ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সন্তানের জন্য রিকশা চালান এই নারী

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০১, ১৩ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সন্তানের জন্য রিকশা চালান এই নারী

শাহেদ হোসেন : রাজধানীর বাংলাবাজার এলাকায় দাঁড়িয়ে মতিঝিল যাওয়ার জন্য রিকশা দরদাম চলছিল। এরই মধ্যে হুট করে এক রিকশাওয়ালা সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো ‘স্যার চলেন, আমি মতিঝিলের দিকেই যামু।’

রিকশায় উঠতে উঠতেই খেয়াল হলো- কেবল চোখ ছাড়া চালকের আপাদমস্তক ঢাকা। গায়ে লম্বা শার্ট, পরণে প্যান্ট-হাত মোজা-পা মোজা, স্যান্ডেল আর মাথায় ক্যাপ। বৈশাখের এই দুপুরে কেউ আপাদমস্তক এভাবে ঢেকে রিকশা চালাতে পারে, তা দেখে রীতিমতো ভিড়মি খাওয়ার দশা!

রিকশায় ওঠার সময় চালকের কণ্ঠটা অনেকটা মেয়েলি মেয়েলি বলে কানে লেগেছিল। তাড়াহুড়ায় তখন সেটা খেয়াল করিনি। এখন তার এই পোশাক দেখে সন্দেহ হলো, ইনি হয়তো নারী।

খানিকটা কৌতুহলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করি?

প্রশ্নের ধরণ আন্দাজ করতে পেরে স্পষ্ট গলায় চালক বললেন, কী জানতে চাইবেন? আমি মহিলা না পুরুষ?

-জ্বি।

 

-আমি মহিলাই। লোকজন ঝামেলা করে। প্যাটের দায়ে রিকশা চালাইতে হয়, তাই সব ঢাইক্কা-ঢুইক্কা লই।

 

-নামটা কী বলা যাবে?

-নাম দিয়া কী করবেন হুজুর? নাম দিয়া কাম নাই।

-কতদিন ধরে এভাবে রিকশা চালাইতেছেন?

-১৪ বছর। গত দুই বছর ধইরা এই মোটরের রিকশা চালাই। আগে প্যাডেলেরটা চালাইতাম।

-১৪ বছর! আপনার স্বামী মারা গেছে কবে?

-মরে নাই, আমিই ছাইরা আইছি, তাও ১৬ বছর।

রিকশাচালকদের সঙ্গে যাত্রীরা আন্তরিকভাবে কথা বললে তারা বেশ সহজবোধ করেন। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনেকে সহজ-সাবলিলভাবেই তাদের পরিবারের কথাও যাত্রীকে বলেন। রাজধানীতে ১৪ বছর ধরে রিকশা চালানো এই বিস্ময়কর নারীকে বেশ শ্রদ্ধার সুরেই প্রশ্ন করছিলাম, তিনি হয়তো বুঝতে পারছিলেন। তাই সহজভাবেই তিনি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন।

-স্বামীকে ছাড়লেন কেন?

-আমার বিয়া হইছিল বরিশাল…

মাঝে বাঁধা দিয়ে জানতে চাইলাম, আপনার বাড়ি কোথায়?

-আমার বাড়িও বরিশাল। বিয়ার কয়েক বছর পর স্বামীর বাড়ি নদীতে ভাইঙ্গা নিয়া যায়। পরে বড় মাইয়ারে নিয়া স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় মোহাম্মদপুরে আইসা উঠি। স্বামী রিকশা চালাইতো। বস্তির অন্য রিকশাওয়ালাগো খপ্পরে পইরা হ্যায় জুয়া আর গাঞ্জার (গাঁজা) নেশা ধরে। ঘরে ঠিকমতো খাওন-দাওন দিত না। ঠ্যাকায় পইড়া বাসা-বাড়িতে কাম লইছিলাম। হ্যার (স্বামীর) টেকায় টান পড়লে ধইরা মারত। আমারে মারত, গায়ে লাগতে না। কিন্তু আমার বড় মাইয়াডার গায়েও জানোয়ারটা হাত তুলত। ওই সময় আমার ছোট মাইয়ার বয়স মাত্র এক বছর। একদিন টেকার লাইগা ওই পিচ্চি মাইয়াডারা মাথার ওপর তুলছিল আছাড় দেওয়ার লাইগা। কোনোমতে পায়ে ধইরা মাইয়াডারে বাঁচাইছিাঁম। পরের দিন দুই মাইয়ারে লইয়া ওই বস্তি ছাইড়া আয়া পড়ছি।

-এরপর কী করলেন?

-মোহাম্মদপুরে যেই বাসায় কাজ করতাম, ওই বাসার সিঁড়ির নিচে কয়দিন আছিলাম। ছোট মাইয়াডা রাইতে কান্দাকাটি করত। ওই বাড়ির লোকজন পরে মানা কইরা দিলে মুগদার মান্ডায় চইলা আসি।

-রিকশা চালানো শুরু করলেন কবে থেকে?

-মান্ডায় এক রিকশার গ্যারেজে ভাত রান্ধার কাম করতাম। ওই সময় রিকশা চালান হিগি (শিখি)। বড় মাইয়ার বয়স তহন সাত বছর। আমি যে কষ্ট করছি মাইয়াগো যেন সেই কষ্ট সইতে না হয়, সেজন্য বেশি রোজগারের চেষ্টা করতে থাকি। গ্যারেজ মালিকের হাতে-পায়ে ধইরা তহন আধাবেলা কইরা রিকশা চালাইতে শুরু করি।

-মেয়েদের দেখত কে?

-বড় মাইয়ারে হেই সময় একটা স্কুলে ভর্তি করায়া দিছিলাম। আর ছোটটার বয়স তহন তিন বছর। বড় মাইয়া স্কুল থাইকা আইলে ওর কাছে ছোটটারে রাইখা বিকালে রিকশা লয়া বাইর হইতাম। মাইয়া মানুষ রিকশা চালাইলে কেউ উঠব না। তাই তহন থেইক্কাই এইভাবে পুরুষের বেশ ধইরা সব ঢাইক্কা গাড়ি চালাইতাম। আর যাত্রীগো লগে খালি ভাড়া ছাড়া আর কোনো কথা কইতাম না।

-মেয়েদের এখন কী অবস্থা?

-এই রিকশা চালানের পয়সা দিয়া বড়টারে মেট্টিক দেওয়াইছি, সেলাইর কাজ শিখাইছি। পাঁচ বছর আগে গার্মেন্টেসের এক পোলার লগে বিয়া দিছি, থাকে গাজীপুর। ছোটোটা মেট্টিক দিব।

-এখনো রিকশা চালান, মেয়েরা কিছু বলে না?

-বড়টা ছাইড়া দিয়া ওর লগে থাকবার কয়। কিন্তু আমি জামাইর সংসারে থাকুম ক্যা? দেশে চরে কিছু জায়গা কিনছি থাকনের লেইগা। ছোটোটার এহনো বিয়া দেই নাই। অর বিয়া-শাদির খরচের ব্যাপার আছে। হেই ট্যাকা কইত্তে আইব? আমার এইডাই তো শেষ মাইয়া। অর আব্দারটাও বেশি। অর লাইগাই এহনো রিকশা চালাই। অর বিয়াটা হয়া গেলে সব ছাইড়া দিয়া গেরামে যামুগা।

কথার ফাঁকে যানজট পেরিয়ে রিকশা কখন মতিঝিল চলে এসেছে টেরও পাইনি। নামার সময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তার ছবি তুলতে চাইলাম। তবে আপত্তি জানালেন মহিয়সী এই জননী। তার ভাষ্য, ‘ছবি তুইলা কোনো লাভ নাই। আমি মহিলা মানুষ রিকশা চালাই, গেরামের বাড়ির কেউ জানে না, জানাইতেও চাই না।’

শ্রদ্ধার স্থান থেকে ভাড়ার টাকার অংকটা বাড়িয়ে দিতে চাইলে অবাক করে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘আমার মাইয়াডারে যাতে ভালো জায়গায় বিয়া দিতে পারি, ইট্টু দোয়া কইরেন হুজুর।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ মে ২০১৮/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়