ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জীবন ও জনপদ

ছোট্ট হাতে নৌকার বৈঠা

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোট্ট হাতে নৌকার বৈঠা

খায়রুল বাশার আশিক : সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয় মানুষের চিন্তাধারা। সময় এবং পরিবর্তিত চিন্তাধারার প্রভাব লক্ষণীয় এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও। নারীর জন্ম ঘরে আবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য নয়, তা এখন উপকূলীয় গ্রামীণ কন্যাশিশুর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। উপকূলীয় নদীমাতৃক জনপদে বেড়ে ওঠা এক একটি কন্যাশিশু প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বেড়ে ওঠে। ঘরের কন্যাটিও যে পারিবারিক সকল কাজের অংশ হতে পারে তার প্রমাণ দিয়েই টিকে থাকতে হয় তাকে পরিবারে।

শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক নারীই নয়, উপকূলীয় নদী-বিলের গ্রামগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি কন্যাশিশু হয়ে ওঠে একজন দক্ষ নৌকাচালক। মায়ের কাছেই তারা আত্মস্থ করে এই বিদ্যা। সরেজমিনে উপকূলীয় জেলা বরিশাল, বরগুনা, ভোলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগুলোতে চোখে পড়ে উপকূলীয় কন্যাশিশুদের এমন নৌকা নিয়ে চলার দৃশ্য। উপকূলীয় জেলাগুলোতে বিল অঞ্চলে এমন অনেক জনবসতি রয়েছে, যাদের বসত ঘরের চারপাশে বছরের অন্তত ছয় মাস আটকে থাকে পানি। ঘর থেকে লোকালয়ে আসার জন্য যাদের সবসময়ই নৌকা ব্যবহার করতে হয়, সে ঘরের মেয়েদের নৌকা চালানো শখের নয় বরং প্রয়োজনের। দূরবর্তী স্কুল বা মক্তব যেতে নৌকা, ঘর থেকে দূরবর্তী জমিতে কাজে ব্যস্ত বাবাকে নৌকা বয়ে খাবার দিয়ে আসা, হাস মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য শামুক বা ঝিনুক সংগ্রহ, ছোট ছোট জাল বা বরশি দিয়ে ভাইবোন মিলে মাছ ধরা, গবাদি পশুর খোঁজখবর নেয়া, রান্নার জন্য জ্বালানী সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে পারিবারিক অনেক কাজের প্রয়োজনে বৈঠা ধরা শিখতে হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ কন্যশিশুকে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়গুলোতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে নারী ও কন্যাশিশুরা। ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া সিডর ও আইলার মতো বড় সব জলোচ্ছ্বাসে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী ও শিশুরাই। তাই চর বা বিল অঞ্চলের শিশুরা বৈঠা ধরতে শেখে জীবনের প্রয়োজনে। বিপজ্জনক অবস্থায় বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নৌকা চালানো বা সাঁতার শেখার জন্য শিশুদের উৎসাহিত করে তাদের পরিবার। বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার জল্লা ইউনিয়নের হারতা গ্রামের শিশু হাবিবা, বয়স আনুমানিক ১২ বছর। এই বয়সেই নৌকা চালানোয় দক্ষ সে। নৌকা নিয়ে প্রতিদিন যায় নানা কাজে। হাবিবার মা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকলে ছোট ভাইকে নৌকার মাঝে বসিয়ে ঘুরে বেড়ায় বাড়ির পেছনের খালে। হাবিবাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, এত কম বয়সে যে নৌকা চালাচ্ছ, তোমার ভয় লাগে না? সে উলটো প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘নৌকায় ভয়ের কি আছে?’ আবারো তাকে প্রশ্ন করা হলো, ‘নৌকার বৈঠা বাইতে কষ্ট হয় খুব?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে হাবিবা জানায়, ‘ঠিকমতো বাইতে জানলে বাওয়া সোজা। কষ্ট হইবো ক্যা?’ এমন সব হাবিবাদের কাছে নৌকা চালানো খুব সহজ হয়ে উঠলেও ব্যাপারটা খুব সহজ নয়। যারা কখনো নৌকা চালায়নি তারা হয়তো বুঝবেন না। তবে যারা একবার নৌকা চালাবার চেষ্টা করেছেন, তারা অন্তত জানেন নৌকা নিয়ন্ত্রণ করা কতটা কঠিন। এমনি কঠিন কাজটাকেও সহজ করে নিতে হয়েছে উপকূলের হাজারো কন্যাশিশুর।



হাবিবার মতোই আরেক শিশু শিপ্রা সমাদ্দার। কৃষিজীবী পরিবারের মাত্র ১৩ বছর বয়সী কন্যা শিপ্রা সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। শিপ্রার বাবা ক্ষেতে কাজে গেলে বাবার দুপুরের খাবার পৌঁছে দেবার দায়দায়িত্ব বর্তায় শিশু কন্যা শিপ্রার কাঁধে। শিপ্রা নিজেই নৌকা চালিয়ে পিতার জন্য খাবার নিয়ে যায়। শুধু বাবার জন্য খাবার বহন করাই নয়, হাঁস মুরগিকে খাওয়ানোর জন্য শামুক/ঝিনুক সংগ্রহ কিংবা প্রতিদিন বিকেলে প্রাইভেট পড়তে যেতে শিপ্রাকে নৌকার বৈঠা ধরতে হয়। শিশু শিপ্রার সঙ্গে কথা হলে সে বলে, মেয়েরা এখন সব কাজ পারে, ছেলেদের থেকে পড়ালেখায়ও আমরা মেয়েরা ভালো রেজাল্ট করি। ছেলেরা নৌকা চালাতে পারলে আমরা কেন পারব না?’

এমন অনেক কন্যাশিশুর গল্প আছে উপকূলীয় জনজীবনে। পরিবারের প্রয়োজন আর পরিবেশ ওদের এমন কর্মচঞ্চল হতে শেখায় খুব ছোট্ট বয়সেই। শহুরে ইট পাথরের জীবনে বেড়ে ওঠা একটি শিশুর সঙ্গে ওদের জীবনের পার্থক্য অনেক। ইদানীং আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে কিছুটা আধুনিক হবার স্বপ্ন দেখে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কিশোরীরা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, গ্রামের পাঠ কক্ষে শিক্ষা নিয়ে বেড়ে ওঠা এই শিশুরা ডিজিটাল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম না পেলেও বাস্তবিক ও সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার শিক্ষা পায় জীবনের প্রথম থেকেই। এই বাস্তবিক শিক্ষা ও পরিশ্রমী জীবনের প্রশিক্ষণ একদিন তাদের পৌঁছে দেবে নারী নেতৃত্বের ভূমিকায়। আর এই বৈঠা হাতের উদ্যমী কিশোরীরা একদিন ভূমিকা রাখবে সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ অক্টোবর ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়