ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উপকূলের পথে

জয়ী ময়না, পরাজিত চন্দনী-পারভিন!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ২৬ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জয়ী ময়না, পরাজিত চন্দনী-পারভিন!

ময়না বেগম

রফিকুল ইসলাম মন্টু: সাহসী ময়না, তিনি জয়ী। এখন আর সন্তানদের নিয়ে এখানে-ওখানে কাজ করতে হয় না। দৈনন্দিন খরচাপাতি আদায় করেছেন স্বামীর কাছ থেকে। সপ্তাহে দু’দিন সোম ও মঙ্গলবার কাছে পাচ্ছেন স্বামীকেও। তবে এ বিজয় অতি সহজে আসেনি। গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে ধর্না দিতে হয়েছে বহুবার। তাতে কাজ হয়নি; কিন্তু দিন গড়িয়েছে। সালিশ বিরক্ত। শেষ অবধি পুলিশের কাছে যান ময়না। আবেদন করেন স্বামী হারুন বেপারীর বিরুদ্ধে। তবে ময়না পারলেও, পারেননি চন্দনী কিংবা পারভিন বেগম। বিনা নোটিশে সন্তানসহ স্বামী ফেলে যায় তাদের।

এ গল্প পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের নারী সমাজের খণ্ডিত চিত্র মাত্র। আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই। কিংবা আইনের কাছে যাওয়াটাও যেন তাদের কাছে কষ্টসাধ্য। শুধু চরমোন্তাজ নয়, উপকূলের পথে-প্রান্তরে ঘুরে এমন হাজারো গল্পের মুখোমুখি হই। একজনের একাধিক বিয়ে করা; আবার বিনা নোটিশেই স্ত্রীকে ফেলে চলে যাওয়ার ঘটনা অহরহ। দ্বিতীয় বিয়ে করলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়া কিংবা সংসারে বনিবনা না হলে তালাক দেওয়ার রীতি এই সমাজে যেন প্রযোজ্য নয়। পড়ন্ত বেলায় চরমোন্তাজের নয়ারচর থেকে ফেরার পথে বেড়িবাঁধের ওপরে দেখা ময়না বেগমের সঙ্গে। বাঁধের বাইরে তার ছোট্ট ঘর। স্বামীর বাড়ি থেকে বিতারিত হওয়ার পর এই ঘরে থাকেন। ময়নার পরনে হলুদ, সাদা আর নীল রঙের ঝকঝকে প্রিন্টের প্রায় নতুন শাড়ি। ‘কেমন আছেন?’- জিজ্ঞেস করতেই হাসি মুখে বললেন- ‘ভালো আছি।’ তর্জনী উঁচিয়ে বাঁধের ওপর ঘরটি দেখিয়ে বলেন, ‘সন্তানদের নিয়ে এখানে থাকি। স্বামী আসে সপ্তাহে দু’দিন। ঘরের দৈনন্দিন হাটবাজারও করে দেয়। পরনের নতুন শাড়িটাও দিয়েছে ক’দিন আগে।’- উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জানালেন ময়না।

চন্দনী বেগম


তবে এটা ময়নার জয়ের পরের গল্প; কঠিন খাদ থেকে উঠে আসার গল্প। পেছনের গল্পটা করুণ; হৃদয় বিদারক। ময়নার বয়স কতই বা, ২৬ বছর হবে! বিয়ে হয়েছিল ১১ বছর আগে। সে হিসেবে মাত্র ১৫ বছর বয়সে আন্ডারচরের বাসিন্দা হারুন বেপারীর দ্বিতীয় বউ হয়ে ঘরে আসেন। ২৬ বছর আগে শাহিদা বেগম নামের একজনকে প্রথম বিয়ে করেছিলেন হারুন বেপারী। কিন্তু সে স্ত্রীর সন্তান না হওয়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন ময়নাকে। ১১ বছরের বিবাহিত জীবনে ময়নার ঘরে আসে তিনটি সন্তান। ময়নার ইচ্ছে ছিল, সন্তানদের নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই থাকবেন; ছিলেনও। কিন্তু সতীনের অত্যাচার নির্যাতন সয়ে সেখানে আর থাকা হয়নি ময়নার। স্বামীর বাড়ি থেকে বিতারিত হয়ে ভাইদের সহায়তায় বসতি গড়েন বাঁধে। এদিকে সন্তান জন্মের পর ময়নার প্রতি আগ্রহ হারাতে থাকেন হারুন বেপারী। ময়নার খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন তিনি। ফলে তিনটি সন্তান নিয়ে বিপাকে পড়েন ময়না। সন্তান এবং নিজের খাওয়া খরচ চেয়ে অনেকবার সালিশি বৈঠক হয়েছে। সালিশে খরচপাতি দেওয়ার জন্য হারুন বেপারীকে চাপ দেওয়া হলেও তিনি বিষয়টি আমলে নেননি। এভাবে চলে যায় বেশ কয়েক বছর। বার বার হেরেছেন; ঠকেছেন; তবুও হাল ছাড়েননি ময়না। শেষ আশ্রয় হিসাবে তিনি থানায় গিয়ে আবেদন করেন। থানা থেকে হারুন বেপারীকে ডেকে শাসিয়ে দেওয়ার পর সমস্যার সমাধান হয়েছে; জানালেন ময়না। এর মধ্যে বাঁধের ওপর ধুলোবালির মধ্যে খেলতে থাকা ময়নার আড়াই বছর বয়সী ছোট ছেলে জুনায়েদ এসে তার কোলে ওঠে।

ময়না জানান, তার ৯ বছর ৫ মাস বয়সী বড় ছেলে বনি আমিনকে তার বাবা নিয়েছে। সে এখন সেখানেই থাকে। মাঝে মাঝে মায়ের কাছে আসে। ৫ বছর বয়সী মেয়ে সানজিদা এবং ছোট ছেলে জুনায়েদ থাকে মায়ের কাছে। হারুন বেপারী সপ্তাহে দু’দিন সোম ও মঙ্গলবার ময়নার সঙ্গেই থাকেন। হাটবাজারও করে দেন। তবে এ অবস্থা অব্যাহত মাত্র ২-৩ মাস। এরপরে কী হবে জানেন না ময়না। তবে আপাতত নিজেকে জয়ীই মনে করেন তিনি। বহু লড়াই-সংগ্রামের পর ময়নার জীবনে একটু আশা জাগলেও হেরে গেছেন চরমোন্তাজের বউ বাজারের পারভিন আক্তার। বয়স ৩৭ বছর পেরোতে পারেনি; এর মধ্যেই দুই স্বামীর ঘর করতে হয়েছে তাকে। হুমায়ূন মল্লিকের দ্বিতীয় বউ হিসেবে ঘরে উঠেছিলেন। প্রায় ১৩ বছর পরে হুমায়ূন না বলেই পারভিনকে ছেড়ে চলে যান। দুই স্বামীর দুই সন্তান শিপলু এবং বিপ্লবকে নিয়ে চলছে পারভিনের জীবন। বউ বাজারের বেড়িবাঁধের পাশে ছোট্ট ঘরে বসবাস করেন তিনি। বেড়িবাঁধের ওপরে বাড়ি হলেও এ জমির পজিশন কিনতে হয়। ১০-১২ বছর আগে পারভিন এই পজিশন কিনেছেন ১৬ হাজার টাকায়। স্বামীর মাছধরা, ছেলেদের লেখাপড়া, এই নিয়ে ভালোই চলছিল পারভিনের সংসার। কিন্তু মায়ের অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে হুমায়ূন মল্লিক একদিন উধাও হয়ে যান। হুমায়ূন চরমোন্তাজে অস্থানীয়। এখানে এসেছিলেন মাছ ধরতে। তার আগের স্ত্রী মরিয়ম বেগম তারই এক ভগ্নিপতির সঙ্গে চলে গেছে বলে হুমায়ূনের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেখানে হুমায়ূনের ছিল তিনটি সন্তান।

বউ বাজারে নিজ ঘরেই কথা হয় পারভিনের সঙ্গে। ঘরের দু’টি কক্ষে থাকেন তারা সবাই মিলে। আলমারি, স্যুটকেস তুলে রেখেছেন কাঠের তাকে। ঘরের খাটের পাশে সাজানো গোছানো কাপড়। পশ্চিমের কক্ষটা একেবারেই নদীর পাড়ে। খোলা জানালা দিয়ে আসছিল শো শো বাতাস। কমলা প্রিন্টের শাড়ি পরা পারভিন একটা পর একটা পান খান। কথা বলার সময় দেখা যায় দাঁতগুলো তরমুজের বিচির মত হয়ে গেছে। সামান্য লেখাপড়া জানার কারণে মার্জিত তার কথাবার্তা; সেই আমলে পড়েছিলেন ফাইভ পর্যন্ত। সংগ্রামী জীবনটা বহন করতে গিয়ে সেটাই অনেক কাজে লেগেছে। কথা বলার সময় দুই ছেলে শিপলু আর বিপ্লব এসে জড়িয়ে ধরেন মাকে। বোঝা যায়, অতিপ্রিয় মাকে তারা এভাবেই আগলে রাখেন। মৎস্যজীবী হুমায়ূন মল্লিক দীর্ঘদিন চরমোন্তাজের বউ বাজারে অবস্থান করায় এলাকার লোকজনের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এদিকে স্বামী চান্দু সরকার ঢাকা থেকে আসার পথে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ায় পারভিনও তখন ছিলেন বিধবা। একটি মাত্র সন্তানসহ তিনি তখন বাবার ঘরে। এলাকার লোকজনকে ধরে হুমায়ূন মল্লিক প্রস্তাব দেয় পারভিনকে বিয়ে করার। এভাবেই প্রায় ১৩ বছর আগে বিয়ে হয় পারভিনের। পারভিনের কোলজুড়ে আসে আরেক সন্তান, বিপ্লব। মায়ের সামান্য লেখাপড়ার কারণে দুই ছেলেরও লেখাপড়া ভালোভাবেই চলছিল। শিপলু সপ্তম, এবং বিপ্লব চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিল। পারিবারিক ঝামেলায় জড়িয়ে আর তাদের লেখাপড়া হয়নি; নামতে হয়েছে কাজে।

পারভিন বেগম


অতি সহজ সরল পারভিন অবিশ্বাস করেননি স্বামী হুমায়ূন মল্লিককে। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর তার ভরসা ছিল এখানেই। সে কারণে মায়ের অসুখের কথা বলে চলে গেলেও সন্দেহ করেনি; অন্যকিছু ভাবেননি। হুমায়ূন টাকা চেয়েছেন; পারভিন দিয়েছেন। এভাবে প্রায় কুড়ি হাজার টাকা নিয়েছেন। বেশ কয়েকবার হুমায়ূনের ছলচাতুরি পারভিনের মনে সন্দেহ জাগায়। তবে এখনও তিনি আশাবাদী; হুমায়ূন আসবেন। পারভিনের নিজে পেশা এখন মৎস্যজীবী। কিছু পুঁজি খাটিয়ে দুই ছেলেকে জালনৌকা করে দিয়েছেন। তারা নদী ও সমুদ্র মোহনায় জাল পেতে যা পায়, তাতেই চলে সংসার। তবে মাছ বেচাকেনা থেকে মাছধরায় যাবতীয় সমস্যা মেটাতে হয় পারভিনকেই। আলাপে জানা গেল, স্বামীর অনুপস্থিতে ধারদেনাসহ নানামূখী সংকটে পারভিনের দিন কাটছে। বিভিন্ন পর্যায়ে দেনা আছে দেড় লক্ষাধিক টাকা। নিজের কঠিন অসুস্থতা নিয়েও এই বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ছেলেরা মাছ ধরে সপ্তাহে রোজগার করতে পারে অতিজোর ২-৩ হাজার টাকা। কিন্তু খরচের পরিমাণ অনেক বেশি। ধারদেনা শোধ, নিজেদের খাওয়া-দাওয়া আর পারভিনের ওষুধ কিনতে এ টাকায় পোষায় না। এখনও আশা নিয়ে বসে আছেন পারভিন; কবে আসবেন তার স্বামী হুমায়ূন মল্লিক।

জীবনযুদ্ধে হেরে গেছেন চন্দনী বেগম। সাত সন্তানের মা চন্দনী এখন আর স্বামী ছালাম দালালের যোগ্য নন। তাই হয়তো রাশেদা বেগম নামের একজনকে দ্বিতীয় বিয়ে করে চলে যান তিনি। চন্দনীর নৌকার জীবন চলে ষষ্ঠ সন্তান ১৫ বছর বয়সী মেঘনা আর সপ্তম সন্তান ১০ বছর বয়সী সোহেলকে নিয়ে। নৌকায় থাকে; নৌকায়ই তাদের বসবাস। মাছধরায় মাকে সাহায্য করে ওই দুই কিশোর-কিশোরী। চন্দনীর প্রথম সন্তান আছিয়া ও চতুর্থ সন্তান ভিমুকে বিয়ে দিয়েছেন নৌকায়। দ্বিতীয় সন্তান জসিম, তৃতীয় সন্তান তসলিম ও পঞ্চম সন্তান জুয়েল বিয়ে করেছে নৌকায়। এরই এক ফাঁকে স্বামীও চলে গেছেন। এখন পরাজিত জীবন চন্দনী বেগমের।     

লেখক: উপকূল-সন্ধানী সাংবাদিক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়