ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

১৫ হাত মানুষের ১৮ হাত কবর

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
১৫ হাত মানুষের ১৮ হাত কবর

খায়রুল বাশার আশিক : বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে বিস্ময়কর, ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় অনেক কিছু। তেমনি একটি বিস্ময়কর কবর রয়েছে বরিশালের মাটিতে। এই কবরের বর্তমান নাম ‘১৮ হাত কবর’। মরহুম জংশের পাইক নামক ১৫ হাত লম্বাদেহের একজন মানুষের করব এটি। কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে জংশের পাইকের এই কবর। কবরটি ঘিরে পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে নানা কথা।

১৮ হাত দীর্ঘ কোনো জমিতে একাধিক কবর দেয়ার জায়গা হলেও এখানে মূলত আছে একজন মানুষের কবর। ১৫ হাত লম্বা মানুষটির কবরের জায়গা লেগেছে ১৬-১৭ হাত, প্রাচীরসহ এই কবরের দৈর্ঘ্য ১৮ হাত। বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউনিয়নের যবসেন গ্রামের পাইক বাড়িতে রয়েছে এই কবর। কবরটিকে একনজর দেখতে দূর থেকে প্রতিদিন অনেকেই আসেন এই বাড়িতে।

সরেজমিন ঘুরে এলাকার একাধিক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আলোচ্য কবরবাসীর নাম ছিল জংশের। ব্রিটিশ আমলে তিনি ভারত মহাদেশের উত্তর অঞ্চলের খাপুরায় বাস করতেন। তরুণ বয়সে এই জংশের বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী হয়ে ওঠেন। এসময় তিনি দস্যুদলের একজন দক্ষ ডাকাতে পরিণত হন। একসময় এই জংশের ৭টি খুন করার পর ভালো হয়ে যাবার প্রত্যাশায় কিংবা পালিয়ে বাঁচতে পূর্ববাংলার একটি দক্ষিণের জলবেষ্টিত চর (আনুমানিক বর্তমান ভোলা) অঞ্চলে এসে আশ্রয় নেন। দূরবর্তী ডাকাতি করার সুবাদে তার কাছে এসব অঞ্চল বেশ পরিচিত ছিল। জংশের ডাকাতের পেশীশক্তি, সাহসিকতা ও দেহকাঠামোর কথা জানতে পেরে এই অঞ্চলের তৎকালীন মোহন নামক পাঠান এক জমিদার জংশেরকে দেহরক্ষী নিয়োগ দেন। ভারত মহাদেশের উত্তর অঞ্চলে বসবাসরত এই জংশের  ছিলেন খান বংশের। এই পাঠান জমিদার জংশেরের নাম ঠিক রেখে বংশীয় উপাধি পরিবর্তন করেন। জমিদারের ইচ্ছায় ‘জংশের খা’ থেকে তার নাম হয় ‘জংশের পাইক’। জমিদারের দেয়া জমিতেই জংশের পাইক বসত শুরু করে। সেই থেকেই গোড়াপত্তন হয় বর্তমানের এই পাইক বাড়ি, যে বাড়ির ১৮ হাত একটি কবরে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। 

কবরটি ঠিক কত বছর আগের তা নিশ্চিত করে বলতে পারে না কেউ। তবে এ অঞ্চলের জমির খতিয়ান পর্চায় পাওয়া বংশীয় নামের ক্রমধারার হিসেব অনুযায়ী, আনুমানিক ব্রিটিশ আমলের মাঝামাঝি কোনো এক সময় জংশের পাইক মারা যায়। ব্যক্তিজীবনে জংশের পাইক ৫ ছেলে সন্তানের জনক ছিলেন। বাবার মতই ছেলেরাও অনেক লাম্বা ছিল। ৫ ছেলেদের ১ জন অবিবাহিত অবস্থায় মারা যায়। অন্য ৪ ছেলে গাজি পাইক, কুলিমাউন পাইক, মংগল পাইক, আসাদ্দি পাইকের মাধ্যমে বিস্তার ঘটে এই পাইক বংশ।

 



বর্তমান এই বংশধরদের মধ্যে সর্ব বয়োজ্যেষ্ঠদের একজন সুলতান হোসেন পাইক। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কবরসংশ্লিষ্ট খুঁটিনাটি অনেক কিছু। যা শুনলে আধুনিক সমাজের অনেকের কাছেই শুধুই রূপকথার গল্প মনে হবে। সুলতান হোসেন পাইকের দেয়া তথ্যমতে, একদা এই কবরের সীমানা প্রাচীর ছিল চুন-সুরকির নির্মিত, যার দৈর্ঘ ছিল ১২-১৩ হাত। ঠিক তখন করমআলি পাইক নামক পাইক বংশের এক কর্ণধার স্বপ্নে দেখতে পান, কবর থেকে মৃত জংশের পাইক তাকে ডেকে বলছেন- কবরের সীমানা লাশের ঠিক সিনার ওপর দিয়ে করা হয়েছে। ফলে কবরে জংশের পাইকের কষ্ট হচ্ছে।

এমতাবস্থায় পাইক বংশের সকলকে এই স্বপ্নের কথা জানালে সবাই মিলে পুরাতন সেই সীমানা প্রাচীর ভেঙে নতুন করে করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন কবরের আকার বৃদ্ধি পেয়ে নির্ধারণ হয় ১৮ হাত। নতুন সীমানা প্রাচীর করার লক্ষে যখন পুরাতন প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয় ঠিক তখন মাটি খুড়তেই বেড়িয়ে আসে লাশের একটি হাড়। সুলতান হোসেন পাইকের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সেই হাড়টি পৌনে দুই হাত লম্বা ছিল। নতুন করে সেই বাঁধানো সীমানাটি করা হয় প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। সরেজমিন দেখা যায়, ১৮ হাত দীর্ঘ এই কবর স্থানটি এখন ইটের উপরে টাইলস বসিয়ে সুসজ্জিত করা হয়েছে।

সুলতান হোসেন পাইক আরো জানান, মরহুম জংশের পাইক অনেক শক্তিশালী ছিলেন। প্রতিদিন তার আহার ছিল পাঁচ-ছয় কেজি চালের ভাত। আনুমানিক শত বছরের কোঠায় কোনো এক দুরারোগ্য রোগে তিনি মারা গিয়েছিলেন। এলাকাবাসী ও পাইক বংশীয় সকলের কাছে এমন তথ্য ও গল্প শোনা গেলেও এর ভীত কতটা শক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে গ্রামের শিক্ষিত তরুণসমাজ কিংবা দূরবর্তী আগত অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মানবদেহ ১৫ হাত লম্বা হওয়া কি সম্ভব?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ ডিসেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়