ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রং-তুলিতে প্রতিবন্ধী সুকেশের সংসার

শিল্পী রাণী হালদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২৯ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রং-তুলিতে প্রতিবন্ধী সুকেশের সংসার

শিল্পী রাণী হালদার: পৃথিবী যাদের সুনাম গাইছে, তারা কোনোভাবেই আপনার-আমার চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলেন না। তাদের অনেকেই দারিদ্র্য কিংবা মেধাহীনতার কারণে একাডেমিক ক্যারিয়ার পর্যন্ত গড়তে পারেননি। শুধু কী তাই? কেউ কেউ তো শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধী হয়েও পরিবার, সমাজ তথা দেশের হাল ধরেছেন। অথবা নীরবে নিভৃতে আলো ছড়িয়েছেন। সুকেশ হালদার তেমনি একজন।

জীবন সংগ্রামে স্রোতের বিপরীতে টিকে থাকা সুকেশ অদম্য এক লড়াকু। অন্য আর দশটা শিশুর মতো তিনি বেড়ে ওঠেননি। বন্ধুদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করে কিংবা দৌড়ঝাঁপ করার সুযোগ হয়নি তার। অন্যের হাত ধরে কিংবা লাঠিতে ভর করে তাকে পথ চলতে হয় প্রতিনিয়ত। দুই হাতে শক্তি পান না ঠিকমত। এছাড়া হাঁটতে শিখেছেন ৫-৬ বছর বয়সে এবং কথা বলা শিখেছেন আরও অনেক পরে। 

১৯৮৮ সালে রাজশাহী বাঘা উপজেলার আড়ানী বাজার গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারে সুকেশ হালদারের জন্ম। সুকেশরা ৫ বোন। ফলে সুকেশ সংসারের মধ্যমণি। কিন্তু এই আদরের মধ্যমণিকে ঘিরেই ধীরে ধীরে সবার মনে দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। কেননা তার জন্মের ২-৩ মাস পর মা-বাবা বুঝতে পারেন, সন্তান প্রতিবন্ধী। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন পরিবারের সবাই। অনেক চেষ্টা করেও হাত ও পায়ের পূর্ণ শক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। তবে সময়ের ব্যবধানে হাত ও পায়ে কিছুটা বল ফিরে পেলেও সেটি যথেষ্ট ছিল না। তাই খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজ করতে হয় তাকে বাঁ হাতে।

হাত ও পায়ের শক্তি হারালেও সুকেশ মনের শক্তি হারাননি কখনো। শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। সুকেশ বলেন, অন্য সবার মতো স্বাভাবিক না হওয়ায় স্কুলে যেতে পারতাম না। মা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, নিয়ে আসতেন। কিন্তু মাঝপথে মাকে শুনতে হয়েছে অনেক কটূ কথা- ‘ছেলে ঠিকমতো হাঁটতে পারে না, কলম ধরতে পারে না তার আবার লেখাপড়া’।

সুকেশের বাবা ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তার একার উপার্জনে ৯ সদস্যের সংসার ঠিকমত চলত না। সুকেশের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারছিলেন না তিনি। তাই পড়ালেখার পথও বন্ধ হয়ে এসেছিল তার। জীবন যুদ্ধে হার না মানা সুকেশ তখন হাতে তুলে নেন রং-তুলি। ব্যানার, সাইনবোর্ড লিখে উপার্জনের টাকা দিয়ে পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি পড়ালেখার হালটাও ধরে রাখেন। ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পাস করে গেলেও মাধ্যমিকে হোঁচট খেয়েছেন। কিন্তু দমে যাননি। পঞ্চমবারের চেষ্টায় মাধ্যমিক পাস করেন। তেঁতুলিয়া বি. এম. কলেজ থেকে ২০১১ সালে করেন উচ্চ মাধ্যমিক পাস।

শিক্ষক আবুল খায়ের বলেন, হাজারো প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ছেলেটি উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রং তুলি হাতে নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছে। জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলেছে নিরন্তর। সে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। সুকেশের সংগ্রামী জীবন এলাকার যুবকদের অবাক করে দিয়েছে। তার কাজের মান আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি তার জন্য গর্ববোধ করি। বয়স বেশি হবার জন্য সে ডিগ্রীতে ভর্তি হতে পারেনি। কিন্তু হাতের নিপুণ কাজ দিয়ে সে সবার মন কেড়েছে।

আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীরা এখনো অনেক অবহেলিত, লাঞ্ছিত, অপমানিত। অভিভাবকরা প্রতিবন্ধী সন্তানদের নিয়ে সব সময় বিপাকে থাকেন। কিন্তু সবার সহযোগিতা পেলে প্রতিবন্ধীরাও সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে বলে মনে করেন সুকেশ হালদার।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়