ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সামাদ: বিস্মৃত এক ফুটবল জাদুকর

শিলু হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২৭ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সামাদ: বিস্মৃত এক ফুটবল জাদুকর

সৈয়দ আব্দুস সামাদ

শিলু হোসেন: ১৯৪৭ সাল। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনায় র‌্যডক্লিফের পেন্সিলের টানে ভাগ হয়ে গেল ভারত-পাকিস্তান। মুহূর্তেই ওলোট-পালোট হলো এপার-ওপার বাংলার মানুষের জীবন। বংশ পরম্পরায় বাস করা ভিটেমাটি ছেড়ে পূর্ব বাংলার মানুষ পাড়ি দিল পশ্চিম বাংলায়, আর পশ্চিমের মানুষ পূর্বে। দেশভাগের এই প্রবল ঘুর্ণিবানে অনেকের মতো পশ্চিম বাংলা থেকে সপরিবারে এই বাংলায় চলে আসেন ওই সময়কার ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্ময়কর ফুটবল খেলোয়াড় সামাদ। তাকে সবাই ‘জাদুকর সামাদ’ বলেই চিনতো। পুরো নাম সৈয়দ আব্দুস সামাদ। জন্ম বিহারের পূর্ণিয়ায়, ১৮৯০ সালে। তার পৈতৃক নিবাস পশ্চিমবাংলায় হলেও বাংলাদেশে এসে এখানকার মাটি ভালোবেসেছেন আপন মায়ের মতো।

কোনো কিছুকে ভালোবাসলেই হয়তো তার সবটুকু ভালো জানা যায়, বুঝতে পারা যায় তার নাড়ি-নক্ষত্র এবং সেটা নিয়ে খেলা যায় ইচ্ছেমতো। ফুটবলকে স্রেফ ভালোবেসেছিলেন সামাদ। যে কারণে এই গোলাকার বস্তুটাকে নিয়ে খেলে গেছেন আপন প্রতিভায়। হয়ে উঠেছিলেন ফুটবলের জাদুকর। ১৯২৪ সালে ভারতীয় জাতীয় ফুটবল দলে নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯২৬ সালে ওই দলেরই অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। ত্রিশ বছর ধরে তিনি বহু দেশে বল নিয়ে ফুটবল মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। মাঠে লেফট আউট পজিশনে খেলেছেন প্রায় সময়। তার ছিল প্রচণ্ড জেদ ও আত্মবিশ্বাস। যদি বলেছেন, গোল করবেন, তো করে দেখিয়েছেন। তার ফুটবল খেলার প্রথমদিককার একটি ঘটনা:

১৯১৫ সালে রংপুরের তাজহাটের সেই সময়কার বিশিষ্ট ফুটবলার মহারাজ গোপাল লাল রায় ফুটবল দল গঠন করেন ‘তাজহাট ফুটবল দল’ নামে। কুচবিহারে এই দলের হয়ে মোহনবাগানের প্রতিপক্ষে মাঠে নেমেছেন সামাদ। খেলার প্রথমার্ধে একটা গোল করল মোহনবাগান। মহারাজ গোপাল লাল বেজায় মর্মাহত। তার দুশ্চিন্তা দল বুঝি হেরেই যায়! বিরতির সময় সামাদকে কোনভাবে একটা গোল দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন তিনি। সামাদ এ সময় গোঁফ পাকাতে পাকাতে গোপালের সঙ্গে দুষ্টুমি করে বলেছিলেন, দেব, কিন্তু আপনার হাতের মূল্যবান ঘড়িটি আমাকে দিতে হবে পুরস্কার হিসেবে। গোপাল রাজি হলেন। এরপর দ্বিতীয়ার্ধে পরপর দুই গোল করেন জাদুকর সামাদ।

১৯২৬ সালে চীনের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে তিন গোল খেয়ে হারতে বসেছিল তার দল। ম্যানেজার বললেন, সামাদ, একটা কিছু করতে হবে। সামাদ অভয় দিলেন, চিন্তা করছেন কেন, সামাদ তো এখনও মাঠে আছে। এরপর তার দল মোট চার গোল দেয় চীনের জালে। এই ম্যাচে সামাদ দুই গোল করেছিলেন।

ফুটবল খেলে তখনও সেভাবে জাতীয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে পারেননি সামাদ। গ্রামে ছোট ক্লাবে খেলে বেড়াতেন। আবার ক্লাবে সেরকম খেলা না থাকলে খেপ খেলতে যেতেন তৎকালীন জমিদারদের দলের হয়ে। খেলা শুরুর আগে তাদের কাছে জানতে চাইতেন- কয় গোল দিতে হবে? পুরো মাঠ তিনিই বল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। যদি দেখতেন তার দল কয়েক গোলে জিতে আছে তখন তিনি প্রতিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে বল নিয়ে গিয়ে গোলরক্ষকের সঙ্গে মজা করতেন। এবং খেলার শেষের দিকে যে কয়টা গোলের চুক্তি থাকতো তা মিটিয়ে দিয়ে আসতেন।

চোখের মাপটাও যেন অন্যরকম ছিল এই ফুটবল জাদুকরের। কোন পজিশন থেকে কীভাবে কিক করলে বল ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছাবে তা তিনি আন্দাজ করতে পারতেন সূক্ষ্মভাবে। প্রতিটা ম্যাচেই কোন না কোন বিস্ময়ের জন্ম তিনি দিয়েছেন। একবার তার সর্বভারতীয় ফুটবল দল ইন্দোনেশিয়ায় খেলতে গিয়েছিল। খেলার সময় সামাদ বেশ কয়েকবার প্রতিপক্ষের গোলপোস্টে কিক করলেন কিন্তু দুইবার ক্রসবারে লেগে বল ফিরে এলো। এ ঘটনায় তিনি নিজেই খুব অবাক হলেন। রেফারিকে এবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বললেন, গোলপোস্টের মাপ ঠিক নেই। মাপ ঠিক থাকলে দুটো কিকেই গোল হতো নিশ্চিত। ফিতা নিয়ে আসা হলো। মেপে দেখা গেল সত্যিই গোলপোস্টের মাপ ঠিক নেই। উচ্চতা আসল মাপের চেয়ে চার ইঞ্চি ছোট! এতো গেল একটা ঘটনা। আরেকবার খেলার ঠিক আগ মুহূর্তে পুরো মাঠটা একবার চক্কর দিয়ে এসে সামাদ আয়োজক কমিটিকে জানালেন, মাঠ আন্তর্জাতিক মাপের থেকে ছোট আছে। তাদের দল এই ভুল মাপের মাঠে খেলবে না। আয়োজক কমিটি তার এই অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে মাঠ মাপতে লাগলেন। দেখা গেল সত্যিই মাপে ঠিক নেই!

এরকম অজস্র ঘটনা জাদুকর সামাদের ফুটবল জীবনে রয়েছে। তার নেতৃত্বে বিরাট সব সাফল্য নিয়ে এসেছে সর্বভারতীয় জাতীয় ফুটবল দল। ১৯৩৩ সালে সামাদের নেতৃত্বে গ্রেট বিটেনকে ৪-১ গোলে পরাজিত করে ভারত। এই ফুটবল-জাদুকর জীবনের শেষ খেলা খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ক্যারিয়ারের শেষের দিকে কলকাতা মোহামেডানে খেলে অবসরে যান তিনি। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কারণে পূর্ব বাংলার দিনাজপুরের পার্বতীপুরে এসে তৎকালীন পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়েতে চাকরি নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে জীবনের বাকিটা সময় এই পার্বতীপুরেই কাটান সামাদ। ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শারীরিক অসুস্থতার কারণে জাদুকর সামাদের মৃত্যু হয়। জীবনের শেষ বেলায় মাঠ কাঁপানো এই ফুটবলারকে সেভাবে কেউ সম্মান জানায়নি। তবে তার মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর ১৯৮৯ সালে পার্বতীপুরের ইসলামপুরে একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তার স্মরণে একটা ডাক টিকেট প্রকাশ করে। পার্বতীপুর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তার নামে একটি মিলনায়তন তৈরি করেছে। তবে জন্ম-মৃত্যুদিন ছাড়া সেভাবে কেউই স্মরণ করেন না ফুটবল জাদুকর সামাদকে। ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবল ইতিহাসের স্বর্ণযুগ যার হাতে লেখা সেই ফুটবলারকে আমরা যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। পিচঢালা রাস্তায় দ্রুত ছুটে চলা গাড়ির পিছনে যেমন বালু উড়ে গিয়ে মিলিয়ে যায়, এই কালজয়ী ফুটবলার যেন সময়ের তোড়ে মিলিয়ে গেছেন বাংলার ফুটবলের মাঠ থেকে। তাকে স্মরণে কোনো আয়োজনও আজ আর তেমনভাবে চোখে পড়ে না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়