ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সাগরের বুকে আবারও জেগেছে সম্ভাবনাময় ‘চর বিজয়’

মহিউদ্দিন অপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাগরের বুকে আবারও জেগেছে সম্ভাবনাময় ‘চর বিজয়’

মহিউদ্দিন অপু : ‘চর বিজয়’ কিংবা ‘হাইরের চর’ হলো বঙ্গোপসাগরের বুকে এক অনন্য ভুবন। যার চারদিকজুড়ে ঢেউয়ের খেলা। রয়েছে অথৈ জলরাশি। সূর্যের আলোতে চিকচিক করে চরটি। সকাল থেকে সন্ধ্যা চেনা-অচেনা হরেক রকম পাখির কলতানে মুখরিত এই অবাধ বিচরণস্থান চরটির বালিয়াড়িতে শিউলি বকুলের মতো বিছিয়ে থাকে অগণিত লাল কাঁকড়া। নয়নাভিরাম নীল দিগন্তবিস্তৃত অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানিতে এ যেন ভিন্ন এক বাংলাদেশ।

দেশের অন্যতম সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার গঙ্গামতী হতে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গভীর সাগরে জেগে আছে মনোমুগ্ধকর দ্বীপ চর বিজয়। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে টুরিস্ট বোট নিয়ে মাত্র দেড় ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় দ্বীপটিতে। ২০১৭ সালে ভ্রমণপিপাসুদের একটি দল এই দ্বীপের সন্ধান পায়। বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা জেলেদের মুখে বিবরণ শুনে ভ্রমণপিপাসু দলটি (৫ ডিসেম্বর ২০১৭) দ্বীপটিতে যায়। এর আগেই জেলেরা স্থানীয়ভাবে দ্বীপটির নামকরণ করেন ‘হাইরের চর’। জেলেদের ভাষায় ‘হাইর’ হলো মাছ ধরার নির্ধারিত সীমানা। চরে পৌছে ভ্রমণপিপাসু দলটি দ্বীপটির নাম দেয় ‘চর বিজয়’। বিজয়ের মাসে চরটি আবিষ্কার হয় বলেই চর শব্দের সঙ্গে বিজয় শব্দটি যুক্ত করে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তারা।

 



স্থানীয় জেলেরা জানান, বর্ষা মৌসুমের ছয় মাস পুরো চর বিজয় দ্বীপটি সাগরের জলরাশির নিচে হাটু পরিমাণ ঢাকা থাকলেও শীত মৌসুমে উঁকি দেয়। প্রান্তিক জেলেরা তখন মাছ ধরতে সাগরে যায় ও মাঝেমাঝে দ্বীপেই অবস্থান করে। এছাড়াও চরে ছোট ছোট ডেরা তৈরি করে মাছ শিকার ও শুঁটকি করার জন্য দুই তিন মাসও চরে থাকেন জেলেরা।

জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে ভ্রমণপিপাসু পর্যটক দলের দেয়া নামকেই আনুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী চরটির স্থায়ীত্বের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশও প্রদান করেন। তাই দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে চরটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে ও নিরাপদ ভ্রমণের সম্ভাব্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালে পটুয়াখালী জেলা প্রশাসন, কুয়াকাটা পৌর প্রশাসন, বন বিভাগ, টুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, হোটেল মালিক সমিতি, পর্যটন ব্যবসায়ীরাসহ বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন চরটি পরিদর্শন করে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান সৃজনের জন্য প্রায় ২ হাজার গোল, ছইলা, কেওড়া ও সুন্দরী গাছের চারা রোপণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা ও সাইনবোর্ড টানিয়ে চরের নামকরণ করে ‘চর বিজয়’।

সম্ভাবনাময় এই চরটি ইতোমধ্যে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়েছে। দ্বীপটি পূর্ব-পশ্চিম দিকে লম্বা। দৈর্ঘ্যে প্রায় ১০ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৩ কিলোমিটার হলেও জোয়ারের সময় এর দৈর্ঘ্যে ৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ১ কিলোমিটার হয়। শীত মৌসুমে ধু ধু বালু নিয়ে জেগে ওঠা চর বিজয়ে মানুষের খুব একটা বিচরণ নেই বলে শীত মৌসুমে চরে সমাগম ঘটে কয়েক লাখ অতিথি পাখির। শীত কমে আসলে অতিথি পাখিগুলো আবার যে যার মতো অন্যত্র চলেও যায়।

 



চর বিজয় ঘুরে এসে ঢাকার সাইদুল ইসলাম বলেন, নভেম্বরে আমরা ৬ জনের একটি দল চর বিজয়ে যাই। সেখানে অনেক আনন্দ করি। জেলেদের জাল দিয়ে চরে মাছশিকার ছিল বেশি আনন্দময়। বরিশাল সদর থেকে এসে চর বিজয় ঘুরে পর্যটক হাসান, মিম, ও রাইয়ান বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের বুকে মানব বসতিহীন ছোট্ট একটি দ্বীপ এই চর বিজয়। সেখানে তাবুতে রাত্রিযাপন, ভয়ংকর ঢেউ এর শব্দ, অগণিত অতিথি পাখির কিচির মিচির ও লাল কাঁকড়াদের বর্ণিল আলপনা মাঝেমাঝে গা ছমছম করা এক ভৌতিক পরিবেশ বলে মনে হলেও সব মিলিয়ে চর বিজয় সত্যি অসাধারণ। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময় চরটিতে অপরূপ দৃশ্যের দেখা মিললেও সেখানে রাত্রিযাপন করা সাহসী আর অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্যই প্রযোজ্য হবে বলেও জানান তারা।

স্থানীয় আন্ধার মানিক ট্যুরিজমের কেএম বাচ্চু বলেন, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮ বিজয়ের মাসে কুয়াকাটা ট্যুরিজম, আন্ধার মানিক ট্যুরিজম, দিগন্ত ট্যুরিজম ও উদয় অস্ত ট্যুরিজম যৌথ ভাবে বিজয় ভ্রমণের আয়োজন করে। যেখানে মাত্র ৭০০ টাকায় কুয়াকাটা বিচ হতে ট্যুরিস্ট বোটে করে চরে যাওয়া-আসা, সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তিনি আরো বলেন, চরের চারদিকে সাগরের অথৈই পানি। চরে নেমে হারিয়ে যাই কিছু সময়ের জন্য। লাল কাঁকড়া আর অতিথি পাখির অবাধ বিচরণের প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্য শুধু আমাকেই নয়, এখানে যেই আসুক ভালো লাগবে, মুগ্ধ হবে।

চর বিজয়ের নামকরণকারীদের একজন, ডেইলি স্টার পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, কুয়াকাটার সমুদ্র মাঝে জেগে উঠা চর বিজয়ে এই প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান করেছে চরবিজয় সোসাইটি পরিষদ। ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর, চর আবিষ্কারের আমরা সেই ১৩ জনই হলাম সোসাইটি পরিষদ। খলিলুর রহমান, মাঈনুল ইসলাম মান্নান, হোসাইন আমির, জনি আলমগীর, বাউল রেজাউল করিম শাহ, সাইদুর রহমান শাহিন, আক্তার হোসাইন, সিমা আক্তার, ইতালী প্রবাসী মামুন সিকদার, আরিফুর রহমান, বোটম্যান রানা, পিচ্চি জাহিদুল। তিনি আরো বলেন, চর বিজয়ের চারদিকে রয়েছে পানি। সমুদ্রের বুক চিরে ভেসে উঠা সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত, অগণিত অতিথি পাখি, লাল কাঁকড়া অভূতপূর্ব। সমুদ্রের সঙ্গে জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকা জেলেদের সঙ্গে চরের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন এ যেন ভিন্ন এক জগৎ।

 



চর বিজয় সোসাইটির একজন, কুয়াকাটার হোসাইন আমির। তিনি বলেন, প্রকৃতির এই চর বিজয়ের অনুভূতির ছোয়া পেতে আমরা চর বিজয়ের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সাজিয়েছিলাম ভিন্নরকম অনুষ্ঠান। বিকেল বেলা ঘুড়ি উৎসব, সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত উপভোগ, রাতে লোকসংগীত, বারবিকিউ পার্টি ও হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য সোহরাব-রুস্তম জারিগান। যা উপভোগ করে জীবনের স্মৃতির পাতায় স্মরণ রাখবে উপস্থিত সবাই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়