ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘পড়লে, বেতন চালাবে কে?’

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘পড়লে, বেতন চালাবে কে?’

নিরব

জুনাইদ আল হাবিব : ‘পড়লে, বেতন চালাবে কে?’- প্রশ্নটা নিরবের।

ছোট্ট নিরব, বয়স ওর ১২তে ছুঁয়েছে। মেঘনার ভাঙনের অভিশাপও ছুঁয়েছে নিরবের টানাটানির সংসারকে। বাবা আবুল কাশেম, মা আলেয়া বেগম। বাবার বয়স ৪০, মায়ের ৩৪। দু’জনের কেউ ওর জীবনে আলো ফেলতে পারেননি। যদিও মায়ের একটু চেষ্টায় নিরবের ক্লাশ টু পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছে। দারিদ্রতার টানাপোড়নে থমকে যায় নিরবের গতিপথ। নিরব ঝরে পড়ে পাঠাশালা থেকে। নিরব নীরব হয়ে যায়। ওর সামনে অন্ধকার! ও অন্ধকার দেখে। ও এখন বুঝে, তাঁর ভবিষ্যত কি? তখন তার মুখে যেন মেঘের ছায়া ভর করে।

উপকূলের মেঘনাতীরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মেছে নিরব। বর্তমানে ভৌগলিক ঠিকানা লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের দক্ষিণ চর মার্টিনে। এর আগে নদীতে নিরবরা ঠিকানা হারিয়েছে একই উপজেলার পশ্চিম চর লরেন্স হাজিগঞ্জ বাজার সংলগ্নে। হাজিগঞ্জ এখন স্মৃতির একটা শব্দ। বিশাল বাজার, ৫ দিনব্যাপী তাফসীরুল কোরআন মাহফিলে মানুষের ঢল, ক্রিকেটপ্রেমীদের উল্লাসের চিত্র এখন নেই। ওখানে এখন জেলেরা ইলিশ ধরে, রাজধানী ঢাকার সদরঘাট থেকে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দিকে জাহাজ ফেরে। এসব এলাকার মানুষরা ছিটকে এখন বিচ্ছিন্ন। নিরবরাও ওদের মতো।

‘গাঁঙ্গে ভাইঙ্গা যাওনের পর আমাগোরে এক লোকে এট্টু জাগা দিছে। হিয়ানে আমরা থাকি। ঘরটাও এক্কারে ভাঙা।’ মেঠোপথে পথে পথে চলতে চলতে বলছিল নিরব।

নিরব বলছিল, ‘বলিরপোল মাদ্রাসাতে ক্লাশ টু পর্যন্ত পড়ছি। আমার মায় বিভিন্ন এলাকায় যাইতো। কেউ কিচ্ছু দিলে সেখান থেকে আমার পড়ার বেতন দিতো। কিছু খাইতে টাকা দিতো। আঁঙ্গো সংসারটাও চলতো।’

‘মার শরীরটা ভালো না অন। শান্নিবাতিক জ্বরে মার দুই হাতের আঙুলগুলো শুকিয়ে গেছে। হাড্ডি আর রগ দেখা যাচ্ছে। শরীর থেকে চামড়া খসে খসে পড়ছে। পায়ের তলা ঘা। ক্ষতও আছে। তাই মা এখন আর কোথাও যাইতে পারে না। আগের মতো কেউ আমাগোরে সাহায্য করে না। চর কালদকিনির ছায়েফ উল্লাহ চেয়ারম্যানের রিলিফের চাইলের নাম একটা দিয়েছে। সে চাইল দিয়েই এখন আমরা ভাত খাই।’

- কথাগুলো বলে আর মেঠোপথ ধরে বেশ তাড়াহুড়ো করেই হাঁটছে নিরব। ওর মাথায় তখন তিনজনের দুপুরের ভাত। নিরবের সঙ্গে ধান মেশিনওয়ালাদের চুক্তি হয়েছে। সে গোটা ধান তোলার মৌসুম মেশিনে ধান মাড়াইকারীদের জন্য সকাল-দুপুর ভাত নিয়ে যাবে। প্রতিদিন সকাল-দুপুর ভাত পৌঁছে দিতে তাকে দু-তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এর বিনিময়ে নিরব পাবে দুই মণ ধান।

নিরব এতেই যেন সন্তুষ্ট। কারণ সে বোঝে, নাই মামার চেয়ে কানা মামা অনেক ভালো। সন্তুষ্ট বলেই নিরব এ কাজে রাজি হয়েছে। তাছাড়া যার সঙ্গে ওর চুক্তি হয়েছে তিনি বলেছেন, নিরবকে তিনি ঠকাবেন না।

নিরবের কাছে জানতে চাইলাম, সবাইতো পড়াশোনা করে স্বপ্ন দেখে জীবনে একেকজন একেকটা হবার। তো তোমার স্বপ্ন কি? নিরব এ প্রশ্নে কিছুটা যেন থমকে গেল। বললো, ‘আমার তো বাবা বাড়ি নাই। মা তো অসুস্থ-ই। বাবা ঠিকমতো বাড়িতে আসে না। সংসারে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। ঠিকমতো খোঁজখবর নেয় না। সেনাবাহিনী হতে চাইছিলাম, কিন্তু পড়লে বেতন চালাবে কে?’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়