ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বাংলার রস, বাংলার মিষ্টি

হুমায়ূন শফিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৭, ১১ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলার রস, বাংলার মিষ্টি

হুমায়ূন শফিক : আনন্দ-সুখে বাঙালির মিষ্টিমুখ না করলেই নয়। মিষ্টির ইতিহাসে চোখ ফেরালে যে নামটি প্রথম মনে আসে তিনি নবীনচন্দ্র দাস। তাকেই রসগোল্লার প্রথম কারিগর বলা হয়। ঢাকায় সবচেয়ে বিখ্যাত মিষ্টির দোকান দুটি ছিলো পাশাপাশি। ইসলামপুর রোডে শাঁখারিবাজারে ঢোকার আগে- কালাচাঁদ গন্ধবণিক ও সীতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এরপর রথখোলার মোড়ে মরণচাঁদ ঘোষের দোকান। তখন মরণচাঁদের ব্র্যান্ড স্লোগান ছিলো- অপ্রতিদ্বন্দ্বী দধি বিক্রেতা। গ্রাহক তখন কালাচাঁদ ও সীতারাম থেকে মিষ্টি কিনলেও দই এবং আমৃত্তি কিনতো মরণচাঁদ থেকে। চট্টগ্রামে বিখ্যাত ছিল লাভ লেইন-এর প্রান্তে বোস ব্রাদার্স।

বাংলাদেশে কয়েকটি অঞ্চলের মিষ্টি দেশজুড়ে বিখ্যাত। যেমন টাঙ্গাইলের (পোড়াবাড়ি ও চারাবাড়ি) চমচম, কুমিল্লার রসমালাই, মুক্তাগাছার মণ্ডা, বগুড়ার দই প্রভৃতি। সত্তরের দশকে, বিশেষত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে মিষ্টি ব্যবসার পট দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে। এই পট পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা নেয় আলাউদ্দিন সুইটমিট লিমিটেড। গ্রিন রোডে তাদের ব্যবসার সূচনা হয়। আলাউদ্দিনের দোকানে একাধিক ডিসপ্লে শেলফ স্লাইডিং কাচের পার্টিশনে ঘেরা থাকতো। ফলে মাছি-মৌমাছির উৎপাত ছিলো কম। সেখানে রেস্টুরেন্টের মতো চেয়ার-টেবিল রাখা হতো। গ্রাহক আরাম করে বসে রসনা মেটাতে পারতেন।



বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হরেক রকমের মিষ্টি পাওয়া যায়। যেমন টাঙ্গাইলের চমচম। এই চমচম দেশজুড়ে বিখ্যাত ভুবন ভোলানো স্বাদের জন্য। ব্রিটিশ আমলেও এই চমচমের স্বাদ উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। টাঙ্গাইলের চমচম আজ যেনো তার সেই গৌরব হারাতে বসেছে। কারণ আমরা এখন যে চমচম পাই তা মূলত টাঙ্গাইলের পাঁচআনি বাজারের। পোড়াবাড়ির চমচমের সেই রমরমা অবস্থা আর নেই।

নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুনাম কে না জানে? প্রায় ২৫০ বছর ধরে সমগ্র বাংলাদেশ এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার সুনাম ছড়িয়ে আছে। কাঁচাগোল্লা তৈরির কাহিনিও চমৎকার। শোনা যায় অনেকটা দায়ে পরেই তৈরি করা হয়েছিল কাঁচাগোল্লা। নাটোর থেকে নওগাঁর দূরত্ব খুব বেশি নয়। এই জেলা শহর বিখ্যাত প্যারা সন্দেশের জন্য। কবে থেকে এর শুরু তা স্পষ্টভাবে বলা যায় না। প্রথম দিকে প্যারা সন্দেশ পূজা মণ্ডপে দেবদেবীর উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হতো। লোকমুখে শোনা যায় নওগাঁ শহরের কালিতলার মহেন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তি প্রথমে প্যারা সন্দেশ তৈরি শুরু করেন। এই সন্দেশ তৈরির সময় দুধের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ভালোভাবে জ্বাল দিয়ে ক্ষীর তৈরি করা হয়। ক্ষীর যখন জড়িয়ে আসতে শুরু করে তখন দুই হাতের তালুর মাঝে নিয়ে সামান্য চাপ দিতে হয়। এভাবেই তৈরি করা হয় প্যারা সন্দেশ। এর রং হালকা খয়েরি। এক কেজি প্যারা সন্দেশ তৈরি করার জন্য প্রয়োজন পড়ে প্রায় ৭ লিটার দুধ। এই মিষ্টির অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এতে দুধ আর চিনি ছাড়া অন্য কোনো উপকরণ ব্যবহার করা হয় না।



গাইবান্ধার রসমঞ্জুরীর স্বাদ অনন্য। রসালো ঘন দুধের ক্ষীরের সঙ্গে খাঁটি ছানায় তৈরি মার্বেল সদৃশ্য ছোট ছোট গোলাকার রসগোল্লার সমন্বয়ে তৈরি হয় এই মিষ্টি। একে রসমালাইও বলে। বাংলাদেশে এক নামে পরিচিত বগুড়ার দই। নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি এই দইয়ের স্বাদ অতুলনীয়। দেশ ভাগের পূর্ব থেকেই এই দই সুনাম কুড়িয়েছে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডা এদেশের আরেকটি বিখ্যাত মিষ্টি। এটি নিয়ে কিংবদন্তি চালু রয়েছে। একটি কিংবদন্তি এমন যে, দুইশ বছর আগে মুক্তাগাছার গোপাল পাল নামক এক ময়রা স্বপ্নের মাধ্যমে এক ঋষির কাছ থেকে মণ্ডা তৈরির আদেশ পেয়েছিলেন। ঋষিই তাকে মণ্ডা তৈরির কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। যতদূর জানা যায় প্রথম মণ্ডা তৈরি হয় বাংলা ১২৩১ সনে। নেত্রকোনা জেলার প্রসিদ্ধ একটি মিষ্টির নাম বালিশ মিষ্টি। এটি আকারে বালিশের মতো বড়ো নয় ঠিকই কিন্তু আকৃতিগত দিক থেকে অনেকটাই বালিশের মতো। এই মিষ্টির উপরে ক্ষীরের প্রলেপ থাকে। এই মিষ্টি গোয়ানাথের বালিশ নামেও পরিচিত। কেননা এর জনক গোয়ানাথ ঘোষাল। তার স্বপ্ন ছিলো, নতুন এমন এক মিষ্টি তৈরি করা যা তাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখবে। তার সেই স্বপ্নের ফসল বালিশ মিষ্টি। এ মিষ্টি তৈরি হয় দুধ, ছানা, চিনি আর ময়দা দিয়ে। প্রথমে দুধের ছানার সঙ্গে সামান্য ময়দা মিশিয়ে মণ্ডের মতো প্রস্তুত করা হয়। এরপর সেই মণ্ড থেকে এমন টুকরো টুকরো করা হয় যেগুলো দেখতে ছোট ছোট বালিশের মতো। পরে চিনির গরম রসে সেগুলো ভাজা হয়। এরপর ঠান্ডা করে পুনরায় চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয় বেশ কিছুক্ষণ। বিক্রি করার সময় আরেক দফা এর উপর ক্ষীরের প্রলেপ দেয়া হয়। এর তিন ধরনের আকৃতি আছে। তবে বড়ো আকৃতির বালিশের আকার সাধারণত ১৩-১৪ ইঞ্চি।

কুমিল্লার রসমালাই জেলার এক ঐতিহ্য। প্রথমদিকে এই রসমালাইয়ের নাম ছিল ক্ষীরভোগ। তখন মাটির হাঁড়িতে বিক্রি হতো এ মিষ্টি। পাকিস্তান আমলে অবাঙালিরা ক্ষীরভোগকে ‘রসমালাই’ বলতে শুরু করে। তখন থেকেই এ নাম প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়াও আরো কিছু জায়গা মিষ্টির জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। যেমন যশোরের জামতলার রসগোল্লা। এটি ‘সাদেক গোল্লা’ নামেও পরিচিত। সাতক্ষীরার সন্দেশও স্বাদে অতুলনীয়। কুষ্টিয়ার তিলের খাজারও সুনাম রয়েছে। এটি বর্তমানে ক্ষুদ্র শিল্পে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের মিষ্টি তিল দিয়ে তৈরি হয়। শীত মৌসুমে তিল চাষ হয় তাই শীতকালে তিলের খাজার অন্য রকম কদর রয়েছে। কুষ্টিয়ার অনেক ঐতিহ্যের মধ্যে একটি তিলের খাজা। মেহেরপুরের রসকদম্বের রস নেই তবু নাম রসকদম্ব। মেহেরপুরের ১৫০ বছরের ঐতিহ্য বহন করছে এই মিষ্টি। প্রায় শত বছর আগে লোভনীয় খাবারের তালিকায় ছানামুখীর নাম যোগ করেছিলেন মহাদেব পাঁড়ে। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ছানামুখী প্রায় সকলের প্রিয়। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার পান্তোয়া মিষ্টিও স্বাদে অসাধারণ। এই মিষ্টি দেখতে অনেকটা রোলের মতো। রসে ডুবানো থাকে। বেশিদিন ভালো রাখার জন্যই এ ব্যবস্থা। 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়