ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মোশাররফ ভাই চলে গেলেন!

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৬, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মোশাররফ ভাই চলে গেলেন!

মোশাররফ হোসেন ভূঁঞা

শিহাব শাহরিয়ার: মৃত্যু অবধারিত। তারপরও কিছু মৃত্যু বড় বেদনাহত করে। মন মেনে নিতে চায় না। বারবার মনে হয়, কেন এই অসময়ে প্রস্থান! খুব খারাপ লাগে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। তারপর একসময় ভারাক্রান্ত হতে হতে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মৃত্যু মেনে নিতে নিতে মনে মনে চলে প্রার্থনা- হে প্রভু, তুমি তাকে পরপারে ভালো রেখ। তার বিদেহী আত্মা যেন শান্তি পায়।

এমন প্রার্থনার মধ্যে দিয়েই আজ স্মরণ করতে হচ্ছে মোশাররফ ভাইয়ের চলে যাওয়া। বিভিন্ন অভিধায় তাকে স্মরণ করা যায়। পেশাজীবনে তিনি সর্বশেষ সিআইডি’র ডিআইজি ছিলেন। কিন্তু আমরা তাকে ওই পরিচয়ে চিনতাম না। আমরা তাকে জানতাম কবি, কথাশিল্পী, ছড়াকার, গবেষক হিসেবে। তিনি দীর্ঘদিন ‘ডিটেকটিভ’ পত্রিকার  সম্পাদক ছিলেন। আমি জানি না এ বিষয়ে আর কোনো পত্রিকা এই শহরে প্রকাশিত হয় কিনা? আধুনিক ও পরোপকারী এই মানুষটি হঠাৎ করেই চলে গেলেন। তার এই অকাল প্রস্থান মেনে নেয়া সত্যি কঠিন শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য।

মোশাররফ হোসেন ভূঁঞার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘ দিনের। আমার সম্পাদিত ‘বৈঠা’র প্রত্যেক সংখ্যা এবং আমার প্রকাশিত প্রায় সব বই তিনি কিনেছেন, পড়েছেন; উপহারও দিয়েছি। তার সমস্ত বই-ই প্রায় আমাকে উপহার দিয়েছেন। বন্ধুসুলভ মানুষটি আমার জীবনে অনেক উপকারেও এসেছেন। তার সম্পাদিত ‘ডিটেকটিভ’ পত্রিকার জন্য প্রতি সংখ্যায় হয় কবিতা অথবা প্রবন্ধ নিয়ে ছেপেছেন। এখানেই শেষ নয়। তার অধীনস্তদের মাধ্যমে সংখ্যা ও লেখক সম্মানী পাঠিয়ে দিয়েছেন। বহু ক্রিকেট খেলার ভিআইপি টিকিট পাঠিয়েছেন। বলতেন, শিহাব ভাই চলে আসুন আমার অফিসে, আড্ডা দিই। গিয়েছি। দুপুরে ভাত খেয়েছি, কফি পান করেছি, আর নানা বিষয়ে আড্ডা দিয়েছি। বিশেষ করে সাহিত্য। আড্ডায় কখনো কথাশিল্পী হামিদ কায়সার, মনি হায়দার, মাহবুব রেজা প্রমুখ যুক্ত হয়েছেন। বিশেষ করে ‘ডিটেকটিভ’-এ যারা নিয়মিত লিখতেন, সেই সব লেখকদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন। সেই আড্ডা কথনো মালিবাগের এসবি অফিসে, কখনো বেইলি রোডের সিটি এসবি অফিসে, কখনো বা তার বেইলি রোডের বাসায়।

গাজীপুরের সন্তান মোশাররফ ভাই। জন্ম ১৯৬০ সালে। একদিন নিজের স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, আমার বাবা ছিলেন আদর্শ কৃষক। আমরা সকাল বেলা বাবার সঙ্গে ক্ষেতে যেতাম, হালচাষ করাতাম, স্কুলের সময় হলে দৌড় দিতাম, বাড়িতে এসে গোসল করে ধপাধপ নাস্তা খেয়ে স্কুলে যেতাম। পরিশ্রমী এই কিশোর ভালো ফল করে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। সেখান থেকে মাস্টার্স করে যোগ দেন পুলিশে। সেটি ১৯৮৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির কথা। সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বিসিএস (পুলিশ) সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি দীর্ঘ কর্মজীবনে সাতক্ষীরা, খুলনা ও মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ডিআইজি হিসেবে তিনি বরিশাল ও সিলেট রেঞ্জ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সিটিএসবিতে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও তার কর্মদক্ষতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

সাহিত্যানুরাগী মোশাররফ অর্ধ যুগেরও বেশি সময় বাংলাদেশ পুলিশের প্রকাশনা ‘ডিটেকটিভ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে রয়েছে তার অনন্য অবদান। তার প্রকাশিত ৪০টি গ্রন্থের মধ্যে ২৫টি কাব্যগ্রন্থ, ৩টি উপন্যাস, ৯টি শিশুতোষ গ্রন্থ ও ৩টি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রয়েছে। ‘অমৃতের সন্তান’ তার মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস। তার রচিত বেশ কয়েকটি গ্রন্থ আমি পত্র-পত্রিকায় আলোচনা করেছি। তার লেখার একটা নিজস্ব ধরন ছিল। গাজীপুরের আঞ্চলিক ভাষায় উপন্যাসগুলো লেখা। কবিতা, ছড়া, উপন্যাস লেখার পাশাপাশি তিনি অসাধারণ একটি গবেষণা করছিলেন। সেটি হলো ‘ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান’।

এই বিষয়ে আমি আমার কর্ম-প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে একটি সেমিনারের আয়োজন করতে চেয়েছিলাম।  তিনি খুশি হয়েছিলেন। সভাপতি ও আলোচক এবং তারিখও নির্দিষ্ট করেছিলাম। কিন্তু তিনি জানালেন, শিহাব ভাই, আমাকে আর কয়েকটি দিন সময় দেন। সময় আর কীভাবে দেব! আর কি সম্ভব? চিরতরেই যে গেলেন...

আহা! মোশাররফ ভাই, মধ্যরাতে আর কে ফোন করবে আমাকে আপনার মতো? ফোন করে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন, তারপর লেখালেখি নিয়ে বলতেন দীর্ঘ সময়। বলতেন, শিহাব ভাই, আপনার কবিতা আমার দারুণ ভালো লাগে। আপনার কবিতায় জীবনানন্দের স্বাদ পাই।  মোশাররফ ভাই, আপনি রুচিশীল মানুষ ছিলেন। ছিলেন বন্ধুবৎসল, ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, আড্ডা-আমুদে, ছিলেন সহজ-সুন্দর, ছিলেন মানব-দরদী, ছিলেন কঠিনরোগ বহনকারী গোপন এক মানুষ। বলতেন, শিহাব ভাই, আমার ভিতরে একটি শক্ত রোগ বাসা বেঁধে আছে, যা আপনাকে বলতে পারবো না। যখন বললেন, তখন যা হবার হয়ে গেছে।

বেশ কিছুদিন সময়ের অভাবে কথা হচ্ছিল না। হঠাৎ মাসখানেক আগে এক রাতে ভারতীয় নম্বরে আমার সেল ফোনে কল এলো। রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে মোশাররফ ভাই সালাম দিয়ে বললেন, শিহাব ভাই, আমি মোশাররফ, চেন্নাই থেকে। কাউকে বলবেন না, আমি আজ প্রথম কেমো দিতে যাচ্ছি, আমার ক্যানসার, দোয়া করবেন। আমি থ মেরে গেলাম! উত্তর দিতে পারছি না! ক্যানসার! কেমো! আমার ছোটভাবী মাত্র কয়েকদিন আগে মাত্র ৪০ বছর বয়সে অকালে মৃত্যুবরণ করলেন। সেই মরণব্যাধি মোশাররফ ভাইয়ের? আহা! বললাম দোয়া করছি, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সুস্থ করে তুলুন। এই-ই শেষ কথা। আর কথা হলো না। দেখা হলো না। আর আড্ডা হবে না। সাহিত্য নিয়ে বলা হবে না কোনো কথা। মোশাররফ ভাই আপনিও চলে গেলেন? আমার যে আর ভালো লাগে না। মৃত্যু এক এক করে নিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। আর আমার বাড়ছে বুকের ব্যথা, হাহাকার...

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়