ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

স্মরণ : কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৯ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্মরণ : কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

শাহ মতিন টিপু : কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে বলা হয় গণমানুষের যাপিত জীবনের কুশলী রূপকার। তার লেখাই তাকে শক্তিশালী ও স্মরণীয় করে রেখেছে। তার সময়ের সাহিত্যাকাশের অনেক তারার সমারোহেও তিনি আলোকিত হয়ে উঠেছিলেন।

এই অমর কথাশিল্পীর ১১০তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বিহারের সাওতাল পরগনা, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে৷ তার নাম প্রবোধকুমার হলেও ডাকনাম মানিক নামেই লিখে গেছেন।

চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। তার পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার চাকরির সূত্রে তার শৈশব ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তাঁ মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল সে সময়ের পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ এই বাংলাদেশেই। প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় তিনি তার মায়ের গ্রাম গাউদিয়া’র পটভূমি রচনা করেছেন  ।

বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্তকুমার, বিষ্ণু দে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান কথাসাহিত্যিকও ছিলেন তার সমকালীন লেখক। এদের ভিড়ে মাত্র ৪৮ বছরের অল্প আয়ুষ্কালে ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে নিজের নামটি স্মরণীয় করে রেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অল্প সময়ে তিনি বাঙালিকে যা দিয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান দরকার করে না। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

বলা হয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রোত্তরকালে তার বলয় ছাড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বিষয় বৈচিত্র্য, লড়াই ও এগিয়ে চলবার মন্ত্রণাকে সবচেয়ে সফলভবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।

চল্লিশের দশকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে’ যুক্ত হওয়া আপাদমস্তক কমিউনিজমে বিশ্বাসী সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কলেজে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’ লিখে ফেলেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। এরপর ‘বঙ্গশ্রী’ সাহিত্য পত্রিকায় ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাসটির ধারাবাহিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে তার যাত্রা শুরু। পরের বছর ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। ১৯৩৫ সালে ‘জননী’, ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার গ্রন্থকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। এভাবে কেবল লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়ে সামান্য উপার্জনের মাধ্যমে সংসারের হাল ধরার আশায় একে একে লিখে গেছেন ৪০টি উপন্যাস, ৩০০টিরও অধিক ছোটগল্প আর বিপুল প্রবন্ধ।

তবে সাব-ডেপুটি কালেক্টর পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র হয়েও জীবনবাদী লেখক প্রবোধকুমার তথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিজীবনে অভাব মেটেনি কোনোদিন। ক্ষুরধার লেখক মানিককে একসময় লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শেষাবধি মৃত্যুবরণ করতে হয় শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে।

বাংলা উপন্যাসের সূচনালগ্নে প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনকি সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসেও নিম্নবর্গের যথোচিত উন্মোচন দেখা যায়। সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমসাময়িক তুখোড় লেখকদের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজের চিন্তা ও কল্পনার গভীরতা প্রকাশ করে বিশিষ্ট হতে পেরেছেন।

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ১২টি বই প্রকাশিত হলেও একটিও তিনি পাঠাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যের জন্য। জীবনানন্দ দাশও রবীন্দ্রনাথকে কবিতাগ্রন্থ পাঠিয়ে তার মতামতের জন্য কাতর অনুরোধ করেছেন; এমনকি রবীন্দ্রদ্রোহী বুদ্ধদেব বসুও রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠিয়েছেন মতামতের জন্য। সে সময় ঠোঁট-কাটা বলে পরিচিত সমর সেনও রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমার কবিতার বইয়ের এক কপি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে বাধিত হবো।’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত কবিগুরুর সুপারিশ যেচেছেন। সেখানে ব্যতিক্রম কেবল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। ফলে তিনি জীবনের দিকটি দেখতেন তার সমগ্রতায়, খণ্ড খণ্ড করে নয়, অখণ্ডতায়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়