ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা নিলুফা ইয়াসমিন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫০, ৩১ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা নিলুফা ইয়াসমিন

ছাইফুল ইসলাম মাছুম : উন্নয়নশীল বাংলাদেশে এখনও অধিকাংশ নারীরাই উদ্যোক্তা হয় প্রতিবন্ধকতাকে সামনে রেখে। আর তেমনি এক প্রতিবন্ধকতা থেকে শুরু হয় নিলুফা ইয়াসমিনের গল্পটা।

জীবনানন্দের শহর বরিশালেই তার বেড়ে ওঠা। শহরের বাংলাবাজারে ১৯৭৮ সালে ১ জানুয়ারি তার জন্ম। বাবা মনসুর আলী সরকারি চাকরি করতেন। মা সেতারা বেগম ছিলেন গৃহিণী। আট ভাই-বোনের মধ্যে নিলুফা ছিলেন তৃতীয়। ছেলেবেলা থেকে এখন পর্যন্ত এই শহরেই তার বসবাস। এইচএসসি পাস করে ডিগ্রি পরীক্ষার সময় বিয়ের বেড়াজালে আটকে পরেন। তাই আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। স্বামী আর তিন সন্তান নিয়েই সুখে দিন কাটছিল। বড় ছেলের এইচএসসি পরীক্ষার সময় তার স্বামী হঠাৎ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। নেমে আসে ক্রান্তিকালের সব থেকে বড় ঝড়। অসহায় হয়ে পড়েন তিন সন্তান নিয়ে নিলুফা। একদিকে স্বামী অসুস্থ। তার চিকিৎসার খরচ চালাতে হবে। অন্যদিকে সন্তানদের পড়ালেখার খরচ, সংসার খরচ সবকিছুই তার কাঁধে এসে পড়ে। কিন্তু নিজের উপার্জনের তখনও কোনো ব্যবস্থা নেই। শুরু হয় এক কঠিন জীবনযুদ্ধ। স্বামীকে বাঁচাতে হবে আবার সন্তানদের মুখে আহারও তুলে দিতে হবে। নিরুপায় নিলুফা তখন নিজের ভিটাবাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সবার পরামর্শ এবং ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত বদল করেন। চেষ্টা করেন কিছু করার। ছুটে বেড়াতে থাকে আত্মীয়-পরিজন সবার কাছে একটি চাকরির জন্য।

স্বামী যখন অসুস্থ থাকে তখন নিলুফাকে তার বাবা-মাই সহযোগিতা করে। প্রায় দুই বছর তার স্বামী অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকেন। বড় ছেলেকে এসএসসি পরীক্ষার পর টিউশনিতে নামিয়ে দেন। তার উপার্জনের টাকাতে ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চলত। কিন্তু সংসারের দুবেলা খাওয়ার খরচ চালাত নিলুফার বাবা-মা এবং বোনেরা। স্বামীর সেবা করতে করতে নীলুফা অন্য কিছু করার সময় পেতেন না। ২০১১ তে তার স্বামী মারা যায়। কূলহীন হয়ে পড়েন নিলুফা। তিন সন্তান নিয়ে অসহায় নিলুফার মাথায় একটা প্রশ্ন কুড়ে কুড়ে খায় কিভাবে তার সংসার চালাবেন এবং সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিবেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’ এর নারী নেতৃত্ব এবং বিকাশ সহায়ক ট্রেনিং এর ৫৪তম ব্যাচে অংশগ্রহণ করেন নিলুফা। যেখান থেকে তিনি বুঝতে পারেন যে তার সব পথ এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি। নিজেই আবার পথ তৈরি করতে পারেন। তারপর থেকেই নিলুফা নেমে পড়েন। আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লড়াইয়ে পাশের বাড়ির এক মহিলার থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। প্রথমে নিজ নিজে সেলাই করেন। ধীরে ধীরে এখন তার বাসায় চারটি মেশিন। তিনজন তার কর্মী। তিনি নিজস্ব ডিজাইনে মেয়েদের থ্রিপিস, নকশি কাঁথা, শাড়ির ডিজাইন, সুতির ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছেন নিলুফা গার্মেন্টস অ্যান্ড বুটিকস হাউস। বরিশাল ও বরিশালের বিভিন্ন উপজেলায়ও মার্কেটিং করেন। এমনকি অনলাইনেও তার ব্যবসার পরিধি ছড়িয়ে দিচ্ছেন। Nilufa Garments & Boutiques House ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অনলাইনে অর্ডার নিচ্ছেন। শুধু বরিশালের স্থানীয় মার্কেট নয়, পাশাপাশি ঢাকাতে ও দেশের বাইরে তার উৎপাদিত পণ্য মার্কেটিং করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়াও তিনি এসএমই মেলা, নারী উদ্যোক্তা মেলা এবং উন্নয়ন মেলাগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করছেন।

নিলুফা বলেন, তিনি এখন খুব ভালো আছেন। আর্থিক ভাবে এবং পারিবারিক ভাবেও। তার বড় ছেলে স্নাতক শেষ করে এখন চাকরির অপেক্ষায় আছে। মেজ ছেলে সরকারি তিতুমীর কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে। আর ছোট ছেলে জিলা স্কুলে ৫ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে।

নিলুফা এখন একজন সফল উদোক্তা। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গেও জড়িত আছেন। এলাকার ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলগামী করছেন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করছেন। এছাড়াও হাঙ্গার প্রজেক্টের নারী নেত্রী হিসেবে এবং বরিশাল উইমেন চেম্বার অব কমার্সের মেম্বার হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন। তার এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এলাকা থেকে আরো মহিলারও এখন এই ব্যবসায় উদ্যোগী হচ্ছেন এবং তাদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন নিলুফা ইয়াসমিন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জুলাই ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়