ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

‘বাবাকে ফেলে না পালালে, বাবা বেঁচে যেতেন’

সাইফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৯, ২ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বাবাকে ফেলে না পালালে, বাবা বেঁচে যেতেন’

সাইফুল ইসলাম: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দশম শ্রেণীর ছাত্র মো. আব্দুল হাই শেখ। বয়স মাত্র ১৪ বছর। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গেলে নেতারা বলেন, না, ও এখনো কৈশোর পার হয়নি, পারবে না। আবার মা-বাবা ভয় দেখান, পাক-আর্মিরা তরুণ ছেলেদের দেখলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলছে, সাবধানে থাকিস। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটু বেশিই সাবধানে থাকতে হয়েছে আব্দুল হাই শেখকে।

সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল গ্রামের শহীদ সেকেন্দার শেখের ছেলে আব্দুল হাই শেখ (৬৪)। নিজে কৃষিকাজের পাশাপাশি ছোটখাট ব্যবসা করেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। কিন্তু ছেলে সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। ফলে দায়িত্বটা একটু বেশি। তাদের বাড়ি এমনিতেই প্রত্যন্ত গ্রামে, কিন্তু তারপরও মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আরো দূরগ্রাম ধুকুরিয়া ভদ্রঘাটে এক খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাদের। কিন্তু অন্যের বাড়িতে আর ক’দিন থাকা যায়? মাসখানেক পরেই ফিরে আসেন নিজেদের বাড়িতে। কখনো অন্য বাড়িতে, কখনো বন্ধু-বান্ধবেরা মিলে ফসলের মাঠে, আবার কখনো নিজেদের বাড়িতেই সারারাত জেগে থাকতেন।

সেপ্টেম্বর মাসের কোনও এক ভোর রাত। বাড়িতে রোজা রাখার আয়োজন চলছে। চৌকিদার জ্যোতিন্দ্রনাথ গ্রামের ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আর চিৎকার করে বলতে থাকেন, রাজাকারদের নিয়ে গ্রামে এসেছে পাকিস্তানি মিলিটারি। সাবধান! চৌকিদারের চিৎকার শুনে আব্দুল হাই শেখ বাবাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন। বাবা পাশের এক পাট ক্ষেতে লুকিয়ে পড়েন। কিন্তু তরুণদের আটকের ভীতি তাকে তাড়া করে। তিনি দৌড়াতে দৌড়াতে চলে যান পাশের গ্রামে। কিছুক্ষণ পর বাবা পাটক্ষেত থেকে বের হয়ে এলে তাকে আটক করে সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। আত্মীয়-স্বজন শহরের শান্তি কমিটির নেতাদের কাছে গেছেন, এ সময় তার ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হতো, কিন্তু আব্দুল হাই শেখ শহরে যাওয়ার সাহস পাননি বয়সের কারণে। বিভিন্ন সূত্র থেকে আব্দুল হাই শেখের পরিবারের সবাই জানতে পারেন, তার বাবাকে সিরাজগঞ্জ শহরের পুরনো জেলখানার সামনে বধ্যভূমিতে হত্যা করে যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হ্য়েছে। এ খবর যখন নিশ্চিত হয় বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে আসে। ছেলে সন্তান হিসেবে ওই বয়সেই তার ওপরে বাড়ির সকল দায়িত্ব চেপে বসে। বাবার মৃত্যু, মুক্তিযুদ্ধ, সংসারের অভাব দিশেহারা করে ফেলে তাকে।

বাবার মৃত্যুর পর একটি বাকীর খাতা আব্দুল হাই শেখের হাতে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে কে দেবে টাকা? সবারই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। হঠাৎ একদিন সকালে তাদের বাড়িতে আসে পাইকশার দেরাজ মিয়া। তিনি দেনাদার। টাকা দিতেই এসেছেন।  যুদ্ধের মধ্যে টাকাগুলো হাতে পেয়ে কিশোর বয়সেও ঘুরে দাঁড়াবার সাহস পান আব্দুল হাই শেখ। টাকাগুলো নিয়ে বাবার মতোই ব্যবসা করতে শুরু করেন। যান কালীঞ্জার কোলে, ধান কেনেন, বাড়িতে এনে মা-বোনদের সহযোগিতায় সিদ্ধ করেন। বিক্রি করেন হাটে, বাড়িতে। এভাবে বাবার অনুপস্থিতিতে চলতে থাকে তাদের সংসার।

ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর চাপে পালাতে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ১৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শহর। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। সেদিন বারবার মনে পড়ে শহীদ বাবার কথা। আজ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন তিনিও খুব খুশি হতেন। নিজেকে দোষারোপ করতে ইচ্ছে করে যে, সেদিন যদি বাবাকে ফেলে নিজে না পালাতেন, তাহলে হয়তো বাবাকে বাঁচাতে পারতেন।

না, বাবার রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশ নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। তাই আজকের বিজয় দিবস তার কাছে আনন্দদায়ক মনে হয় না। নিজের বেকার ছেলের চাকরি হয় না। অনেকে বলেন অর্থ দিলে চাকরি হবে, এটা তিনি মানতে পারেন না। তবুও বিজয় দিবসে এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন যে, এতো রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে যে দেশ তা একদিন ঘুরে দাঁড়াবেই।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়