ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জলে ভাসা বিপন্ন শৈশব (শেষ পর্ব)

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৫, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জলে ভাসা বিপন্ন শৈশব (শেষ পর্ব)

জুনাইদ আল হাবিব : লক্ষ্মীপুরের কমলগরের মেঘনা পাড়ের মতিরহাট মেঘনা পাড়ে সারি সারি নৌকা। তবে এই নৌকাগুলো দেখলে যে কেউ বুঝবেন এগুলো স্থানীয় কোনো জেলেদের নৌকা নয়। এসব নৌকায় কিছু মানুষের ঘর-বাড়ি। এখানেই বেড়ে ওঠেছে জীবন, বারেক, স্বপন, দ্বীন ইসলাম, পারভেজ, তানিয়া, বৈশাখী, মিথিলা, রোশেনা, জহুরা, মোহাম্মদ, সুন্দরীর মতো সুন্দর সুন্দর নামের শিশুরা। এদের সবার বয়স পাঁচ থেকে সাত বা আটের কোঠায়। এদের কেউ নৌকায় মায়ের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত, কেউবা নদীর পাড়ে গিয়ে খেলায় ব্যস্ত। ওরা কেউ স্কুলে যায় না। যাবেই-বা কী করে? ভাসমান জেলে পরিবারের হওয়ায় ঠিকানাহীন জীবন ওদের। 



ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার মধ্যেও এসব শিশুরা নদীর মোহনায় থাকে। ঘূর্ণিঝড় আসলে সৃষ্টিকর্তার ওপরই একমাত্র ভরসা। সব সময় নদীর উত্তাল মোহনায় বেশ ঝুঁকির মধ্যেই এসব শিশুরা বেড়ে ওঠে। অবহেলার মধ্যে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুরন্ত শৈশব কাটছে ওদের।

লক্ষ্মীপুরের কমলগরের মেঘনা পাড়ের মতিরহাট মেঘনা সৈকত দিয়ে হাঁটছি। পথিমধ্যেই চোখে পড়ে এক ঝাঁক শিশু। যারা খেলছে। সামনে এগোতেই তাদের জীবন প্রত্যক্ষ করলাম। অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা ওদের জীবন। সবার শরীরে যেন প্রকাশ করে তারা ভিন্ন জাতের মানুষ। সবাই তাদের চেনে মানতা জনগোষ্ঠী হিসেবে। ঠিকানাহীন এ শিশুরা কিছুক্ষণের জন্য খেলছে। কারো সঙ্গে কারোর অতটা সম্পর্ক নেই। ভাসমান জেলে পরিবার আসে একেক জায়গা থেকে। আবার চলে যায়। ওদের পিতা-মাতা মাছ ধরায় ব্যস্ত সময় পার করে। মাছ না ধরতে পারলে দুমুঠো ভাত পেটে জুটবে না, তাইতো অনেক শিশু মাছ ধরে বাবা-মায়ের সঙ্গে।



সাম্প্রতি কনকনে শীতে এসব ভাসমান জেলে পরিবারের শিশুরা বেশ দুঃসহ জীবন পার করেছে। শীত নিবারণের জন্য হয়তো শিশুর মা চুলাতে একটু আগুন জ্বালায়েছে। এভাবেই অনেক ভাসমান পরিবার শিশুদের শীত নিবারণের জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করলেও তা স্থায়ী কোনো কাজে আসেনি। শীতে বিভিন্ন সংস্থা কিংবা সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হলেও এসব শিশুদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমনকি ঈদেও এসব শিশুরা থাকে চরম অবহেলায়।



এক পর্যায়ে গল্প হয় মানতা সম্প্রদায়ের শিশু আইনাল, রেশমা, লুলা, বৈশাখী, তানিয়াসহ অনেকের সঙ্গে। স্কুলে যাও? এমন প্রশ্ন করতে না করতেই তাদের সোজা উত্তর, ‘কী দিয়া পড়মু? টাহা নাই। আমরা স্কুলে যাইলে আমাগো পড়ার খরচ চালাইবো কে? খাইতে পারি না, আবার পড়মু।’

অভিভাবকদের কাছ থেকেও মিললো অনুরূপ বক্তব্য। তারা বলেন, ‘টিয়া-হইসা থাকলেতো আর গাঙ্গে এইভাবে মাছ ধরতাম না। জাগা-জমি বলতে আমাদের কিছু নাই। দেখেন, আমার কিভাবে থাকি। কেউ আমাদের খোঁজখবর নেয় না।’



সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করেন ডা. নাজমুল ইসলাম। যিনি অ আ ক খ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। দুর্গম জনপদে স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাঝে আলো ছড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেদে বা মানতা জনগোষ্ঠীর কোনো স্থায়ী ঠিকানা নেই। যার কারণে এদের জন্য কিছু করাটাও সম্ভব হয়ে ওঠেনা। সরকারি উদ্যোগে এদেরকে স্থায়ী বসবাসে পুনর্বাসন করা গেলে এরাও পিছিয়ে থাকবে না। ঠিকানা নেই বলে এদের জন্য কোনো পরিকল্পনাও হাতে নেয়া যায় না। তবে হ্যাঁ, সবার নজর পড়লে এসব শিশুরা দুরন্ত শৈশব পার করতে পারবে।’

পড়ুন :




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়