয়ে যে কোনো উপায়ে জিততে বলে। এমন কি কোনো জমিদারের নৌকায় অন্য কোনো নৌকার জলের ছিটে লাগলেও শুরু হতো কাইজা। এই যে প্রতিহিংসামূলক প্রতিযোগিতা তা এখনও কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। সামন্তরা বাইচা না পুষে লাঠিয়াল পুষতো। তাদের দিয়ে বাইচ দেয়াতো। যাতে গোলমাল করে হলেও জেতা যায়। সামন্তরা লাঠিয়ালদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে পুষতো। এমকি থাকার জন্য গ্রামও বানিয়ে দিতো তাদের নামে। ঢাকার অদূরে সাভারের কাছে বীরুলিয়া গ্রামটির নামকরণের কারণ লাঠিয়াল বা বীরদের গ্রাম বলে। বীরুলিয়ায় বাবুদের বাইচ দেখার সে জায়গাটি এখনও রয়েছে।

বাইচের সংস্কৃতি বদলেছে। সব কিছুর পর এটাই ঠিক যে, নৌকাবাইচ হলো নদীতে নৌকা বাওয়ার  প্রতিযোগিতা। ‘বাইচ’ শব্দটি ফার্সি বাজি শব্দজাত যার বিবর্তন। এর অর্থ খেলা। তবে এখানে দাঁড় টানার কসরত ও নৌকা চালনার কৌশল দ্বারা বিজয় লাভের লক্ষ্যে আমোদ-প্রমোদমূলক প্রতিযোগিতা বোঝায়। মাঝিদের নিয়ে একেকটি দল গঠিত হয়। এমন অনেকগুলো দলের মধ্যে নৌকা বাওয়ার প্রতিযোগিতাই হলো নৌকাবাইচ।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ আয়োজন, উৎসব ও খেলাধুলা সব কিছুতেই নদী ও নৌকার সরব আনাগোনা। হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংস্করণ বাংলাদেশের নৌকাবাইচের সময় মাঝিরা একত্রে জয়ধ্বনি সহকারে নৌকা ছেড়ে দিয়েই একই লয়ে গান গাইতে শুরু করে এবং সেই গানের তালের ঝোকে ঝোকে বৈঠা টানে। যার ফলে কারও বৈঠা ঠোকাঠুকি না লেগে এক সঙ্গে পানিতে অভিঘাত সৃষ্টি করতে থাকে। গায়েন বা পরিচালক কাঁসরের শব্দে বৈঠার এবং গানের গতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। অন্য সব নৌকাকে পেছনে ফেলে নিজেদের নৌকাকে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টায় প্রয়োজন বোধে কাঁসরের শব্দে বৈঠার গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয় এবং সেই সঙ্গে গানের গতিও বেড়ে চলে। এছাড়া এই সময় দেহ ও মনের উত্তেজনার বশেই গানের মধ্যে ‘হৈ হৈয়া’ ধরণের শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।

কালের বিবর্তনে পাশ্চাত্যের ভাবধারায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সম্মিলনে শহর গড়ে উঠলেও গ্রামবাংলায় নৌকাবাইচের কদর এখনও ব্যাপক। নৌকাবাইচে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই তার  প্রমাণ।

‘ধানের নাচনে মোগো নাচন

হেইয়া বলোরে নাইয়া গাওরে গাজন

মারোরে মারো হেইয়া, জোরছে মারো হেইয়া

পার হইয়া যাও তরী জর কাটিয়া যাও।

হেইয়ারে হেইয়া...’

নৌকাবাইচের সময় মাল্লারা সমবেত কণ্ঠে যে গান গায় তা সারি গান নামে অভিহিত। নৌকার মধ্যে ঢোল, তবলা, টিকারা নিয়ে গায়েনরা থাকেন। তাদের গানগুলো মাঝিদের উৎসাহ আর শক্তি যোগায়। ঢোল ও করতাল, টিকারা, কাঁসরের সাথে সাথে নৌকাবাইচের সময় মাল্লারা তালে তালে এক সুরে গান গেয়ে ছুটে চলে। মাল্লাদের কণ্ঠে যখন দরাজ সুর ভেসে আসে, তখন বিশাল নদীবক্ষ যেন উন্মনা হয়ে ওঠে।

নৌকাবাইচের নৌকা হয় সরু ও লম্বাটে। কারণ, সরু ও লম্বাটে নৌকা নদীর পানি কেটে দ্রুত গতিতে চলতে সক্ষম। নৌকার সামনে সুন্দর করে সাজানো হয় এবং ময়ূরের মুখ, রাজ হাঁসের মুখ বা অন্য পাখির মুখের অবয়ব তৈরি করা হয়। দর্শকদের  দৃষ্টিগোচর করতে নৌকাটিকেও উজ্জ্বল রঙের কারুকাজের মাধ্যমে সাজানো হয়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের নৌকা ব্যবহার করা হয়। সিলেট অঞ্চলে সারেঙ্গী নৌকা ব্যবহার করা হয়। এর আকার কোশা ও ছিপ জাতীয় বাইচ নৌকার মতোই সরু, লম্বায়  প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ ফুট। তবে এর প্রস্থ একটু বেশি ৫ থেকে ৬ ফুট হয়। নৌকা তৈরিতে শাল, শীল কড়ই, চাম্বুল, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া  প্রতিযোগিতায় সাম্পান, গয়না ইত্যাদি নৌকাও ব্যবহৃত হয়। বাইচের নৌকাগুলোকে সোনার তরী, জয়নগর, চিলেকাটা, অগ্রদূত, ঝড়ের পাখি, পঙ্খিরাজ, ময়ূরপঙ্খী, সাইমুন, দ্বীপরাজ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে লোকায়ত বাংলার লোক-সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নৌকাবাইচ কবে গণ-বিনোদনের অংশ হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না।জনশ্রুতি আছে, জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রার সময় পুণ্যার্থীদের নিয়ে বহু নৌকার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তখন মাঝি-মাল্লাদের মধ্যে যাত্রী নেয়ার প্রতিযোগিতা এবং দ্রুত তাদের নামিয়ে আরো পারাপারের তাগিদ বোধ করে। এ থেকে কালক্রমে নৌকাবাইচের শুরু। আবার অন্য একটি জনশ্রুতি হলো, পীরগাজীকে কেন্দ্র করে। আঠারো শতকের শুরুর দিকে কোন এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অন্য পাড়ে থাকা ভক্তদের কাছে আসার আহ্বান করেন। কিন্তু ঘাটে নৌকা ছিল না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। যখনই নৌকাটি মাঝ নদীতে এলো তখনই নদীতে তোলপাড় শুরু হলো। নদী ফুলে-ফেঁপে উঠলো। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসে। সারি সারি অজস্র নৌকা একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়। এ ধারণাটি আজও লোকমুখে প্রচলিত।



কারো মতে, মুসলিম যুগের নবাব-বাদশাহদের সময় আনন্দ-ফুর্তির একটা জোয়ার ছিলো। মুসলিম আমলে নৌকাবাইচ বেশ জনপ্রিয় ছিল। ফলে অনেকের ধারণা, নবাব বাদশাহদের নৌ-বাহিনী থেকেই নৌকাবাইচের গোড়াপত্তন হয়। তবে সব ইতিহাসের শেষে ঐতিহাসিকগণ এটা মনে করেন যে, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম নৌকাবাইচ মেসোপটেমিয়ার লোকেরাই প্রচলন করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২০০০ বছর আগে মেসোপটেমিয়ার লোকেরা ইউফ্রেটিস নদীতে এক ধরণের নৌকাবাইচের আয়োজন করত। এর কয়েক শতাব্দী পর মিসরের নীল নদের জলে নৌকা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরপর ছড়িয়ে পড়তে থাকে এর প্রসার। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত নৌকাবাইচ এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়। ১৯০০ সাল থেকে অলিম্পিক  প্রতিযোগিতায় নৌকাবাইচ অন্তর্ভূক্ত আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সংস্কৃতি এখনও চালু রয়েছে।

তামিলনাড়ুর ওনামই বাইচের সমরূপ। বাংলায় যে সময় আড়ং, আড়ম বা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় ঠিক একই সময় তামিলনাড়ুর সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চল বিশেষত কেরালায় অনুষ্ঠিত হয় ওনাম উৎসব। ওনামের নৌকার গঠনও ভিন্ন। এটা হয়তো ভূপ্রাকৃতিক কারণে। ভাষা-সংস্কৃতির কারণে এদের বিশ্বাসও ভিন্ন। ওনাম সম্ভবত প্রাচীন অসুর শব্দ আড়মের সংস্কৃতিকরণ। এই ওনাম উৎসবে বাইচের মতোই অনুষ্ঠিত হয় বাল্লাম কেলি। যা মালাবার উপকূলের সর্বাধিক প্রচলিত আনন্দদায়ক খেলা।

ওনামের সঙ্গে বাংলাদেশের বাইচের কোনো পার্থক্য নেই। ওনাম একটি কৃষি উৎসব। ফসল ঘরে তোলার পর উপকূলের মানুষ আত্মীয়-স্বজনের সাথে নিরলস আনন্দে মেতে ওঠে। চারদিন ধরে চলে নাচ, গান ও ভোজন। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ হলো বাল্লাম কেলি। রং-বেরঙের শতাধিক নৌকা নিয়ে আন্নামালাই, কোট্টিয়াম ও কোবালাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষ মেতে ওঠে নৌকাবাইচে। কাড়া, নাকাড়া ও করতালের দ্রুত ছন্দে চলে বৈঠার টান। নৌকাবাইচের গানের মতোই বাল্লাম কেলির গানে থাকে একই ছন্দ, একই আবেগ ও একই দ্যোতনা।        

ফলে আড়ম-ওনাম, বাল্লাম কেলি ও বাইচ যে সম সংস্কৃতিসম্পন্ন জনপুঞ্জের লোকায়ত বিদ্যা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে নৌকাবাইচের আয়োজন চলছে। এই আয়োজন অব্যাহত থাকলে নৌপথের খেলা দীর্ঘদিনের হারানো ঐতিহ্য নৌকাবাইচ পুরোপুরি স্বরূপে ফিরে না এলেও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। এই খেলাকে সারাদেশে আগের অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পথ আমরাই নষ্ট করে ফেলেছি। বিভিন্নভাবে নদী দখল ও কল কারখানার বর্জ্যের মাধ্যমে নদী আজ মৃতপ্রায়। নষ্ট করে ফেলেছি নদীর পানি। নদী তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছে। ফলে এমনিতেই হারিয়ে যাচ্ছে নৌকাবাইচ। দক্ষিণাঞ্চলের বাইচের দুটি বড় এলাকা কোটালীপাড়ার বাঘিয়া ও কালিঞ্জিরি (কালিগঞ্জ)। দুটি বাইচই ছিলো বিলবাসী মানুষের বিনোদন। বিলের পাড় দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে সড়ক নির্মাণ করায় বিলে জলের বহতা কমে যায়। ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসে বিল। ফলে বাইচ দেয়া এখানে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এরপর বাইচ চলে আসে খালে। এই খালে জলের বহতার মূল উৎস ছিলো আঁড়িয়াল খাঁ ও মধুমতি নদী। দুটোর অবস্থাই শোচনীয়। খালের মতো হয়ে গেছে নদী। জলের বহতা নেই। তবু বাইচের দিন যেন শেষ হয় না। বাইচকেন্দ্রিক মেলা বাইচের অন্যতম আকর্ষণ। অন্তত শিশু-কিশোরদের কাছে। প্রতিবছর বাইচের কাছাকাছি সময় এলে ছেলেমেয়েরা এখনও টাকা জমিয়ে বাইচের দিন খরচ করার অপেক্ষার প্রহর গোনে। 

এছাড়াও বাইচে ব্যবহৃত সব গানে প্রাণবন্ত ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সুর থাকে। থাকে লোকজ শব্দের অসাধারণ ব্যবহার। বাইচের প্রচলন কমে আসায় সেসব প্রাণবন্ত শব্দ, সুরের ব্যবহার এখন আর তেমন একটা শোনা যায় না। আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য নৌকাবাইচ নানা প্রতিকুলতার পথ পাড়ি দিয়ে আজ ক্লান্ত। হারিয়ে যেতে বসেছে মেহনতী মানুষের বিনোদনের অন্যতম এই নৌকাবাইচ। ফলে শুধু নৌকাবাইচ নয়, হারিয়ে যেতে বসেছে ভাটি বঙ্গের সারি গান। যদিও এখনো দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঝে-মধ্যে  নৌকাবাইচ হয়। কিন্তু আগের মতো সেই আনন্দ-উদ্দীপনা আর আবেদন নেই। তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। পড়ারই কথা, কারণ সংস্কৃতি এমন একটা বিষয়, যা শুধু একার নয়। এর সঙ্গে আরো বহু কিছু যুক্ত। পুঁজির অস্থির উত্থান-পতন, শ্রমজীবী মানুষের পেশা বদল, নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের এ-পাশ বাঁচে তো ও-পাশ বাঁচে না। এমন অবস্থায় ঐতিহ্য-সংস্কৃতির টিকে থাকাই কষ্ট। এ অচলায়তনের পরিবর্তন জরুরি। যেসব মানুষ এগিয়ে এলে এসব সমস্যা কাটিয়ে, বাইচের নৌকা জল কেটে চলে যাবে সবার আগে তারা কি এগিয়ে আসবেন না? আমরা কি শুনবো না সেই গান-

ভগমানের আশীর্বাদে, হেইয়া হো

তোমার আমার মধ্যে যত কালিমারই পোচ

মুচতে বলে মাগো কালি মোচ মোচ মোচ।

হেইয়া গেল- হরিব্বোলো, হেইয়া গেলো রে হে

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট ও মাঠকর্ম



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়