ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শীতে আর জমে না সেই মার্বেল খেলা

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৪, ৮ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শীতে আর জমে না সেই মার্বেল খেলা

খায়রুল বাশার আশিক : গ্রামবাংলার অতি আনন্দের খেলা- মার্বেল। এক দশক আগেও গ্রামের পথে-ঘাটে-মাঠে কিংবা শহরতলির সরু রাস্তায় দেখা যেত কিশোরের দল মার্বেল খেলায় মেতে উঠেছে। গ্রামে এই খেলা জমে ওঠার উপযুক্ত সময় ছিল শীতকাল। আজ হারিয়ে যেতে বসেছে এই খেলা। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রতিবছর শীত ফিরে এলেও তেমন আর জমে ওঠে না সেই মার্বেল খেলা।

মার্বেল সাধারণত পাঁচ-ছয়জন মিলে খেলে। তবে দু’জনেও খেলা যায়। যে ধরনের জায়গায় ছোটগাছ বা ঘাস-গুল্ম নেই, অর্থাৎ সমান মাটির জায়গা মার্বেল খেলার জন্য সুবিধাজনক। এই খেলার জন্য একটি ছোট্ট গর্ত করতে হয়। নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়রা সবাই একটি করে মার্বেল গর্তের দিকে গড়িয়ে দেয়। প্রথমত গর্তের খুব কাছে বা গর্তের ভেতরে যার মার্বেলটা থাকে সে প্রথম পর্যায়ে প্রথম বলে বিবেচিত হয়। এরপর নিয়ম অনুযায়ী সবাই ৩/৪/৫টা করে মার্বেল জমা দেয় প্রথম স্থান অধিকারী খেলোয়াড়ের কাছে। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের খেলা, সবার জমা দেয়া মার্বেলগুলো মাটিতে গড়িয়ে দিতে হয় দাগের ওপারে। এরপর একটি মার্বেল দিয়ে নিশানা ঠিক করে দূরে নির্দিষ্ট একটি মার্বেলের গায়ে লাগাতে হয়। মার্বেলটি গড়িয়ে দেয়ার সময় একাধিক মর্বেলের গায়ে লেগে গেলে প্রথমজন বাদ, খেলতে আসবে দ্বিতীয় জন। একইভাবে দ্বিতীয়জন বাদ হয়ে গেলে খেলতে আসবে তৃতীয়জন। যার গড়িয়ে দেয়া মার্বেল কোনো মার্বেল স্পর্শ না করে নির্দিষ্ট মার্বেলের গায়ে লাগবে সে জয়ী। সে তখন মাঠে থাকা ওই মার্বেলের মালিক হয়ে যাবে। এই হলো মার্বেল খেলার সংক্ষিপ্ত  নিয়ম। এ ছাড়াও মার্বেল খেলার আরো অনেক প্রকরণ ও নাম রয়েছে। যেমন আংটিস, বিঘাতি ইত্যাদি। বিগত ৫-৭ বছর আগে ১ টাকায় দোকানিরা ১০-১২টি মার্বেল বিক্রি করতো। এখন ১ টাকায় ৪-৫টি মার্বেল পাওয়া যায়। মার্বেল হলো কাচের ছোট বল।



বরিশাল বিভাগে স্থানীয় ভাষায় মার্বেলের অনেক নাম। যেমন ড্যাগ, তারা, পুস্কি, কালি, বেঙ্গি ইত্যাদি। আবহমান বাংলার মার্বেল খেলা এখন বিলুপ্তপ্রায়। এখনো মাঝেমধ্যে যা একটু দেখা যায় তা খুবই কম। হয়তো আর ১০ বছর পর এই খেলা মোটেই দেখা যাবে না। বরিশাল লঞ্চঘাট তীরবর্তী মুক্তিযোদ্ধা পার্কে একদিন মার্বেল খেলা হচ্ছে দেখে থমকে দাঁড়াই। নদী তীরবর্তী এই পার্কটির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটি বস্তি। এখানে যারা মার্বেল খেলছিল সবাই বস্তির শিশু অধিবাসী। দলে একটি মেয়ে শিশুও চোখে পড়ল। এই দৃশ্য দেখে যে কারো ছোটবেলার মার্বেল খেলার কথা মনে পড়ে যেতে পারে। এখনকার সমাজের অনেকের কাছেই মার্বেলসহ আরো অনেক গ্রামীণ খেলা যেন শুধুই স্মৃতি।

ফসল কাটার পর শূন্য জমিতে জমে উঠতো নানা ধরনের খেলা। কানামাছি, এক্কাদোকা, বৌছি, লাটিম, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, ওপেন টু বায়োস্কোপ, দাড়িয়াবান্দা, বোম-বাস্টিং, চারাপাতিসহ নানা ধরনের খেলার আয়োজন। স্কুল থেকে ফিরেই, ঘরে কোনোমতে বই রেখেই সবাই ছুটতো খেলার মাঠে। সবাই মিলে হৈ-হুল্লোরে জমে উঠতো মাঠ। সেই দিনগুলোতে স্কুল ব্যাগের ভেতরে কোনো কৌটায় ভরে কিংবা হাফ প্যান্টের পকেটে রাখা হতো মার্বেল। স্কুল চলাকালে বা টিফিন পিরিয়ডে লুকিয়ে মার্বেল বা লাটিম খেলে স্যারের দু’চার  ঘা বেতের বারি বা কানমলা খায়নি এমন ভালো ছেলে খুব কমই ছিল। এমন দিনগুলো হারিয়ে গেছে। এগুলো এখন শুধুই স্মৃতিকথা। বর্তমানে গ্রামের মাঠে খেলা বলতে ফুটবল বা ক্রিকেট। মার্বেল তো দূরের কথা, হারিয়ে গেছে জাতীয় খেলা হাডুডু। এই খেলাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ বা পৃষ্ঠপোষকতা। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান জীবন ও জীবিকার তাগিদে শহুরে বাবা-মায়ের মতো ব্যস্ত থাকেন গ্রামের বাবা-মায়েরাও। তারা শিশুদের খুব কম সময় দিচ্ছেন। অপরদিকে খেলাধুলার জন্য যে সঙ্গীদল দরকার গ্রামের শিশুরাও এখন তা খুব একটা পাচ্ছে না। শহরের ভাবধারায় গ্রামের শিশুদের পাঠ্যক্রমেও এসেছে নানামুখী পরিবর্তন। দেখা যাচ্ছে, স্কুল থেকে ফিরেই শিশুদের যেতে হচ্ছে প্রাইভেট পড়তে। সন্ধ্যায় ফিরে একটু টিভি দেখা ছাড়া আর কোনো বিনোদন তারা নিতে পারছে না। এতে তাদের শারীরিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানসিক বিপর্যয় ঘটছে।



এ প্রসঙ্গে বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং শিশুবিষয়ক গবেষক ড. মু ইব্রাহীম খলিল বলেন, দেশ হচ্ছে ডিজিটাল আর মানুষের চিন্তা চেতনায় আসছে নানামুখী পরিবর্তন। সময়ের এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ খেলাধুলা ও বিনোদনও পালটে গেছে। শিশুদের জীবনেও লেগেছে সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া। বাংলাদেশের শিশুরা যেখানে অহরহ মার্বেল খেলতো তা কমে এসেছে শূন্যের কোঠায়। গ্রামের শিশুদের মাঝেও বাঁচতে দেয়া হচ্ছে না গ্রামীণ ঐতিহ্য। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিষেধাজ্ঞা ও আধুনিকতার ছোঁয়া গলা টিপে হত্যা করছে গ্রামের পুরোনো সব খেলা।’

বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। এসব খেলা কখনো শিশুদের বিকৃত মানসিকতায় ধাবিত হতে দেয় না। বরং এসব খেলা শিশুদের মেধাগত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। শারীরিক ক্ষতিসাধন না ঘটিয়ে বরং শরীর ও মন সুস্থ রাখে। খেলাধুলার এত সব উপকারিতার মাঝেও বাস্তবতার নিরিখেই আমাদের ভেবে নিতেই হচ্ছে, সন্নিকটে শীত, হয়তো জমবে না সেই মার্বেল খেলা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়