ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দার্শনিক রুশো ও ফরাসি বিপ্লব

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দার্শনিক রুশো ও ফরাসি বিপ্লব

শাহ মতিন টিপু: ‘আত্মা কলুষিত হতে শুরু করলেই মন আকারে সরু হতে থাকে’ বিখ্যাত উক্তিটি দার্শনিক রুশো’র। ফরাসি এই দার্শনিককে বলা হয় আলোকিত যুগের অন্যতম প্রবক্তা।

যে ক’জন দার্শনিকের চিন্তাধারা ফরাসি বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছিল, রুশো ছিলেন তাদেরই অন্যতম একজন। পুরো নাম জঁ-জাক রুশো (Jean-Jacques Rousseau)। এই মহান দার্শনিকের প্রয়াণ দিবস আজ। ১৭৭৮ সালের ২ জুলাই তিনি প্রয়াত হন। তার জন্মদিন ১৭১২ সালের ২৮ জুন। অবশ্য জন্মসূত্রে তিনি সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী হলেও তার সব কিছুই ফরাসিদের ঘিরে। নিজেও মনেপ্রাণে শতভাগ ফরাসি ছিলেন।

রুশো বিভিন্ন বিষয়েই দু’হাতে লিখে গেছেন। এগুলোর মধ্যে আছে উপন্যাস, নাটক, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সংগীত, উদ্ভিদবিদ্যা প্রভৃতি বিষয়ক গ্রন্থ। তার রচিত উপন্যাসগুলো ছিল একদিকে অষ্টাদশ শতকের জনপ্রিয় বেস্টসেলার এবং একই সাথে সাহিত্যে রোমান্টিকতাবাদের অন্যতম উৎস। তাত্ত্বিক ও সুরকার হিসাবে পাশ্চাত্য সঙ্গীতেও তার অবদান অসামান্য।

রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মূল কারিগর মনে করা হয়।তিনি তার লেখনির মাধ্যমে ফরাসি মননে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জাগ্রত করতে সক্ষম হন।তিনিই প্রথম উল্লেখ করেন,‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সমাজ তাকে শৃঙ্খলিত করে’(Man is born free but everywhere he is in chains)।

তিনি উল্লেখ করেন, পূর্বে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে স্বাধীন ছিল।কিন্তু ব্যক্তিমালিকানার ধারণা সৃষ্টি হলে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়।এর ফলে প্রতারণা ও অতৃপ্ত বাসনা মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে।তাই মানুষ ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে সামষ্টিক ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করে। এভাবেই রাষ্টের সৃষ্টি। তাই জনতার অধিকার রয়েছে বিপ্লবের দ্বারা রাজতন্ত্রের পতন ঘটাবার। "লা কস্তা সোশ্যাল" গ্রন্থে উল্লেখিত এ বাণী ফরাসি জনগণকে ভীষণভাবে বিপ্লবে অনুপ্রাণীত করে।তাই রুশোকে ফরাসি বিপ্লবের মূল প্রবক্তা বলা হয়।

রুশোর মতে, সমাজ ও সমাজের বিলাসিতা থেকেই জন্ম নেয় মানববিদ্যা, প্রযুক্তি, ব্যবসাবাণিজ্য, পাণ্ডিত্য এবং সেই সব বাহুল্য যা শিল্পের বিকাশ ঘটায় কিন্তু একই সাথে সমাজকে সমৃদ্ধ ও ধ্বংস করে...বিখ্যাত জাতিসমূহের প্রাচুর্য তাদেরকে যে ক্লেদাক্ত দুঃখ-দুর্দশার দিকে ঠেলে দেয় এই হচ্ছে তার কারণ। একদিকে শিল্প ও মানববিদ্যা যতই উন্নতি লাভ করে, অন্যদিকে করের বোঝায় জর্জরিত শ্রমে-ক্ষুধায় কাতর অনাদৃত কৃষক ততই রুজির সন্ধানে শহরমুখী হয়। আমাদের নগরগুলি যতই দৃষ্টিনন্দন হয় ততই গ্রামাঞ্চল বিরান হতে থাকে। অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ে। নাগরিক হয় ভিখারি বা ডাকাত, আর ওদের জীবনের ইতি হয় ফাঁসির মঞ্চে বা আবর্জনাস্তুপে। এভাবে রাষ্ট্র একদিকে ফুলেফেঁপে ধনী হয়, অন্যদিকে হয় জনশূন্য বিরান। প্রবল প্রতাপ, সাম্রাজ্য এভাবে অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে তোলে সমৃদ্ধির সৌধ আর ডেকে আনে জনজীবনে অবলুপ্তি।

রুশো’র মতে- মানুষের দুর্দশা ও দুর্বলতার কারণ আদি পাপ নয়, বরং এটা হয়েছে তার আপন প্রকৃতির সাথে পরিবেশের দ্বন্দ্ব এবং অসঙ্গতির ফলে। মানুষ জন্মসূত্রে যে সম্ভাবনা নিয়ে আসে, তা অর্জনের প্রয়াস থেকেই তার মাঝে দেখা দেয় চাহিদা ও উচ্চাকাঙ্খা। অন্তহীন সে চাহিদা পূরণে অন্যের সাথে সে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত হয়। সমকালীন সমাজ কাঠামো ব্যাক্তির বিকাশের পথে অন্তরায়, যা মানুষকে মানুষের মুখোমুখি করে দেয়, তাকে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। আদিম মানুষ ছিল স্বাচ্ছন্দ্য, সুখী ও আত্মসমাহিত। সঞ্চিত রাখার মতো সম্পদ ছিল না বলেই আদিম মানুষের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।

রুশো’র মত হচ্ছে- প্রকৃতি সাম্য ধারণার উপর নির্ভরশীল, যেখানে মানুষ মাত্রই সমান, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তৃপ্ত। প্রকৃতির সেই সুখী ও সৎ মানুষকে সমাজ ব্যবস্থা দুর্নীতিপ্রবণ ও দুর্দশাগ্রস্ত করেছে। রুশো সেই সমাজ ব্যবস্থার একাধারে সমালোচক এবং সমাধানে প্রয়াসী। সমাধান হবে ব্যক্তি ও সমাজের যৌথ পরিবর্তনের দ্বারা। ব্যক্তির উদ্ধার হবে শিক্ষায়, যার বিবরণী আছে তার ‘এমিল’ বইটিতে।

ফরাসি বিপ্লব শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের চিত্র বদলে দিয়েছিল। মানুষের চিন্তার জগৎ আলোড়িত হয়েছিল। রাজতন্ত্রের পতন হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লব গোটা মানব সভ্যতাকে নতুনভাবে লিখতে ভুমিকা রেখেছে। ফরাসি বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। উনিশ শতকে ফ্রান্স ছাড়িয়ে সারা ইউরোপে নতুন ভাবধারার সূচনা করেছিল এই বিপ্লব।

১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সেদিন উত্তপ্ত শ্রমিক, কারিগর, গ্রাম ও শহরের গরিব মানুষের খাদ্যের দাবিতে। প্যারিসের সর্বত্র চলছিল বিক্ষোভ মিছিল। জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য রাজার নির্দেশে মিছিলের ওপর অশ্বারোহী বাহিনী চালিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্যারিসের সামরিক অধিনায়ক সসৈন্যে সরে দাঁড়ালে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ জনতার হাতে চলে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। লুট করা হয় আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান। উত্তেজিত জনতা আরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশে স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের প্রতীক বাস্তিল কারাদুর্গে আক্রমণ করে। উন্মত্ত জনতা কারাগারের বন্দীদের মুক্ত করে।

রাজা ষোড়শ লুই বলতেন, সার্বভৌম ক্ষমতা আমার ওপর ন্যস্ত, সব আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও আমার। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাজার সমালোচনা করলে তাকে গোপন পরোয়ানার আইনে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। স্বেচ্ছাচারিতা আকাশ ছুঁয়েছিল। ফরাসি রাজতন্ত্র জনমানুষের জীবনকে দুরূহ করে তুলেছিল। বেঁচে থাকাই ছিল তাদের সংগ্রাম। পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে সামান্য আয়ে যখন মিলছিল না খাবার তখন রাজপথে নেমে এসেছিল তারা।

১৭৮৯ সালের হিসাবে ফ্রান্সের ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে থাকত। তার মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ছিল কৃষক। অথচ চাষযোগ্য জমির অধিকাংশ ছিল গির্জা ও সামন্তপ্রভুদের হাতে- প্রায় ৩০ শতাংশ। যদিও তারা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ২ ভাগ। এ ছাড়া বিপ্লবের সময়টাতে ফ্রান্সে প্রায় ১০ লাখের মতো ভুমিদাস ছিল। মাঝেই মাঝেই দেখা দিত অজন্মা। একজন ইতিহাসবিদ লিখেছিলেন, ফ্রান্সে ৯ দশমাংশ লোক অনাহারে মারা যায়, আর এক দশমাংশ মরে অতি ভোজনের ফলে। এ ছাড়া ছিল কর বা খাজনার জন্য নির্যাতন। সাধারণ মানুষকে রাজার আরোপ করা কর, গির্জা কর্তৃক আরোপ করা কর, ভুস্বামী বা জমিদারদের আরোপ করা কর দিতে হতো। আইনও ছিল গরিবের বিপক্ষে। তাদের বিচার করার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ততটা মাথা ঘামানো হতো না। সব মিলিয়ে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

ষোড়শ লুই ও তার স্ত্রী মারি অ্যান্তনে। ফরাসি বিপ্লবের ট্র্যাজেডি তাদের ঘিরেই। রাজা ও রানীর স্বৈরাচারিতা, বিলাসিতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি পুরো রাজপরিবারকে সাধারণ জনগণের প্রতিপক্ষ করে তোলে। আন্দোলন দানা বাঁধে। বিদ্রোহীদের কাছে শেষ পর্যন্ত বন্দী অবস্থায় উপনীত হন রাজা ষোড়শ লুই। বিচার শুরু হয়। ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি শতসহস্র জনতার সম্মুখে রাজা ষোড়শ লুইসকে গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হয়। অন্যদিকে ১৬ অক্টোবর রানীর ক্ষেত্রেও একই শাস্তি কার্যকর করা হয়।

ফরাসি বিপ্লব এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল। বিশেষত রাজতন্ত্রের পতন ও বিশ্বাসভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র শব্দটি অর্থবহ হয়ে ওঠে ফরাসি বিপ্লবের পর।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুলাই ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়