ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্যই পড়তে চাই’

খালেদ সাইফুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩২, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার জন্যই পড়তে চাই’

খালেদ সাইফুল্লাহ : বই মনের অন্ধকার দূর করে, সমৃদ্ধ করে জ্ঞানের ভান্ডার। ‘যে বই পড়ে না, তার মধ্যে মর্যাদাবোধ জন্মে না।’ ‘বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলিয়া হয় না।’ মনীষীদের এমন অসংখ্য উক্তি আছে বই পড়া নিয়ে। আত্মার পরিতৃপ্তি, মনুষ্যত্ব এবং মর্যাদার উন্নতির জন্য বই পড়ার গুরুত্ব অপরিহার্য।

তবুও আজকাল বই পড়া, সাহিত্য পড়া মানুষের বড়ই অভাব সংসারে। প্রযুক্তি আর সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে যদিও মুহূর্তেই অসংখ্য বই চলে আসে হাতের নাগালে, তবুও বইয়ের প্রতি মানুষের আসক্তি দিন দিন কমেই চলেছে। বই পড়ার এমন ক্রান্তিলগ্নে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময়ে যদি আপনি রাস্তার ধারে বসে কাউকে প্রতিদিন বই পড়তে দেখেন, তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে?

রাজধানীর শাহবাগ থেকে জাতীয় জাদুঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় গণগ্রন্থাগারের ফটকের পাশেই একজন লোককে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়তে। এ পথ দিয়ে যারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করে প্রায়ই তারা ওই ব্যক্তিকে বই হাতে পড়তে দেখে। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি ছুটে যায় তার দিকে। কারণ, কখনো কখনো তাকে দেখা যায় জুতা পালিশ করতে আবার কখনো তার হাতে বই।

কথা বলে জানা যায়, তার নাম শিমুল। বংশীয় পদবী সহ শিমুল ঝষি। বছরখানেকের বেশি হলো শিমুল এখানে জুতা সেলাই-পালিশের কাজ করছে। অর্থাৎ পেশায় একজন মুচি। গত এক বছরে এখানে বসে পড়ে শেষ করেছে ১০টি বই। যার মধ্যে রয়েছে ডা. মো. লুৎফর রহমানের উন্নত জীবন, মাইকেল এইচ হার্টের বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষীর জীবনী এবং সোনালী দুঃখ প্রভৃতি বই।

শিমুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউক গ্রামে। তিন ভাইবোনের সংসারে সবার ছোট শিমুল। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ তার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পেয়েছে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। ফান্দাউক ঝষিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর সংসারে টানাপোড়েনের কারণে তার আর পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারে বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর বড় ভাই সংসারের বোঝা টানতে রাজি না হওয়ায় সেই দায়িত্ব শিমুলকেই কাঁধে নিতে হয়। তারপরই পড়াশোনা স্থবির হয়ে যায় তার।

পড়াশোনা ছেড়ে শিমুল চলে যায় শায়েস্তাগঞ্জ। সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করে জুতার কারখানায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিমুল সেখানকার স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু নিয়মিত ক্লাস করতে না পারায় তাকে আর সুযোগ দেওয়া হয়না। তবে এতে দমে যায় না সে। তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। স্কুলে পড়াশোনা করতে না পারলেও কাজ শেষে প্রতিরাতে বইগুলো পড়ে ফেলে। এছাড়াও কাজের ফাঁকে শুধু দেখে দেখেই সেলাই-পালিশের কাজ শিখে নেয় সে।

সাত বছর যাবত জুতার কারখানায় কাজ করার পর নতুন করে কাজ শুরু করে আরএফএলের প্লাস্টিক কারখানায়। সেখানে দু’বছর কাজ করে সে। সেখানে কাজ করার সময়ও বিভিন্ন জায়গাতে যোগাযোগ করে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ তাকে সহায়তা না করায় সে যাত্রায় তাকে দমে যেতে হয়। তবে ঢাকা শহরে কোথাও না কোথাও এমন সুযোগ পাবে ভেবে শিমুল পাড়ি জমায় ঢাকাতে। ঢাকায় এসে শিমুল শুরু করে মুচির কাজ। তবে তার পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব কাউকে তার পেশা পরিবর্তনের কথা জানতে দেয়নি। খিঁলগাওতে প্রায় এক বছর কাজ করার পর চলে আসে শাহবাগ। জাদুঘরের সামনে একটি বইয়ের স্টলের পাশেই সে বসে যায় কাজ করার সরঞ্জামাদি নিয়ে। একইসঙ্গে চলে কাজ করা আর বই পড়া। যখনই কাজ শেষ হয়, শুরু করে বই পড়া।

শিমুলের ভাষ্যমতে, ‘বই কিনে পড়তে পারবো না তাই বইয়ের স্টলের পাশেই কাজ করি। যখনই সময় পাই বই খুলে বসে যাই। এভাবে ১০টি বই শেষ করেছি। কিন্তু কাজের চাপ থাকলে তখন আর বই পড়া হয় না।’ আবার বই হাতে থাকলে অনেক সময় কাজ হাতছাড়া হয়ে যায় বলেও জানায় সে।

শিমুল জানায়, ঢাকায় আসার পর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে কয়েকবার ব্যর্থ হয় সে। তবে কিছুদিন আগে আবার যোগাযোগ করে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিছুদিন বাদেই শিমুল নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে কাজের পাশাপাশি তার পড়াশোনাও চালিয়ে যাবে।

শিমুলের পড়াশোনার প্রতি এই প্রবল আগ্রহের কারণ ব্যক্ত করতে গিয়ে সে বলে, ‘বড় চাকরি করার ইচ্ছায় নয়, শুধু নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করবো বলেই পড়তে চাই।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়