ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রক্তাক্ত তটরেখা

গ্রীষ্মের দুপুর এসেছিল শোক হয়ে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৯, ৬ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গ্রীষ্মের দুপুর এসেছিল শোক হয়ে

রফিকুল ইসলাম মন্টু: পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশ রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। মার্চে মুক্তিসংগ্রামে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারাদেশ। সবার প্রত্যয় ছিল একটাই- দেশকে শত্রুমুক্ত করা। যুবক-তরুণেরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই যুদ্ধে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর অবশেষে আসে মুক্তি। সারাদেশের ন্যায় মুক্তি সংগ্রামের সেই ঢেউ পৌঁছে গিয়েছিল উপকূলীয় জনপদের তটরেখা পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের সেইসব ঐতিহাসিক তথ্যবলী নিয়ে ধারবাহিকের এই পর্বে রয়েছে পটুয়াখালী জেলার কথা।

ঝলমলে রোদ। গ্রীষ্মের দুপুর। কর্মব্যস্ত মানুষের ঘরে ফেরার তাড়া। সেই দুপুরটি যে অন্যদিনের দুপুর থেকে আলাদা হবে কে জানতো? মধ্যাহ্নভোজের আগেই যে অনেকে স্বজনহারা হবেন, সে ধারণাও ছিল না কারও। অনেকেরই সেদিন দুপুরে আর খাওয়া হয়নি। স্পীডবোটে পাক সেনাদের আগমনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গ্রামবাসী। তাদের ওপর চলে নির্যাতন, নিপীড়ন। বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া হয় বুক। হেলিকপ্টারের শব্দ এখনও বয়সী মানুষের কানে আতঙ্ক হয়ে বাজে। সেদিন নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চলে অনেক স্থানে। ঘুঘু ডাকা ছায়াঘেরা গ্রাম আর পাকা সড়কের শহুরে জনপদে সেদিনের দুপুর এসেছিল শোক হয়ে।

এটি উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। জেলার বেশ কয়েকটি বধ্যভূমিতে ঘুমিয়ে আছেন হাজারো মুক্তিকামী মানুষ। বেঁচে থাকলে তারাও এই স্বাধীন ভূখণ্ডে কর্মচাঞ্চল্যের জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু ঘাতকেরা সে সুযোগ দেয়নি। জেলা প্রশাসকের বাংলোর বধ্যভূমি, মাতবর বাড়ির বধ্যভূমি, জেলখানার বধ্যভূমি, ইটবাড়িয়ার গণহত্যা, লাউকাঠি নদীর তীরের বধ্যভূমিসহ আরও কয়েকটি স্থানের গণকবর এবং অন্যান্য স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করছে। পাকিস্তানি ছত্রীসেনার কপ্টার শহরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। ঘাতক রাজাকারের দল বাঙালি নিধনে মেতে ওঠে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ২৬ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী পটুয়াখালী দখলে নেয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় চলতে থাকে অমানবিক হত্যাকাণ্ড। তবে এ যুদ্ধে জয়লাভ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। প্রতিরোধ, পাল্টা প্রতিরোধ আর সম্মুখ যুদ্ধে এক পর্যায়ে জেলা সদর ছাড়া অন্য সকল এলাকা দখলে নেন মুক্তিযোদ্ধারা। পরে সদরও তাদের দখলে আসে।

পটুয়াখালীর নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে মাতবরবাড়ি হত্যাকাণ্ড ছিল অত্যন্ত নির্মম। যতদূর জানা যায়, এটাই জেলার প্রথম হত্যাকাণ্ড। জেলা শহর থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মাতবরবাড়ি। ২৬ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি ছত্রীসেনা দলের হেলিকপ্টার ঘুরপাক খাচ্ছিল আকাশে। ফলে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মাতবর বাড়ির ১৯জন নারী-পুরুষ ও শিশু বাড়ির পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকসেনার নির্বিচার গুলির কারণে তাদের  প্রাণ রক্ষা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বলছিলেন ওই এলাকার বয়সী ব্যক্তি নূরুল ইসলাম মাতবর। তিনি বলেন, আমি শহরে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিলাম। ঘটনা শুনে আমি মাত্র শহরের নিউমার্কেট পর্যন্ত আসতে পেরেছি। এর মধ্যেই খবর পেলাম আমাদের বাড়ির প্রতিটি ঘরে আগুন জ্বলছে। পরে প্রাণ ভয়ে আমি অন্যদিকে আশ্রয়ের জন্য যাই। পাকসেনারা এলাকা ছেড়ে চলে যেতে যেতে লাশগুলো পঁচে যায়। সেই অবস্থায় সকলের লাশ মাটিচাপা দেয়া হয়।’ ওদিকে মাতবর বাড়ির ঘটনার পর ৮ মাসে পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় আরও অসংখ্য হত্যাকাণ্ড চালায় পাকসেনারা। এইসব হত্যাকাণ্ডের কিছু লাশ স্বজনদের কাছে দেয়া হলেও অনেক লাশ মাতবর বাড়ির ওই বধ্যভূমিতেই ফেলা হয়। বধ্যভূমিগুলো ইটের গাঁথুনি দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

পাকসেনাদের আগমনে সাধারণ নিরীহ মানুষ জীবন বাঁচাতে দ্বিগবিদিক ছুটতে শুরু করে। অনেকে পালাতে গিয়ে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। প্রাণ দেয় নির্মমভাবে। পাকসেনারা পটুয়াখালী সার্কিট হাউসে বসে পরিকল্পনা করতো। মুক্তিযোদ্ধা স্বপন ব্যানার্জী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সার্কিট হাউস ছাড়াও শহরের বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি ঘাঁটি ছিল পাক বাহিনীর। রাতে বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু নারীকে ধরে এনে হানাদারদের হাতে তুলে দেয়া হতো। পাক বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার ফলে শহরের অলিগলিতে লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এই লাশগুলো পুরাতন জেলখানার ভেতরে বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।’ তবে লাশের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেননি তিনি। মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নির্মল রক্ষিতের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এই সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি।  পটুয়াখালী শহরে ঘাতক হায়েনাদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নির্মল রক্ষিত বলেন, শহরের পুরাতন জেলখানা বর্তমানে আনসার ব্যাটালিয়ান দপ্তরে অবস্থান নিয়েছিল পাকবাহিনী। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় শত শত নারী-পুরুষ ও শিশুর ওপর নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, কোথাও বাঙালি পেলেই ধরে নিয়ে হত্যা করা হতো। এদের লাশ জেলখানার দক্ষিণ-পুব কোণে মাটিচাপা দেয়া হতো। পটুয়াখালী শহরের হত্যাকাণ্ডের বিবরণ রয়েছে বিভিন্ন ইতিহাস গবেষণায়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংগৃহীত তথ্যসূত্র বলছে, পটুয়াখালী জেলখানার গণকবরে প্রতিটিতে ৪-৫জন করে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে। কমপক্ষে ৫শ’ লোককে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয় বলে অনুমান করা হয়। এদের গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সময়কাল সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় দুপুর ২টা থেকে ৫টার মধ্যে হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছাড়াও অন্যান্য সূত্রের খবরে দাবি করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিল নাদের পারভেজ। পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধের মুখেও পড়েছে বারবার। মুক্তিযোদ্ধা আজাহার আলীর কথা থেকে জানা যায়, পাকবাহিনী প্রথম প্রতিরোধ করতে গিয়ে সেদিন পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের বাংলোর দক্ষিণ পাশে শহীদ হন ৭ আনসার সদস্য। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের বাসভবনের দক্ষিণ পাশের গণকবরে দাফন করা হয় তাদের।

বোশেখের ভর দুপুরে স্পীডবোট ভিড়েছিল কচাবুনিয়া ঘাটে। কে জানতো, সেই দুপুরটাই শোকগাঁথা হয়ে থাকবে ইটবাড়িয়া গ্রামের মানুষের কাছে? স্পীডবোট নোঙর করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘাতকের দল ছুটে যায় গ্রামের দিকে। পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। কোনো প্রতিরোধের সুযোগ পায়নি এলাকাবাসী। সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রশিদ গাজী। চোখের সামনে নিজের ভগ্নিপতিকে গুলি করে মেরে ফেলার সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে হয়েছিল তাকে। রশিদ বলছিলেন, স্পীডবোট ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করতে করতে তারা গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আমি আর আমার বোনের জামাতা ডা. আশ্রাফ মসজিদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি আশ্রাফকে অভয় দিয়ে বলি- আমার কাছে দাঁড়াও, কিছুই হবে না। ওর হাতে ছিল কুরআন শরীফ। পাক বাহিনী সেখানে আসে। আশ্রাফের হাত থেকে কুরআন শরীফ আমার হাতে দিয়ে মসজিদের সামনেই তাকে গুলি করে। আশ্রাফের দেহ তখন ৭-৮ ফুট উঁচুতে উঠে যায়। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর আমি কাছে গিয়ে কোলে নিতে নিতে তার প্রাণ প্রায় শেষ। আমাকে শুধু বলে গেল- ভাইয়া আমার ছেলেমেয়েদের দেখে রাখবেন। শুধু আশ্রাফ নন, সেদিন পাক হায়েনাদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এই গ্রামের আরও অনেকে। সংখ্যা প্রায় ৩০জন, জানালেন রশিদ।

একাত্তরের সেই শোকগাঁথা ইটবাড়িয়া গ্রামের নারীদের কাঁদায় আজও। ঘাতকেরা এই গ্রামের মানুষকে গুলি করে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। নারীদের ওপর চালিয়েছে নির্যাতন। পাকসেনার হাতে বর্বরতার শিকার গ্রামের সেই নারীরা এখন আর এই বিষয়ে ক্ষোভে দুঃখে কথা বলতে চান না। গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, নারীদের ওপর চলেছিল ব্যাপক নির্যাতন। গ্রামবাসী কাঞ্চন গাজীর বলেন, ‘সেদিন দুপুরে পাকসেনারা গ্রামে ঢুকে প্যাদা বাড়িতে অভিযান চালায়। বাড়ির পুকুরপাড়ে ৪জনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। এরপর তারা হানা দেয় সিকদার বাড়িতে। সেখানে গুলি করে আরও ৪জনকে। পাশের হাওলাদার বাড়িতেও অভিযান চালায়। এই ঘটনার সময় এলাকার নারীরা আশ্রয় নিয়েছিল ঝোঁপঝাড়ে। সেখান থেকে ১৫জন নারীকে ধরে শহরে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায় পাকসেনারা। সেখানে নির্যাতন চালানোর পর ভোর চারটায় তাদের কালিকাপুরের তুলাতলী নামক স্থানে ছেড়ে দেয়া হয়।’ ইটবাড়িয়া গ্রামের আত্মস্বীকৃত ১৪ জন বীরাঙ্গনা হলেন- রুশিয়া বেগম, হাসন বানু, ভানু বিবি, হাচেন ভানু, মোনয়ারা বেগম, ময়ুর নেছা, ফুলবানু, রিজিয়া বেগম, ফুলভানু, জয়ফুল বিবি, সকিনা বেগম, জামিনা বেগম, আনোয়ারা বেগম ও ছয়তুননেছা। এদের মধ্যে সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব ছাড়া ভাগ্যে আর কিছু জোটেনি।           

মুক্তিযোদ্ধা ও বয়সী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপে জানা যায়, লাউকাঠী নদীর তীরে পাক বাহিনী নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সরদার আবদুর রশিদের ভাষ্য মতে, ‘পটুয়াখালী লাউকাঠী নদীর বর্তমান সেতুটির দক্ষিণপাড়ে নদী তীরে পাক বাহিনী গুলি করে বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলে। এদের মধ্যে ছিলেন পটুয়াখালী আনসারের পিসি আবদুর রহমান, সোনালী ব্যাংকের গাড়ির ড্রাইভার, শহরের মুসলিম পাড়া এলাকার বাসিন্দা আকবর মিয়াসহ ১০-১২জন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমি যখন পটুয়াখালী আসি, তখন ওই স্থান কচু বাগানে ভরে গেছে। ওখানে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের দাফনের সুযোগ হয়নি।’ অন্যদিকে অপর সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী শহরের কালিকাপুরে রয়েছে একটি গণকবর। পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত মানুষদের এখানে মাটিচাপা দেয়া হয়। এ গণকবরটি আবিষ্কৃত হয় স্বাধীনতার পরে। উত্তর লোহালিয়া, পালপাড়া ও কুড়িপাইকা এলাকার ১৯ জনকে হত্যা করে পাকবাহিনী। কুড়িপাইকার জেলে পাড়া থেকে ধরে আনা ১৪ জনকে পালের ডাঙ্গা খাল পাড়ে এনে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। এদের মধ্যে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান দু’জন। যতদূর জানা যায়, ২৬ এপ্রিলের আগ পর্যন্ত একমাস পটুয়াখালী জেলা ছিল মুক্তাঞ্চল। এসময় সংগ্রাম পরিষদ বর্তমান মহিলা কলেজে জেলা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপন করে ৩০০ মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক এমএ আউয়াল এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পুলিশ লাইন থেকে রাইফেল ও গুলি এনে তুলে দেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। পরে এজন্য পাক-হানাদাররা তাকে গুলি করে। তবে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। পাক-হানাদারদের জঙ্গী বিমান পটুয়াখালীর আকাশে দেখা যায় ২৬ এপ্রিল সোমবার, সকাল ১০টার দিকে। তখন থেকেই শুরু হয় বিমান হামলা। অব্যাহত থাকে শেলিং আর বেপরোয়া গোলাবর্ষণ। একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা বোমা হামলা চালিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে কালিকাপুর এলাকায় অবতরণ করে পাকিস্তানি ছত্রীসেনা। তারা নির্বিচারে গণহত্যা চালায়।

পাক হানাদারদের অত্যাচার-নির্যাতনের মাঝেও থেমে থাকেননি মুক্তিযোদ্ধারা। বিভিন্ন স্থানে তারা সংগঠিত হতে থাকে। গড়ে তোলে প্রতিরোধ। পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে মাদারবুনিয়ায় পাক বাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এই জেলায়। ১১ আগস্ট দুপুরে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বাধীন শাহজাহান ফারুকীর ৩৪ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায় পাকসেনারা। গ্রুপ কমান্ডার হাবিলদার মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করে। এসময় শত্রুপক্ষের ৩ জন গুলিবিদ্ধ হয়। ফলে তারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে গুলি স্বল্পতার কারণে মুক্তিযোদ্ধারা এলাকা ত্যাগ করে। গলাচিপা থানার পানপট্টিতে ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা দলের ক্যাম্প। মুক্তিযোদ্ধা কে এম নূরুল হুদা ও হাবিবুর রহমান শওকতের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় সে ক্যাম্প। ১৮ নভেম্বর সকাল ৬টার দিকে ওই ক্যাম্পে আক্রমণ করে পাকবাহিনী। প্রতিরোধ করে মুক্তিযোদ্ধারা। যে যার মত করে অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ। গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয় গোটা এলাকা। তিন দিক থেকে আসছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ। তাদের সঙ্গে যোগ হয় এলাকার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। এক পর্যায়ে পিছু হটে পাকবাহিনী। বাউফলের সুবেদার পঞ্চম আলী জুন মাসে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। তিনি অনেক পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার হত্যা করে পাকসেনাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেন। তিনি কালীশূরী বন্দরের নিকটে একটি লঞ্চ আক্রমণ করে কয়েকজন পাকসেনা হত্যা করেন এবং অস্ত্র উদ্ধার করেন। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকসেনারা কালীশূরী বন্দরটি পুড়িয়ে দেয়। কালীশূরী বন্দরে ছিল পাকসেনা ও রাজাকারদের ক্যাম্প। পঞ্চম আলী ও তার সহযোগীরা ক্যাম্প আক্রমণ করে কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার হত্যা করেন। কালিশূরী বন্দরের নিকট ভাতশালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধার ঘাঁটি ছিল। কমান্ডার ছিলেন সেনাবাহিনীর সুবেদার পঞ্চম আলী। ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কালিশূরী বন্দরের হাটবার। ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের দল কালিশূরী বন্দর পোড়াতে আসে। প্রথমে হাট সংলগ্ন সাজজাল বাড়িতে আগুন দেয়। এ সময় কমান্ডার পঞ্চম আলী তার বাহিনী নিয়ে উত্তর দিক থেকে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে। বাঁধা পেয়ে বাকবাহিনী কুমারখালী খালের হোগলা বনে অবস্থান নেয়। তারা মেশিনগান ও মর্টার দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে। ৭ ঘণ্টার যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। ওদিকে চাঁদকাঠি মুক্তি বাহিনীর বিজয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ে। পটুয়াখালীতেও সে খবর আসে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকবাহিনী কয়েকদিন পর কালিশূরী বন্দর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। ধুলিয়া গ্রামের পাকবাহিনীর দালাল ছত্তার মওলানাকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করে তার লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখে। এ সংবাদ পেয়ে পাক হায়েনারা ধুলিয়া গ্রামে এসে ৬০ জন গ্রামমবাসীকে তেঁতুলিয়া নদীর তীরে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।

দীর্ঘ ৮ মাস অবরুদ্ধ থাকার পর একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর পাক হানাদার মুক্ত হয় পটুয়াখালী জেলা। মিত্রবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই প্রতিরোধ আর সম্মুখ যুদ্ধে শত্রুদের পরাজিত করে জেলা সদর ছাড়া সকল এলাকা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। কিন্তু এক সময় জেলা শহরও শত্রুমুক্ত হয়। এক পর্যায়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায় মেজর ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন পাকবাহিনী। পটুয়াখালীতে বইতে থাকে স্বাধীনতার সুবাতাস। 

 

তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, পিরোজপুর
বরিশাল বিভাগের ইতিহাস, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চল, মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জু
বরিশাল পিডিয়া
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়