ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কুয়াকাটায় শুঁটকি পল্লীর চালচিত্র

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৭ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কুয়াকাটায় শুঁটকি পল্লীর চালচিত্র

খায়রুল বাশার আশিক : নিকটবর্তী বঙ্গোপসাগর আর অফুরন্ত সামুদ্রিক মাছের সহজলভ্য প্রাপ্তির ফলে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় শুঁটকি তৈরি অসংখ্য মানুষের পেশা হিসেবে পরিনত হয়েছে। কুয়াকাটার আশেপাশে গড়ে উঠেছে ৩২টি শুঁটকি পল্লী। মাছ আহরণ থেকে শুরু করে শুঁটকি বাজারজাতকরণ পর্যন্ত চলে শুঁটকি শ্রমিকদের কর্মকাণ্ড।

প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা কাজের মাঝে চলছে কুয়াকাটার শুঁটকি পল্লীগুলোর মানুষের জীবনযাত্রা। তবে পরিবহন সমস্যা, সিন্ডিকেট আর সরকারি মনিটরিংয়ের অভাব থাকায় প্রতিনিয়ত স্থবির হয়ে যাচ্ছে কুয়াকাটার শুঁটকি শিল্প।

বর্তমানে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান গড়েছেন অসংখ্য মানুষ। স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটার আশেপাশে গড়ে ওঠা ৩২টি শুটকি পল্লীতে শ্রম দিচ্ছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার শ্রমিক, এসব শ্রমিক পরিবারে শিশু-বৃদ্ধ সহ প্রায় ৪০ হাজার মানুষের খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন শুঁটকি শিল্প।

 



সরেজমিনে দেখা যায় কুয়াকাটা, মহিপুর, আলিপুর, লেবুর চর, গঙ্গামতির চর, আশাখালী, নাজীমপুরের বিভিন্ন চরে শুকানো হয় এই শুঁটকিগুলো। ঘাটে মাছ আসলে মাছগুলোকে বাছাই করে বিভিন্ন শ্রেনীতে আলাদা করা, মাছ থেকে ময়লা ছাড়ানো, ধুয়ে কেটে মাছগুলো শুকাতে দেয়া, রোদে একাধিকবার মাছগুলোকে উল্টে দেয়া, শুকানো হলে গুছিয়ে শুঁটকিগুলোকে ঘরে তোলা, শুঁটকিগুলোকে বাজারজাতকরণের জন্য গ্রেড করা, বস্তাবন্দি করা কিংবা প্যাকেট করা সহ হরেক কাজে প্রতিদিন ব্যস্ত থাকে শুঁটকি পল্লীর প্রতিটি শ্রমিক। পরিবারের প্রয়োজনে এ কাজে সহায়তা করে এ পল্লীর শিশুরাও।

কুয়াকাটা থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি হচ্ছে শুঁটকি। এর মধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, নীলফামারী, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা সহ উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা-উপজেলায় সরাসরি পাঠানো হয় এসব শুঁটকি।

কুয়াকাটার বিভিন্ন শুঁটকি পল্লীতে কর্মরত শ্রমিকদের তথ্যমতে, এখানে তিন প্রকারে প্রাকৃতিক নিয়মে শুঁটকি তৈরি করা হয়। এই তিন প্রকারের প্রক্রিয়া হচ্ছে- ১) রোদে শুকিয়ে, ২) লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করে এবং ৩) আগুনে ছেঁকে। আগুনের ছেঁকা দিয়ে তৈরি করা হয় চিংড়ির শুঁটকি। ইলিশের শুঁটকি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় লবণ। এছাড়া অন্য সব শুঁটকি তৈরি করা হয় রোদে শুকিয়ে।

 



ব্যবসায়িক সম্ভাবনাময় এই কাজেও নানামুখী সমস্যা প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে শুঁটকি শ্রমিকদের। শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানালেন, কুয়াকাটা থেকে রপ্তানিযোগ্য শুটকি পরিবহন অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। কুয়াকাটা থেকে ঢাকা যাবার পথে মাওয়া কিংবা আরিচা ফেরিঘাটে পণ্য আটকে থাকছে দীর্ঘক্ষণ, এতে কখনো কখনো মেঘ-বৃষ্টিতে পণ্য নষ্ট হবার পাশাপাশি পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অপরদিকে কাঙ্ক্ষিত বাজার হারাচ্ছে। শুঁটকি রপ্তানিতে লসের আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা থাকার ফলে রপ্তানি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র স্থানীয় বাজারের দোকানের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে অনেক ব্যবসায়ী। আর স্থানীয় দোকানের উপর নির্ভরশীল ব্যবসায়ীদের অন্যতম গ্রাহক থাকে শুধুমাত্র আগত পর্যটকবৃন্দ। এতে সরবরাহ অনুপাতে বিক্রির পরিমাণ কমছে, ফলে মন্দা হয়ে আসছে শুঁটকির বাজার ব্যবস্থাপনা। 

মহিপুর শুঁটকি পল্লীর আবু সালেহ জানান, ঢাকার পাইকাররা কুয়াকাটার শুঁটকি খুব পছন্দ করে, তবে বরিশাল বিভাগ থেকে ঢাকায় পরিবহন ব্যয় বেশি থাকায় দাম কম দিতে চায়। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের শ্রমিকরা। তিনি আরো জানান, কিছু কিছু শুঁটকি মাছ মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ খায় না, তাই সেসব শুঁটকির জন্য নির্ভর করতে হয় উপজাতি সম্প্রদায়ের উপরে। স্থানীয় বাজারে এসব শুঁটকি না উঠিয়ে পাঠানো হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে। কিন্তু পরিবহন সংকটে পার্বত্য জেলাগুলোতে পাঠানো ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে।

কুয়াকাটা শুঁটকি পল্লীর শ্রমিক হানিফ হাওলাদার বলেন, হুনছি শুঁটকি এখন বিদেশে রপ্তানি করা হয়। তয় (তবে) হেই (সেই) হিসাবে মোগো (আমাদের) ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘডেনা (ঘটেনা)। মোরা খাইয়া না খাইয়া কাম হরি, আর বড় সব পাইকারের বান্দা (নির্ধারিত) দামেই পাইকারি বেচা লাগে আমাগো।

 



সুধীজনরা বলছেন, শুঁটকি ব্যবসায়কে সরকারের প্রত্যক্ষ মনিটরিং ও সিস্টেমের আওতায় আনা গেলে এ থেকে বাংলাদেশ আয় করতে পারে অসংখ্য বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপাশি সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের আয় ও জীবনধারণের ভালো একটি উৎস হতে পারে শুঁটকি উৎপাদন। পাশাপাশি শুঁটকি ব্যবসায়কে সম্প্রসারণের জন্য সরকাররের উদ্যোগ কামনা করেন শুঁটকি শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়