ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

লেখার মধ্য দিয়েই এক জীবনে বহু জীবনযাপন করি : শাহাদুজ্জামান

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লেখার মধ্য দিয়েই এক জীবনে বহু জীবনযাপন করি : শাহাদুজ্জামান

কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান (ছবি : সাইফ)

আমার সমস্ত লেখার একদম ভেতরে আছে জিজ্ঞাসা। লেখার প্রণোদনা সেই কৌতূহল। আছে সীমাকে অতিক্রম করার প্রবণতা। সেই থেকে শুরু। একটাই তো জীবন। এক জীবনে বহু জীবনযাপনের একটা প্রধান উপায় এই লেখা। আমি মূলত লেখার মধ্য দিয়েই এক জীবনে বহু জীবনযাপন করি। লেখার ইচ্ছে কৌতূহল থেকেই। মেডিক্যালের ছাত্র, ডাক্তার হবো। সেটাই চূড়ান্ত হয়ে যাবার কথা ছিল। আর কী দরকার? কিন্তু আমার ভেতরের সেই কৌতূহল, দ্বিধা, খেয়ালপোকা ওই জায়গায় স্থির থাকতে দেয়নি। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে এই খেয়ালপোকা নিয়ে নাড়াচাড়া করা একটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। একটা দ্বন্দ্বও তৈরি হয়েছিল সে সময়। পরিবারের জন্য ধাক্কা। কিন্তু একটা সমন্বয়ের চেষ্টা ছিল। একটা অপরাধ বোধ থেকেও লেখার যাত্রার শুরুটা ছিল। চিকিৎসা পেশা থেকে সরে লেখাটাকেই প্রাণের প্রধান কাজ হিসেবে নেওয়া। এখানেও একটা দায়িত্বের ব্যাপার আছে। এতো বড় একটা ঝুঁকি বা সিদ্ধান্ত নেওয়া শুধুমাত্র আমার বিনোদন বা আমাকে কিংবা অন্য মানুষকে তৃপ্ত করার জন্য নয়। আমি যে সমাজে বা সময়ে আছি সেখানে আমার একটা ভূমিকা আছে। এই ভূমিকা নির্ভর করে আমার সক্ষমতা বা অক্ষমতার ওপর। সব সময় খোঁজার চেষ্টা করেছি আমার সেই সক্ষমতা আর অক্ষমতার জায়গা কোনটা। টের পেয়েছি, সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে যে কাজটা করতে পারি, সেটা হলো লেখা। লেখালেখি করবো এমন সিদ্ধান্ত থেকে লেখা শুরু করিনি। যে জীবন যাপন করছি, সে জিজ্ঞাসাগুলো থেকে, জীবনটাকে বোঝার জন্যই পঠন-পাঠনের শুরু। আর সেখান থেকেই লেখালেখি। নন-ফিকশন লিখেছি সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় বোঝার জায়গা থেকে। নিজের কথাগুলো বলবার সময় যখন এসেছে, তখন নন-ফিকশন থেকে ফিকশনে এসেছি। নন-ফিকশনের সমাজবিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রশিক্ষণ ফিকশনে কাজ করার মানসিক প্রস্তুতি হিসেবে কাজ করেছে। লেখার জন্য তাড়িত করেছে।

চিন্তাটা আসলে একটা দ্বিধার জায়গা, একটা জিজ্ঞাসার জায়গা। সত্য আমি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই না। অনেক অগ্রজ রাজনীতিবীদ, সমাজবিজ্ঞানী, লেখককে দেখেছি, তারা সত্যকে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। সত্য যেটা পৌঁছে গেছে। বোধিপ্রাপ্ত। আমি বোধিপ্রাপ্ত না। আমি সত্য পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াই না। সত্য পেয়ে গেছি এমন দাবিও করি না কখনও। জীবন বহুস্তরি এবং একটা জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র। একটা বিশেষ মুহূর্তে একজন মানুষ দ্রোহের মধ্যে থাকে। আরেক মুহূর্তে সে ভীষণ বেদনার একজন মানুষ, কখনও বা ভীষণ প্রেমের একজন মানুষ। সেই মানুষ আলাদা তিন রকম মানুষ নয়। একজন মানুষের ভেতরেই নানা স্তরে মানুষ থাকে। এই সম্পূর্ণতাতে একজন মানুষকে ধরাটাই তার প্রেরণা।

আশির দশকে সাহিত্য শুরু করার সময় একটা বিশেষ সত্যকে প্রতিষ্ঠার ব্যাপার ছিল। সত্যের একমুখীনতাকে সাদা এবং কালো হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল। সেই প্রবণতার ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠেছি। কিন্তু জীবনটাকে যাপন করতে গিয়ে মনে হয়েছে, জীবন মূলত ধূসর। সাদা এবং কালো না। একজন লেখকই এই ধূসরতার ওপর দাঁড়াতে পারে। একজন রাজনীতিবিদকে কিংবা একজন সমাজবিজ্ঞানীকে নানাবিধ কারণে সাদা বা কালোয় দাঁড়াতে হয়। একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। একজন লেখকের সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর দায় নেই। আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাই না। কিন্তু তার মানে এই না যে সিদ্ধান্তহীনতার ভেতর থাকছি, জিজ্ঞাসার ভেতর থাকছি, আমি নিস্ক্রিয় থাকছি। আমি প্রশ্ন খুঁজছি, উত্তর খুঁজছি। প্রতি মুহূর্তে আমি কাজ করে যাচ্ছি। কোনো না কোনোভাবে দায়িত্বপালন, সামাজিক মানুষ হিসেবে পথ পরিক্রমণ করছি এবং এই পরিক্রমণের ভেতর দিয়েই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া। সেই জিজ্ঞাসার সঙ্গী করে নিতে চাই আমার পাঠক-পাঠিকাদের।

কিছু লেখক থাকেন ভার্টিকাল রাইটার। তারা একটা স্তম্ভ তৈরি করেন।ঔপন্যাসিক উপন্যাসের, প্রবন্ধকার প্রবন্ধের কিংবা কবি কবিতার স্তম্ভ রচনা করেন। আমি হরাইজন্টাল রাইটার। নির্দিষ্ট কোনো পরিচয়ে কখনোই আগ্রহী ছিলাম না। মালবাহী ট্রাকের মতো মনে হয়। মাথায় প্রশ্নের ভার জাগে। একেকটা প্রশ্নের উত্তরে মাথা আনলোড করতে হয়। আনলোড করার জন্য কখনও গল্পের প্রয়োজন হয়, কখনও প্রবন্ধ। কখনও কলাম। এটা একটা যাত্রার ব্যাপার। এই যাত্রায় দায়িত্ব আছে।
এ পর্যন্ত যে ধরনের সাহিত্যরুচি তৈরি হয়েছে, পাঠকের সেই রুচি অনুসরণ করে, বিনোদন দেওয়ার জন্য লিখি না। যে জিজ্ঞাসা, সেগুলোকে যেভাবে প্রকাশ করতে পারা, সেই প্রকাশ গ্রহণ করার মতো পাঠকের প্রস্তুতি আছে কি নেই, সেটা নিয়ে ভাবা হয় না। এক ধরনের পাঠক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। যারা আগ্রহী লেখার ব্যাপারে। তাদের প্রশ্ন আছে, তারা যুক্ত হতে চায়। এটাই অর্জন। সাহিত্য ম্যারাথন রেস। একটা ধীর প্রক্রিয়া। নিষ্ঠার সাথে নিজেকে সেখানে যুক্ত রাখাটাই আনন্দের ব্যাপার। চেখভ (রুশ গল্পকার, নাট্যকার ও চিকিৎসক আন্তন পাভলোভিচ চেখভ) পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। চেখভ মনে করতেন লেখা এবং পেশা এ দুটো জঙ্গলের ভেতর দুটো খরগোশ ধরার মতো। খুব জটিল কাজ। দুই খরগোশ দুই দিকে চলে যায়। হয়তো সফল হননি কিন্তু তিনি এই খরগোশ ধরার চেষ্টারত।

একজন মানুষের চার ধরনের কথা থাকে। একটা কথা সে সবাইকে বলতে পারে, দ্বিতীয় কথা কাউকে কাউকে বলতে পারে। তৃতীয় কথা সে শুধু নিজের সাথে নিজেরই। আর চতুর্থ কথাটা কাউকে বলা যায় না। এই চার রকম কথা যিনি সাহিত্যে তুলে ধরতে পারেন তিনিই প্রকৃত সাহিত্যিক।






রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়