ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মাকে কখনো বলা হয়নি ‘ভালোবাসি’

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাকে কখনো বলা হয়নি ‘ভালোবাসি’

|| আমিনুল ইসলাম ||

মা নিরক্ষর হতে পারেন। পার্থিব জগতের হাব-ভাব কম বুঝতে পারেন। কিন্তু টাকা চেনেন না- এমন মা কয়জন আছেন এই যুগে? পাগলও তো টাকা চেনে! দুইটা টাকা দেন বলে হাত পাতে। আমার মায়ের কাছে একশ টাকার নোট যেমন, পাঁচশ টাকার নোটও তেমন। বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ফিরে আসার সময় তার হাতে প্রত্যেকবারই কিছু না কিছু টাকা দিয়ে আসতাম। টাকা দিয়ে তাকে বলতাম, ‘বলো তো কত টাকা দিয়েছি তোমাকে?’

মা বলত, ‘এহনকার লোট আমি চিনি না।’ আর বয়স? বয়সের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘জাগির (আমাদের বড় ভাই) যহন হইলো, তহন মোর বয়স আছিল ১৭/১৮।’ সে হিসেবে তার বর্তমান বয়স ৬৫/৬৬। এই সহজ-সরল নির্ভেজাল নিরক্ষর মানুষটি আমার মা। আর আমি তার নাড়িছেঁড়া ধন, সর্বশেষ সন্তান।

শেষ সন্তান হওয়ার কারণে আমার সঙ্গে তার আত্মিক সম্পর্কটা অনেক গভীর। আমার প্রতি তার টানটাও অন্যদের চেয়ে বেশি। তার আদর, ভালোবাসা এমনকি বুকের দুধ পর্যন্ত আমার অন্য চার ভাই-বোনের চেয়ে আমিই সবচেয়ে বেশি ভোগ করেছি। আমার ইমিডিয়েট বড় বোনের জন্মের ৩ বছরের মাথায় আমার জন্ম। সেই থেকে শুরু করে প্রায় চার বছর বয়স পর্যন্ত আমাকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। গ্রামের হুজুর, আমার নানি, পাড়া প্রতিবেশীদের নানারকম কথা শুনে মা দুধ ছাড়ানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। নিম পাতা, করলার পাতা থেকে শুরু করে তেতো এমন কিছু নাই যা দিয়ে তিনি দুধ খাওয়া বন্ধ করতে চেষ্টা করেননি। কিন্তু পারেননি। দুধ খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সবগুলো দাঁত নাকি আমার পোকায় খেয়ে ফেলেছিল। শুধু দাঁতের কালচে গোড়াগুলি অবশিষ্ট ছিল। আমার ভাই-বোনরা বলে, আমি মায়ের দুধ সবার চেয়ে বেশি খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি বলেই নাকি পড়াশোনায় ভালো করেছি। মেধাবী হয়েছি।

আমি মায়ের খুব ন্যাওটা ছিলাম। কোনোভাবেই তার আঁচল হাতছাড়া করতাম না। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে যখন তিনি নানা বাড়ি চলে যেতেন তখন আমরা পিঠাপিঠি ভাইবোনরা তার পিছু নিতাম। মা প্রথমে সবাইকে এলোপাথারি চড়-থাপ্পর মেরে ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। শেষমেষ আমাকে কোলে নিয়ে বাকিদের ফাঁকি দিয়ে নানা বাড়ি চলে যেতেন। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার আগ পর্যন্ত মাকে ছাড়া ঘুমাতেই পারতাম না। বেদম প্রহার করেও তার পিছু ছাড়াতে পারতেন না।

আমার সঙ্গে তিন বছরের বড় বোনের সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকত। খেতে বসলে কাড়াকাড়ি। শেষ পর্যন্ত মায়ের পাতের মাছ কিংবা মাংস দিয়ে আমাকে ঠান্ডা করা হতো। কিছু কিনতে গেলে ধস্তাধস্তি। মায়ের সুনজর আমার দিকেই থাকত। গোসল করতে গেলে দুজনের মধ্যে বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেত। এসব মারামারি কাড়াকাড়ির মীমাংসা হতো মায়ের কঠিন হস্তক্ষেপে। আমাদের দুজনের পিঠের উপর চলত ঘর-গৃহস্থালির কাজ করতে করতে শক্ত হয়ে যাওয়া মায়ের হাত। এক্ষেত্রে সব সময়ই আমার পিঠে ছোট কিলটা পড়ত। আর আপুর পিঠে বড়টা। কখনো কখনো বেদম মার খেতেন আপু।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়েছিল। বছরখানেক অতিবাহিত হওয়ার পর যখন মা বুঝলেন, উড়নচন্ডী এই আমাকে দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা হবে না, তখন ব্র্যাক প্রাক-প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখান গান শেখানো হতো, অভিনয় শেখানো হতো, ছড়া, গল্প বলা, আবৃত্তি, নাচ, চিত্রাঙ্কন শেখানো হতো। সুর করে সবাই সমস্বরে পড়তাম। সেই পড়াশোনা যে কী ভালো লেগে গেল আমার। একদমে সাফল্যের সঙ্গে পঞ্চম শ্রেণি পাস করলাম। কিন্তু এরপরই দেখা দিল বিপত্তি। আমি খুব দুরন্ত হওয়ায় বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে আর পড়াবেন না। আর যদি পড়ানই তাহলে আমাকে মাদরাসায় পড়তে হবে। আমার যে হাইস্কুলে যাওয়ার ভীষণ ইচ্ছা। আমার সহপাঠীদের অধিকাংশই হাইস্কুলে যেতে শুরু করেছে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে। প্রতিদিন তাদের দেখি আর দীর্ঘঃশ্বাস ফেলি।

মাকে ইচ্ছার কথাটা জানালাম। তিনি জানতে চাইলেন, ভর্তি হতে কত টাকা লাগবে? আমি বললাম, ভর্তি ফরমের মূল্য ৫০ টাকা। ফরম কিনে ভর্তি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত ক্লাস করা যাবে। দুদিনের মাথায় কার কাছ থেকে যেন ৫০ টাকা ধার করে মা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই নে টাহা। তুই হাইস্কুলেই যা। তোর আব্বায় যাতে টের না পায়। ভালো করতে পারলে পরে আমিই তারে কমু।’ এরপর আমি গিয়ে ফরম কিনে নিয়ে আসলাম। চুপি চুপি স্কুলে যেতে লাগলাম। ভর্তি পরীক্ষাও দিলাম। ভার্ত পরীক্ষায় ১০০ মার্কসের মধ্যে ৯৭ পেয়ে একেবারে ফার্স্ট হয়ে গেলাম। এই খবর মুহূর্তের মধ্যেই এলাকায় জানাজানি হয়ে গেল। কারণ, আমাদের ভবানীপুর গ্রাম থেকে সেবারই প্রথম কেউ যে মিয়ারহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট হয়েছে। মা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। যে বাবা আমাকে পড়াতেই চাননি, তিনি অবশেষে আমাকে চেয়ার-টেবিল কিনে দিলেন। সেই চেয়ার-টেবিল তিনি প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের কুন্ডুবাড়ির মেলা থেকে মাথায় করে এনেছিলেন। আমি ছিলাম তার সাথে।

এরপর আর আমাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পড়াশোনা, স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, স্পোর্টস ডে’তে অংশগ্রহণ করে একের পর এক পুরস্কার পেতে লাগলাম। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় প্রতি বছরই স্কুল কমিটির পক্ষ থেকে পুরস্কার পেয়েছি। কখনো ছাতা, কখনো ডিকশনারি কখনো দেয়াল ঘড়ি। সেই দেয়াল ঘড়ির মধ্যে আমার ছবি লাগানো ছিল। ২০০৬ সালে সর্বপ্রথম আমি আমার মায়ের আঁচল ছেড়ে দূরে যাই। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাবার জোরাজুরিতে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই। যেদিন আমি চট্টগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়েছিলাম, সেদিন ভীষণ কেঁদেছিল মা। তাকে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখিনি আমি। তার নাড়িছেঁড়া ধন যে দূরে চলে যাচ্ছে। চট্টগ্রামে যাওয়ার পর প্রতিদিন নাকি মা ঘড়ি দেখতেন আর কাঁদতেন। কারণ, সেই ঘড়ির মধ্যে যে আমার ছবি লাগানো ছিল। এ কথা শুনে ঈদের সময় বাড়ি এসে আমি ঘড়ির মধ্য থেকে আমার ছবিটা সরিয়ে ফেলি। চট্টগ্রাম থেকে সপ্তাহে অন্তত একবার হলেও মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম। যখন বলতাম রাখি, তখনই টের পেতাম মায়ের গলাটা ভারী। কথা বলার গতি কমে যেত। আর কিছু বলতে পারতেন না। চট্টগ্রাম থেকে যখন বাড়ি ফিরতাম, তখনও মা জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। আবার যখন চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য বের হতাম, তখনও মা কাঁদতেন। বিদায় বেলায় গালে-কপালে চুমো খেতেন। তার পান খাওয়া ঠোঁটের চুমোতে দাগ লেগে যেত আমার গালে, কপালে। তা আমি নিজ থেকে কখনো মুছতাম না। এখনো মুছি না। এ চুম্বন আমার কাছে অমূল্য। অনন্য এক প্রাপ্তি। মায়ের ঘ্রাণটাও যে আমি টের পাই।

আমি কখনোই মাকে বলিনি, ‘ভালোবাসি’। তাকে ভালোবাসতে কোনো বিশেষ দিবসের প্রয়োজন বোধ করিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আমার মনে হচ্ছে, এত শত দিবসের ভিড়ে মায়ের জন্য একটা দিবস থাকলে দোষ কী তাতে? থাকুক না এই যান্ত্রিকতার দিনে মাকে ‘ভালোবাসি’ বলার একটি বিশেষ দিন। এই মা দিবসে আমি আমার মাকে বলতে চাই, ‘মা, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। ভীষণ। আমি তোমার মতো একজন মা পেয়েছি বলেই এতোদূর আসতে পেরেছি। আমি আরো একবার তোমার কোলে জন্মাতে চাই। আরো এক জনম চাই তোমাকে ভালোবাসতে। তোমার ঋণ যে শোধ হবার নয়।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/আমিনুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়