ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

মেঘনার বুকে বিপন্ন জীবন

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মেঘনার বুকে বিপন্ন জীবন

জুনাইদ আল হাবিব : ‘শত শত মানুষের বসতি। তবুও নেই পথ-ঘাট, ঘূর্ণিঝড় ঠেকানোর সবুজ বলয়। নাগরিক সুবিধাগুলোর শূন্যতায় যেখানে ধুঁকছে মানুষের জীবন। যেখানে ন্যূনতম চিকিৎসার জন্য একটা ক্লিনিক নেই। ভবিষ্যত প্রজন্মের সুশিক্ষায় বেড়ে ওঠার জন্য নেই কোনো স্কুলও! এমনকি নামাজ পড়তেও এসব মানুষকে যেতে হয় ওপারে! নদীর উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে মূল ভূ-খন্ডে।’

বলছি মেঘনার বুকে জেগে ওঠা একটি দ্বীপ রমনী মোহনের গল্প। এটি উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিপন্ন জনপদ। জেলা সদর ও কমলনগরের কিছু অংশ নিয়ে দ্বীপটির ভূ-গঠন। কমলনগরের অংশকে মানুষ চর শামছুদ্দিন বলে জানে।

দেশে এমন কোনো দ্বীপ থাকলে এটি একমাত্র দ্বীপ যেখানে মানুষের মৌলিক অধিকারের কোনোটির প্রতিফলন নেই। এখানে বসতি গড়া মানুষ নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে উপকূলের কোনো না কোনো স্থান থেকে এসেছেন। দু’মুঠো ভাতের জন্য এসব মানুষ নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নদীতে মাছের দেখা না মিললে না খেয়েই দিন কাটাতে হয়। ৬ থেকে ৭ বছরের শিশুদের কাঁধে থাকে সংসারের ভার। ওরা ন্যূনতম অক্ষর-জ্ঞানটুকুও জানে না। জানে কেবল চরের খালগুলোতে মাছ কুড়াতে। যেসব মাছ পাবে তা নদীপার হয়ে মতিরহাট মাছঘাটে বিক্রি করে ওরা সংসারে থাকা স্বজনের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য বাজার সদাই করে। এমনি বাস্তব চিত্র ওখানের।

২৫টি পরিবারের এসব শিশুর ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারের মুখে। শিক্ষার আলো নেই যেখানে, সেখানে সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চিন্তাটাও বেমানান!



মতিরহাট খেয়া ঘাট থেকে আবু মাঝির ট্রলারে করে ১০ মিনিটের মধ্যে দ্বীপে পা পড়ল। খালের পাড় দিয়ে এলোমেলো পথ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরে গেলে চোখ পড়ল সরু খালের দিকে। যেখানে মাছ ধরছেন রাকিব (১০), সাকিব (৮), রেদওয়ান (৯), রাজ্জাক (৭), ফরহাদ (১০), মিতু (৭), রায়হান (১১), আরজু (৮), আশিক (১৫), সোহেল (১৩), সোহাগ (৯) সহ আরো কয়েকজন।

ওদের সবার বাবাই নদীতে মাছ ধরেন। কিন্তু এখন নদীতে মাছ নেই বলে ওরা খালে মাছ খুঁজছে। সবার কাদামাখা গা। পরনে ছেঁড়া পোশাক। জানতে চাইলে ওরা বলছিল, ‘কি দিয়া ভালা স্যুট গাত দিমু? আমরা তো হইসাআলা ন (পয়সাওয়ালা না) । এই যে দেখতেছেন না মাছ টোগাই। এ মাছ বেচি দোয়ানেত্তন হদাই ( দোকান থেকে সদাই) করিয়াম। হরে (ঘরে) দুই এক নেলা ভাত যদি খাইতে হারি তাইলেই খুশি আমরা।’

কী আশ্চর্য্য! ওরা ওদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্বপ্ন দেখে না বলেই এমন কিছু বলছে। আর বলবেই না কেন? যেখানে অক্ষর-জ্ঞান শেখার জন্য নেই ছোট্ট একটা স্কুলও, সেখানে স্বপ্নটা সত্যিই ওদের কাছে অনর্থক।

ওদের সঙ্গে গল্প করে আরো একটুখানি সামনের পথ ধরি। চোখে পড়ল তাঁবুর মতো একটি বসতির। বাকরুদ্ধ হলাম, এটি যেন কোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসাবসরত মানুষের আশ্রয়স্থলের মতো মনে হচ্ছে। ওই তাঁবুতেই বসবাস করেন আমেনা বেগম। বয়সটা ঠিক ষাটোর্ধ্ব। শুরু করে দেন তাঁর আকুতি। মুহূর্তের মধ্যেই বলতে শুরু করেন, ‘স্যার, আঙ্গো কেও নাই। দেহেন কীভাবে আছি? ওই দিন তুফানে ঘরটা ভাঙ্গিয়া লাইছে। অনও এভাবে আছি।’



যদি আবার ঝড়-তুফান আসে তাহলে কী করবেন? এমন প্রশ্নে বলছিলেন, ‘কী আর করমু? ইয়ানেই থাকমু। আল্লাহর ওপর ভরসা। এছাড়া কোনো উপায় নাই আঙ্গো। কেউতো আঙ্গো খবরও লয় না। সরকারকে এক্কান্না কইয়েন, আঙ্গোর দিকে এক্কান্না খেয়াল-টেয়াল রাখতো।’

দ্বীপে কোনো গাছপালার অস্তিত্বও নেই। যার কারণে দুর্যোগের বিধ্বংসী আঘাতে এসব মানুষে জীবন বেশ হুমকিতেই রয়েছে। বজ্রপাত প্রতিরোধকারী কোনো বৃক্ষ না থাকার কারণে বজ্রপাতে স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন এক গৃহবধু। নিহত ওই গৃহবধুর নাম হাছিনা বেগম। এ বছরের এপ্রিল মাসে দ্বীপে ঘটনাটি ঘটে। নিহতের স্বামী ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘নদীতে ওই সময় অভিযান ছিল। ঝড়-তুফানের মধ্যে শুক্রবারের জুমার নামাজ পড়তে মতিরহাট এসেছেন। নামাজ শেষে বাড়িতে ফিরলে খবরটি শুনি। আমার ৫ ছেলে ২ মেয়ে।’

বজ্রপাতে মারা গিয়েছিল তার স্ত্রী। এখনো কপালে মিলেনি সরকারি ক্ষতিপূরণ। তিনি জানেন না, বজ্রপাতে মারা গেলে সরকার যে কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে।

মূলত এর জন্য সচেতনতার অভাবও ভিন্ন একটি দায়। স্বাভাবিকভাবে অন্য মানুষদের মতো জীবন পার করতে এসব মানুষের মাঝে তথ্য শূন্যতাও বেশ প্রকট। এসব মানুষের অধিকারগুলো চাপা পড়ে যায়। কারো খবর থাকে না।



‘এখানে সয়াবিন হয়, মরিচ হয়, ধানও চাষ করা হয়। মোটামুটি ভালোই ফসল হয়। এখানে বইশ (মহিষ) ও গরু চরানো যায়। ওই পাড়ের অনেক মালিকের গরু ও বইশ (মহিষ) ইয়ানে আমরা চরাই। খাঁটি দুধও পাওয়া যায়। দুধগুলো ওই পাড়ে বিক্রি করা হয়।’ এমন সংকটের মাঝে সম্ভাবনার গল্প শুনালেন মো. আলাউদ্দিন। বয়স তার ৪০।

জমিগুলো কাদের? প্রশ্ন করলেই বললেন, ‘এখানে আমরা যারা আছি, কারো জমি নেই এখানে। জমিগুলো ওই পাড়ের মানুষের। আঙ্গোরে জাগা দিছে। তাই থাকি। কোনো রকুম দিন কাড়াই (কাটাই)।’

ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস কিংবা অন্যান্য দুর্যোগের সময় কী করেন এসব মানুষ? জানতে প্রশ্নটা মনির মাঝির কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘সব সময় ইয়ানে থাকি আমরা। কোনো সাইক্লোন সেন্টার নাই ইয়ানে। ঘরের ওপর উঁচু স্থানে আমরা বেশি হানি (পানি) উইড়লে থাকি। এছাড়া কোনো উপায় থাকে না আঙ্গো।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়