ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বৃদ্ধ বয়সে কেন ফেরিওয়ালা?

মহিউদ্দিন অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ৩০ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৃদ্ধ বয়সে কেন ফেরিওয়ালা?

ইউসুফ খান

মহিউদ্দিন অপু : ‘স্ত্রী, মাইয়া, পোলা, পোলার বউ, ৬ মাসের এউক্কা নাতী সবই আছে। পোলায় মাশাল্লাহ, মাদ্রাসার হেডমাস্টার। আল্লায় দেলে.. বারতে বেমালা ফলের গাছ আছে। আম গাছ আছে ৩০টা, কাডাল গাছ ৩৩ টা, ক্যালা গাছ ৬৫টা, লেবু গাছ আছে গোডা ৫-৬ আর বোম্বাই মরিচ এক খেত। তবুও মনে ওয় কিছুই নাই। কতা কওয়ার মানু কম। বেবাক্কের একছের কামকাজ।’ কথাগুলো বলছিলেন বরগুনা জেলার খেজুরতলা গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ মো. ইউসুফ খান।

ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় কিংবা স্থানীয় হাটবাজারে প্রায়ই তার চলাফেরা লক্ষ্য করা যায় একজন সবজি বিক্রেতা হিসেবে। এই বয়সে কয়েকটা কলা, লেবু, মরিচ নিয়ে সকাল সকাল শীত উপেক্ষা করে বাজারে আসেন তা বিক্রয় করতে। ইউসুফ খানের সঙ্গে বেশ কৌতূহলবশতই তাই কথা হয়। তার সঙ্গে কথা বলে একপর্যায় জানা যায়, পরিবারে তার সবই আছে। বৃদ্ধা স্ত্রী আছেন, যিনি বার্ধক্যের কারণে তেমন একটা কথা বলতে পারেননা। ছেলে আছে, নাম রাজ্জাক খান। যিনি স্থানীয় খেজুরতলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন বলে দিনরাত মাদ্রাসা আর টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ছেলের বৌ আছে, যিনি তার ছয়মাসের বাচ্চা ছেলে, রান্নাবান্না ও যাবতীয় ঘরের কাজে রাতদিন ব্যস্ত থাকেন। সকলের ব্যস্ততার মধ্যে তাই সব থেকেও তার যেন কিছুই নেই, মানসিকভাবে কিছুটা নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। মাঝেমাঝে এমনটাই অনুভব হয় তার বলছিলেন তিনি। তাই মানুষের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটাতে ও নিঃসঙ্গতা দূর করে মানুষের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখতে বৃদ্ধ বয়সে বেছে নিয়েছেন তিনি এই পদ্ধতি।

বয়স বেড়ে যাওয়ায় তার শরীরে জড়তা এসে গেছে। মাঝেমধ্যে হাত-পা অবশ হয়ে যায়। চিকিৎসক বলেছেন নিয়মিত কমবেশি হাঁটাচলা করতে। তাই নিয়মিত হাঁটাচলা করে শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকতে সকাল সকাল হেঁটে হেঁটে বাজারে আসেন তিনি। নিয়মিত ৪০-৫০ টাকা বেচাকেনা হয় তার। যা দিয়ে নাতি মহরাজের জন্য মাঝেমাঝে খেলনা কিনে বাড়ি ফেরেন তিনি। কখনো কখনো স্ত্রীর জন্য পান-চুনও কেনেন। কখনো কখনো ঘরে রাখা তার মাটির ব্যাংকে টাকা জমানোর জন্য কিছু না কিনেই বাড়ি ফেরেন। ইতোমধ্যে বৃদ্ধ ইউসুফ খান অনেকের কাছে বুড়া ফেরিওয়ালা, ভ্রাম্যমাণ বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা নামে পরিচিতি পেয়েছেন। এই বয়সে বাজারে যেতে পরিবারের নিষেধ থাকলেও বাজারে আসেন বলেও জানান তিনি।

সাধারণত বার্ধক্যে এলে- চুল পাকা, ত্বকে বলিরেখা, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, পেশি দুর্বল, হাড়ের ক্ষয়, যকৃৎ ও বৃক্কের কার্যক্ষমতাও কমে যাওয়াই স্বাভাবিক। প্রবীণ, বার্ধক্য, বৃদ্ধাবস্থা, বৃদ্ধ বয়স কিংবা জরা হলো মানবজীবনের শেষ ধাপ। শিশুকাল, কৈশোর ও যৌবনকাল পার করে মানবজীবনে আসে এই বার্ধক্য।

গবেষকরা বলছেন, প্রতিটি মানব কোষে নির্দিষ্ট সংখ্যক অজস্র ডিএনএ রয়েছে। যার একটি ছোট্ট অংশ হলো জিন। জিনগুলোই বংশগতির ধারক ও বাহক। বৃদ্ধ হবার প্রধান কারণ হিসেবে তাত্বিকভাবে জিন জনীত কারণকেই তাই ধরে নেয়া হয়। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু কিছু রোগ প্রকৃতিগতভাবে বয়স্কদের হয়। বেশিরভাগ সমই বয়স্কদের রক্তনালী সরু হয়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ প্রভৃতির আশঙ্কা থাকে। প্রবীণদের মস্তিষ্ক ছোট হয়ে আসে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ব্রেন এট্রফি’। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কেউ কেউ অ্যালঝেইমারস বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন। এসব রোগে স্মৃতিশক্তি কমে যায়, আবেগ, অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, চিন্তাক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসে। আচার-আচরণে অনেকেই শিশুতে পরিণত হন। এছাড়া মাথাঘোরা, হাত-পা কাঁপা বা ‘পারকিনসন’স ডিজিজ’ ইত্যাদি নানা ধরনের মস্তিষ্কের রোগও প্রবীণদের মাঝে লক্ষ্য করা যায়।



জানা যায়, বৃদ্ধ জনগোষ্ঠির সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে সুইজারল্যান্ড। ছিয়ানব্বইটি দেশের এই তালিকার মধ্যে সবথেকে নিচে রয়েছে আফগানিস্তান। এছাড়াও প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান সেখানে ৭১ আর বাংলাদেশের অবস্থান ৬৭।

আরো জানা যায়, শুধু শারীরিক সমস্যা নয়, মানসিকভাবেও অনেক সময় বিপর্যস্ত হন বৃদ্ধরা। কখনো কখনো নিজের সন্তানেরাও তাঁদের বোঝা মনে করেন। অনেক সময় অবহেলা-অযত্নের শিকার হন পরিবারেই। তাই কারো কারো আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে। গ্রামের প্রবীণ আর শহরের প্রবীণের সমস্যা অনেক সময় ভিন্ন। শহর কিংবা গ্রাম, বৃদ্ধদের সব থেকে বড় সমস্যা নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গ জীবন সবার কাছেই একটি বড় ব্যাধি। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়েসে নিঃসঙ্গতা মানুষকে চূড়ান্ত অবসাদের দিকে ঠেলে দেয়। উন্নত বিশ্বে বৃদ্ধদের নিঃসঙ্গতা দূর করার যথার্থ ব্যবস্থা থাকলেও বাংলাদেশে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।

ডা. মো. হুমায়ূন সাহিন খান, জেলা সিভিল সার্জন কর্মকর্তা, বরগুনা। বাংলাদেশে এমন বৃদ্ধ বয়সী মানুষদের শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও চিকিৎসার দিক উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের দেশে বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা সীমিত। বৃদ্ধ বয়সে অনেক রোগ দেখা দিলেও সুনির্দিষ্ট উপসর্গ না থাকায় কিংবা বয়স্করা সেগুলো ঠিকমতো অনুভব করে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারছেনা। আবার অনেক সময় দেখা যায়, খুব জটিল বা মারাত্মক অসুখে বৃদ্ধ রোগীরা সাধারণ অবসাদ, দুর্বলতা, অস্বস্তি এ ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। কেউ কেউ পরিবারের সঙ্গে মনখুলে কথা না বলতে পেরে নিজেদের নিঃসঙ্গও অনুভব করছেন। অনেকক্ষেত্রে যা পরিবার থেকেও নজর দেওয়া হয় না। এমনকি অনেক চিকিৎসকও তা যথার্থ মনোযোগ দেন না। হয়তো সকলেই তা শুধুমাত্র বার্ধক্যজনিত বলে মনে করেন।’

মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু, স্থানীয় সমাজসেবক ও প্রবীণ সাংবাদিক। বাংলাদেশে এমন বৃদ্ধ বয়সীদের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে বলেন, ‘আজ যাঁরা প্রবীণ তাঁরাও অতীতে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির কল্যাণে অনেক কিছু করে গেছেন। প্রবীণ বা বয়স্ক ব্যক্তিরা সম্মানিত। যাঁরা নবীন, তাঁরা যেন ভুলে না যাই যে সবাইকে একদিন বৃদ্ধ হতে হবে। অনেক দেশেই প্রবীণরা অবহেলিত, উপেক্ষিত। সমাজ ও পরিবারের অনেকের কাছে বোঝাস্বরূপও। মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা পরিবারেরই অংশ। তাদের যেন নিঃসঙ্গ অনুভব না হয়। তাই তাদের সঙ্গে নিয়মিত যত্নশীল হয়ে কথা বলতে হবে, গল্প করতে হবে।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ নভেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়