ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ময়াল সংস্কৃতি এবং মফস্বলের সাংবাদিকতা

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৫, ১৩ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ময়াল সংস্কৃতি এবং মফস্বলের সাংবাদিকতা

সাইফুল ইসলাম : ‘ময়াল’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অঞ্চল। বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘোরাফেরা করাকে বলা হয় ময়াল করা। সম্প্রতি অনেক পুরনো এই ‘ময়াল’ শব্দটি এক সাংবাদিকের মুখে শুনে কানে বাজলো। একটু ঘাটাঘাটি করতেই বেরিয়ে এলো এ শব্দের নতুন অর্থ, নতুন ব্যবহার। আসলে অর্থনীতি, রাজনীতি বদলে যাওয়ার সঙ্গে এ ভাবেই বদলে যায় একটি শব্দের ব্যবহার এবং অর্থ।

অনেক দিন আগের কথা। এক সময় যার যেটা প্রয়োজন পড়তো নিজেই অথবা পরিবারের সবাই মিলে বানিয়ে নিত। তখন অবশ্য পরিবার বা সমাজ ছিল অনেক বড়। একজনের জিনিস আরেক জনের নেওয়া-থোয়ায় সমস্যা হতো না। সাধারণ মানুষের মধ্যে চালু ছিল বিনিময় প্রথা। একটা জিনিসের বিনিময়ে পাওয়া যেত আরেকটি জিনিস। চালের বিনিময়ে তেল, ঘোড়ার বিনিময়ে গরু, এ ভাবেই বিনিময় করে জিনিসপত্রে বদলে নেওয়া হতো। এমন কী কাজের পারিশ্রমিকও দেওয়া নেওয়া হতো বিভিন্ন জিনিসে, অনেকটা ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কাবিখা’ কর্মসূচির মতো। কৃষক জোতদারের জমিতে কাজ করে পেতো একটি নির্দিষ্ট অংশ। যেমন টং, তেভাগা প্রথা। খেয়া নৌকার পাটনি, নাপিত, ধোপারা তাদের কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে ধান-কালাই নিতো। এজন্য তারা মৌসুমের সময় ধামা-ঝাঁকা বা বস্তা নিয়ে ছুটতো গৃহস্থ বাড়িতে। তারা তাদের সামর্থ অনুযায়ী ধান-কলাই দিয়ে সারা বছরের সেবার মূল্য দিত। এ সেবা পাওয়া যেত এমন কী কামার, কুমার, জেলে, তাঁতীর কাছেও। কখনো কখনো দোকানদারেরা তাদের পশরা ভারে করে অথবা ঘোড়ায় করে সাজিয়ে নিয়ে যেতো গ্রামে গ্রামে। বাড়িতে বাড়িতে বিভিন্ন দ্রব্য বিকিকিনি করে পেতো ধান-কলাই, কখনো কখনো অর্থকড়িও। এই বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়াকে বলা হতো ‘ময়াল করা’।

সেদিন এক মফস্বল জেলা শহরের ফুটপাতে বসে চা-পান আর আড্ডা দিচ্ছি, এ সময়েই এলো ৭/৮ জন সাংবাদিক। ওদের বসতে বলতেই ওরা আবদার করলো, এ আড্ডার চায়ের দাম আজ ওরা দেবে। এতোগুলো চায়ের দাম নিজের পকেট থেকে দেওয়া সম্ভব নয়, সঙ্গত কারণেই আর না করা হয় না। জিজ্ঞেস করি, কোথায় গিয়েছিলে? একটু মুচকি হেসে একজন উত্তর দেয়, ‘ময়াল করতে’ গিয়েছিলাম। অনেক পুরনো ময়াল শব্দটি কানে বাজে। জিজ্ঞেস করতেই খোলাসা করে দেয় ওরা। এক লোকের জমি নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ চলছে। সম্প্রতি প্রতিপক্ষ জমি দখলে নিয়েছে, এ সংক্রান্ত একটা নিউজ করতে হবে পত্রিকায়। খবর দেয়ার পর ওরা গিয়েছিল। সেখান থেকেই নিউজ করার জন্য ওরা পেয়েছে দু’হাজার টাকা। এখন টাকাটা ওরা ভাগ করে নেবে, নিউজ পাঠাবে পত্রিকায়। সম্পাদক, মফস্বল সম্পাদককে বলে কয়ে নিউজটি ছাপিয়ে ‘ময়াল’ করে আসা টাকাটি হালাল করার চেষ্টা করবে।

বিষয়টি ঢাকার সংবাদপত্র মহলের অজানা নয়। দেখা গেল, সাংবাদিকদের মধ্যে টিভি, প্রিন্ট এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালের সাংবাদিকও রয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত দু’টি পত্রিকার প্রতিনিধি আছেন যে পত্রিকা ডিএফপির করা তালিকার প্রথম দশটির মধ্যে আছে। জানা মতে, সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ড দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি বিজ্ঞাপনের রেটও বাড়ানো হয়, যাতে পত্রিকা মালিককে সাংবাদিকদের বর্ধিত বেতন দিতে অসুবিধা না হয়। ওরা নিয়মিত বেতন পায় কিনা জিজ্ঞেস করতেই জানালো, বেতন, লাইনেজ, ছবির দাম দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু তা দেওয়া হয় না কতদিন তা ওরা নিজেরাই ভুলে গেছে। ওরা ধরেই নিয়েছে, বেতন-ভাতা দেওয়া কথা বলার নিয়ম আছে বলেই বলা হয়। আসলে ওটা করা হয় ডিএফপিকে দেখানোর জন্য, দেওয়ার জন্য নয়। তাই ‘ময়াল করা’ ছাড়া মফস্বল সাংবাদিকদের এ পেশায় টিকে থাকার আর উপায় কী?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়