ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উপকূলে নারী-শেষ

স্বীকৃতি নেই নারীর কাজে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্বীকৃতি নেই নারীর কাজে

রফিকুল ইসলাম মন্টু

ভর দুপুরে ক্ষেত নিড়ানির কাজে ব্যস্ত খোরশেদা বেগমকে সন্ধ্যায় একপাল গরু নিয়ে ঘরে ফিরতে হয়। পরিবারের আটজনের খাবার তৈরি, ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা, ঘরদোর গোছানোর কাজও তার। লিপিকে আবার বাড়তি কাজ হিসেবে মাছধরা, মাছ বিক্রির কাজও করতে হয়। নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পড়তে হয় ঝুঁকিতে। পুরুষের চেয়ে নারীর কাজের তালিকা দীর্ঘ। নারীকে ঘরের কাজ, বাইরের কাজ দুটোই করতে হয়। পুরুষের অংশগ্রহণ নেই ঘরের কাজে। পুরুষের অবসর বেশি, নারীর কম। পারিবারিক সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকার পরেও নারীর কাজের মূল্যায়ন নেই। বরং কঠোর পরিশ্রমে যে সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে যাচ্ছে নারী, সেই সংসার থেকেই কখনো বিতাড়িত করা হয় তাকে।  

চাঁদপুরের দ্বীপ হাইমচরের গোলদার কান্দির বেলাল বেপারীর স্ত্রী খোরশেদা বেগমের কাজের তালিকার সঙ্গে পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের জসিম সিকদারের স্ত্রী লিপি বেগমের কাজ প্রায় মিলে যায়। একইভাবে কঠোর পরিশ্রমে সংসারের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন ঢালচরের আমানউল্লাহ’র স্ত্রী রেখা বেগম। ঘরের সন্তান লালন, রান্না থেকে শুরু করে মাঠে ফসল আবাদ পর্যন্ত নারীর দায়িত্বের মধ্যে থাকে। রান্নার লাকড়ি কুড়ানো, তরকারি যোগাড় করা, হাটবাজার করতেও নারীকে যেতে হয়। সাহায্যের জন্য রিলিফের লাইনে দাঁড়ায় নারী। দুর্যোগকালে ঘর গোছানোর কাজে থাকে নারী। উপকূলের প্রান্তিকে মর্যাদাহীন নারী, যার কাজের নেই স্বীকৃতি। দ্বীপ জেলা ভোলার মনপুরার ঢালচরের রাবেয়া বেগম মাথায় ভারি বস্তা নিয়ে কেবলই বাড়ি ফিরেছেন। চালডালসহ সদাইপাতি নিয়ে ফিরেছেন। সঙ্গে তার দুই মেয়ে। মনপুরার রামনেওয়াজ থেকে কলাতলীগামী যাত্রী ও মালবাহী ট্রলারটি ঢালচরের গা ঘেঁষে যাওয়ার সময় গতি খানিক কমিয়ে দিলে ঢালচরের যাত্রীরা লাফিয়ে নেমে পড়েন। তারপর পানিভর্তি বিল পেরিয়ে বাড়ি পৌঁছায়। রাবেয়া সেভাবেই বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন বোঝা নিয়ে। বোঝাটা মাথা থেকে নামিয়ে বলছিলেন, ‘আমরা ভাই গরিব মানুষ। আমাগো সব কামই করতে হয়। স্বামী বাড়ি থাকে না। পোলাপান লইয়া খাইতে হইলে কাজ তো করতে হবে। কয়েকদিনের সদেইপাতি আনতে মনপুরা গিয়েছিলাম।’
 


পটুয়াখালীর চরমোন্তাজের নয়ারচরের খাদিজা বেগমকে করতে হয় ঘরে-বাইরের সব কাজ। সংসারের পাঁচ জনের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব বলতে গেলে তাকেই পালন করতে হয়। স্বামী ইউসুফ হাওলাদার অসুস্থ। পেশায় জেলে। মাঝে মাঝে নদীতে যেতে পারলেও সংসারের দায়িত্ব খাদিজার ওপরই। পড়ন্ত বেলায় নয়ারচর বেড়িবাঁধের ওপর তার সঙ্গে আলাপকালে ঘরের মালামাল সরিয়ে নিচ্ছিলেন। ভাঙন ধেয়ে এসেছে; তাই ঘর বদল হয়েছে। চালাবেড়া সরিয়ে খানিক দূরে ঘর বানানো হয়েছে। এখন অন্যান্য মালামাল নেওয়া হচ্ছে। প্রাইমারী পড়ুয়া কন্যা হামিদা বেগম সহায়তা করছে মাকে। আর ছোট কন্যাটি খেলছে পাশে। খাদিজা বলেন, ‘১২ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। সেই থেকে সংসারের বোঝা। তিনটি মেয়ে, তাদের দেখাশোনা, ঘরের কাজকর্ম, বাইরের কাজকর্ম সবই করতে হয়। নদীতে চিংড়ির রেণু ধরতেও যেতে হয়। কাজ কী করলাম, সেটা বড় কথা নয়; বেঁচে তো আছি। এটুকুই যথেষ্ট।’

উপকূলের প্রান্তিকে বহু নারীর সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে। নারী কী কী কাজ করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তৈরি হয় দীর্ঘ তালিকা। রান্নাবান্না, সন্তান লালনপালন, ঘর গোছানো, জাল ফেলা, নৌকা ধোয়া, জাল সেলাই করা, মাঠে নিড়ানি দেওয়া, ফসল তোলা, গরুর খাবার যোগাড় করা, গরুর ঘাস কাটা, সদাইপাতি করা, সংসারের আর্থিক সংকটে ধারদেনা করাসহ প্রতিদিন অনেক কাজ সম্পন্ন করতে হয় নারীকে। এরমধ্যে আবার রান্নাবান্নাসহ কিছু কাজে রয়েছে সময় বাঁধা। এত কাজের পরও বহু নারীকে দিন শেষে নানান গঞ্জনা সইতে হয়। স্বামীর নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকে স্বামীর ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়। নারীদের কাজ সম্পর্কে পুরুষ কী বলেন- জানতে চাইলে ভোলার দৌলতখানের দ্বীপ মদনপুরের বসিন্দা মৎস্যজীবী নূর আলম পাটোয়ারী বলেন, ‘আমাদের ঘরের মহিলারা অনেক কাজ করে। আমরা দরিদ্র মানুষ। সংসারে টানাটানি থাকে বারোমাস। পুরুষ নানাভাবে রোজগারে ব্যস্ত থাকে। ঘরে যাওয়ার সুযোগ থাকে কম। সংসারের বোঝা টেনে নিতে ঘরের মহিলাকেও অনেক কাজ করতে হয়। তাদের পর কাজের চাপ একটু বেশি পড়ে। আমরাও তাকে সহযোগিতা করি।’ একই এলাকার কাঠমিস্ত্রী মুনীর হোসেন বলেন, ‘একদিকে আমরা গরিব, অন্যদিকে দুর্যোগ-দুর্বিপাক। টানাটানির সংসারে কাজ একটু বেশিই থাকে। এ কারণে ঘরের মহিলারা পুরুষকে সহযোগিতা করে কাজ এগিয়ে নেয়।’
 


সরেজমিনে পাওয়া তথ্যসূত্র বলছে, উপকূল অঞ্চলে প্রান্তিকের নারীরা ঘরে-বাইরে নানামূখী কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরিবারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সত্বেও পুরুষই সংসারের নীতিনির্ধারণী কাজগুলো করে। সম্পদ কেনা-বেচা, ছেলেমেয়ের স্কুলে পাঠানো-না পাঠানো, মেয়ের বিয়ে, জমি কেনা, ঘর তোলার মতো পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নারীর মতামতের কোনো মূল্য নেই। নারীর কেমন শাড়ি-ব্লাউজ চাই- সে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগও নেই নারীর। এমনকি স্বামীর ইচ্ছায় নারী এনজিও গ্রুপ সদস্য হন, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করেন এবং অবশেষে সেই ঋণের টাকাটাও তুলে দেন স্বামীর হাতে। ঋণের টাকা তুলে আনেন নারী; কিন্তু সে টাকা খরচ করে পুরুষ। তবে অধিকাংশ নারীর এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। প্রান্তিকের নারীদের অনেকেই মনে করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজ পুরুষের। সেখানে নারীর কোন মতামতের প্রয়োজন নেই। হাইমচরের শিক্ষক আনোয়ারুল আজিম সবুজ বলেন, ‘উপকূলের দ্বীপ-চর এলাকার নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি কাজ করেন। সারাদিনে তাদের বিশ্রামের সময় কম। পুরুষ বাইরের এমন কিছু কাজ করেন; যা নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। পুরুষই সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। কিছুটা অগ্রসর পরিবারে ছেলেমেয়ের বিয়ে, জমিজমা কেনাবেচার ক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করেন। অধিকাংশই এর কোন প্রয়োজন মনে করেন না। নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মাঝে এ বিষয়গুলো নিয়ে ততটা মাথাব্যথা নেই। এক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ উভয়ের মধ্যেই সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। নারীর কাজ কমানো উচিত। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ থাকাও জরুরি।’

নারী-পুরুষের কাজ ভাগাভাগি কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ নিয়ে উপকূলের প্রান্তিক জনপদের মানুষের মাথাব্যথা না থাকলেও শহরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ নিয়ে আলাপ আলোচনা কিংবা গবেষণা করছে। অ্যাকশন এইড-বাংলাদেশের ‘দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং গৃহস্থালির সেবামূলক কাজ: নীতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন নারী প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা সেবামূলক কাজ করলেও এর পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন পান না। দেশের নীতি ও আইনে নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও পুনর্বণ্টনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেই। ফলে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন এখনো অনেক দূরের বিষয়। এ গবেষণায় দেখানো হয়েছে, নেপালের নারীরা গৃহস্থালির সেবামূলক কাজে দৈনিক ৬.৬ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন। বাংলাদেশের নারীদের প্রতিদিন ৬.৩ ঘণ্টা সময় দিতে হয় সেবামূলক কাজে। আর ভারতের নারীরা ব্যয় করেন দৈনিক ৫.১ ঘণ্টা। যেখানে এ কাজে পুরুষরা সময় দেন যথাক্রমে নেপাল ২.২ ঘণ্টা, বাংলাদেশ ১.১ ঘণ্টা এবং ভারতে মাত্র ০.৪ ঘণ্টা।
 


গবেষণা প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব জেন্ডার এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর প্রধান গবেষক ড. সিমিন মাহমুদ বলেন, ‘এমনিতেই নারীরা ঘরের অনেক কাজ করেন। পাশাপাশি আরো অনেক কাজ করতে হয় তাদের। সবমিলিয়ে পুরুষের চেয়েও বেশি কাজ করেন নারীরা। ফলে ঘরের কাজ নিয়ে অসম চাপে পড়েন নারীরা। যা তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে দিচ্ছে।’ অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘আমরা গৃহস্থালির কাজকে সম্মান করি না এবং ধরে নেয়া হয় যে এটা নারীর কাজ। এমনকি আমরা মনে করি এ সব কোনো কাজই না। অর্থনীতিতে স্বীকৃতি না দেয়ার কারণে সমাজে এবং পরিবারে এ কাজের মূল্যায়ন হচ্ছে না।’ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশের অনেকগুলো নীতি ও আইন আছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১, জাতীয় শ্রমিক নীতি-২০১২, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি-২০১১ এবং গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি। এই নীতিগুলোতে সুনির্দিষ্টভাবে পরিবারের সেবামূলক কাজের মূল্যায়ন, স্বীকৃতি ও পুনর্বণ্টনের কোন বিষয় নেই। যা নারীর ক্ষমতায়নের পথে বাঁধা। অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক দলিল বাজেট কিংবা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাপকাঠি ডিডিপিতেও সেবামূলক কাজের বিষয়ে স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন নেই। ফলে ঘরে যখন একজন নারী অবমূল্যায়নের শিকার হন, তখন তার আর যাবার কোন জায়গা থাকে না।  সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের যৌথ গবেষণা জরিপে এসেছে, নারীদের ১২ দশমিক ১টি কাজ জাতীয় আয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় না। জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না, এমন কাজে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বছরের একজন নারী গড়ে প্রতিদিন একই বয়সের একজন পুরুষের চেয়ে তিন গুণ সময় নিয়োজিত থাকেন। প্রতিদিন একজন নারী এসব কাজে যেখানে ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা ব্যয় করেন, সেখানে একজন পুরুষ মাত্র ২ দশমিক ৫ ঘণ্টা ব্যয় করেন। সংখ্যার হিসাবে প্রতিদিন একজন পুরুষের ২ দশমিক ৭টি কাজের বিপরীতে একজন নারী করেন ১২ দশমিক ১টি। দেশের অর্থনীতিতে নারীর এসব অ-অর্থনৈতিক অবদানের কাজকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য এর আর্থিক মূল্য বের করে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত  করার দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়