ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাতাকুঁড়ির দেশে বৈশাখ || রুমা মোদক

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ১৬ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাতাকুঁড়ির দেশে বৈশাখ || রুমা মোদক

দু'পাশে ছায়াবৃক্ষের নিচে উঁচুনিচু ঢালভাঙা সারিসারি চা গাছ। প্রকৃতি যেন সবুজ শাড়ি আর নোলক পরা ষোড়শী। আঁচল বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তমের অপেক্ষায়। প্রকৃতির এই মায়াময় সবুজ আঁচলে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে আসা পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে বছরজুড়ে। গ্রীষ্মে এর এক রূপ, বর্ষায় এক, শীতে আরেক। বৈচিত্র্যের পসরায় ফেলনা নয় কোনো ঋতুই। আর সিজনে কুলি কামিনরা পিঠে ঝুড়ি বেঁধে নতুন কুঁড়ি কুড়িয়ে চুকায় শ্রম ঘামের দাম, মেটায় জীবিকার দায় সে দৃশ্য তো নাগরিক চোখে ছবির মতো মনোমুগ্ধকর। শোভা পায় কখনও ক্যালেন্ডারের পাতায়, কখনও গৃহসজ্জায়। ছবির বাইরে তাদের যে জীবন আর যুদ্ধ, নিয়ত অনটন, রোগ-বালাই, দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ তা কেবলই কাগুজে গবেষণা আর এনজিও’র রুটিন কর্মতৎপরতায় সীমাবদ্ধ। সারি সারি চা গাছের পেট চিরে পিচ করা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে চা বাগানকেন্দ্রিক অবাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষয়ে যাওয়া সংস্কৃতির ছোপ ছোপ চিহ্ন। আসাম, বিহার, উড়িষ্যা থেকে আসা মানুষগুলোর কয়েকটা প্রজন্ম কেটে গেছে এই মাটিতে।

পানীয় হিসেবে চায়ের আবিষ্কার চীনে। ষোড়শ শতকে পুর্তগীজদের মাধ্যমে চীনের চা ইউরোপে পা রাখে। পরবর্তী সময়ে দুটি বৃহৎ পরাশক্তি চীন ও বৃটেন পণ্যবিনিময় প্রথায় চীন থেকে বৃটেনে আসতো চায়ের কার্গোবাহী জাহাজ আর বৃটেন থেকে রফতানি হতো আফিম। আফিম চাষের উর্বর ক্ষেত্র ছিলো এই ভারতবর্ষ। প্রায় দুইশ বছর ছিলো এই পণ্যবিনিময় প্রথা। ১৮২৯ সালে মাঞ্চু রাজবংশীয় চৈনিক সম্রাট চীনে আফিম আমদানি নিষিদ্ধ করে দিলে সূত্রপাত হয় ঐতিহাসিক ‘আফিম যুদ্ধ’র। চীনারা যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে কৌশলের আশ্রয় নেয়। নিজ দেশে আফিমের বিশাল চাহিদা মাথায় রেখে নিজ দেশেই আফিম চাষের উদ্যোগ নেয়। বিনিময়ে বৃটেন বন্ধ করে দেয় চা রফতানি। ইতোমধ্যে বৃটেনেও গড়ে উঠেছে চায়ের ভোক্তা বিশাল জনগোষ্ঠী। তারাও চা উৎপাদনে এগিয়ে এলো আর স্থান হিসেবে বেছে নিলো ভারতবর্ষকেই।

১৮৩৪ সালে ভারতবর্ষে ‘রয়েল সোসাইটি’ গবেষণা করে জানিয়েছিলো আসাম এবং সিলেটের আশেপাশের মাটি চা উৎপাদনের জন্য উপযোগী। ১৮৫৫ সালে ইতিহাসের বাঁকে ভারতবর্ষে প্রথম চা বাগান স্থাপিত হয় সিলেটের মালিনীছড়ায়।

বাগান স্থাপিত হবার পর বাঘ চিতা সাপ-খোপের আস্তানায় কাজ করতে রাজি হয় না স্থানীয় কৃষকেরা। ফলে শ্রমিক সংগ্রহ করা হয় উড়িষ্যা, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশের চরম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষগুলোকে। দেখানো হয় উন্নত জীবন আর উঁচু বেতনের লোভ। এই লোভেই শত শত মানুষ পতিত হয় মানবেতর সংগ্রামে। নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা সব পরিত্যাগ করে মেনে নিতে হয় ক্রীতদাসের জীবন। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, সাপের কামড়ে বাড়তে থাকে চিকিৎসাহীন মৃত্যুর মিছিল। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সালের এক নথিতে দেখা যায়, ১৮৬৩-৬৬ পর্যন্ত ৮৪ হাজার ৯১৫ জন শ্রমিকের মধ্যে ৩১ হাজার ৮৭৬ জন মারা যায়।

আসাম বিহার উড়িষ্যা থেকে চা চাষের উদ্দেশ্যে আগত মানুষগুলোর কয়েকপুরুষ কেটে গেছে এই মাটিতে। এই দুই পুরুষ আগেও এসব পরিবারের একমাত্র জীবিকা ছিলো চা শিল্পকেন্দ্রিক শ্রম। কিন্তু সময়ের সাথে বদলেছে জীবনের প্রয়োজন, বেড়েছে চাহিদা। ফলে নানা পেশায় দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তারা। কোম্পানি কর্তৃক বরাদ্দকৃত বসতভিটাটুকু টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অন্তত একজনকে কোম্পানির শ্রমিক হতে হয়। নইলে পুরুষেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় দিনমজুর হয়ে, স্বল্পসংখ্যক হলেও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বড় চাকরিজীবীও হয় কেউ কেউ। মেয়েরাও বাগান ছাড়ে গৃহকর্মী হয়ে। ছেলেমেয়েরা যায় কাছেধারে স্কুলে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ডিঙিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়িও ভাঙে অনেকেই। সময়ের সাথে সাথে ঘরে ঢুকেছে টিভি, বৈদ্যুতিক বাতি।

বাগানবেষ্টিত লোকালয়ে ঢুকে গেলেই দেখা মেলে কুলি কামিনদের। পুরুষানুক্রমে তারা হারিয়েছে নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতি। ভুলে গেছে আদি ঠিকানা। ভাষায় বাংলার সাথে তবু লেগে আছে পূর্বপুরুষের টান, যা তাদের সহজেই আলাদা করে গড়পড়তা বাঙালি থেকে। যেমন আলাদা করা যায় তাদের বসতভিটাগুলোও ফ্যাক্টরিতে চাকরিরত বাঙালি বাবুদের বসতভিটা থেকে।

এই লোকালয় ঘিরে রয়েছে প্রাথমিক স্কুল, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, নাটমণ্ডপ। সারিসারি চিপস, বিস্কুট কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর  দোকান। চায়ের স্টল, সিঙারা, সমুচা। বাংলাদেশের নগরায়িত অন্য দশটা গ্রামের মতোই। তাদের নিকানো মাটি লেপা শৈল্পিক দেয়ালগুলো হারিয়ে যাচ্ছে ইটের গাঁথুনিতে। পাতাকুঁড়ি শ্রমিক উন্নয়ন সংস্থার মতো এনজিওগুলো আসছে অধিকার সচেতন করতে। দীর্ঘদিন নিপীড়নে ক্লান্ত জাতি অবিশ্বাসের চোখে দেখছে আগত সবাইকে। যেন সেই বৃটিশ সরকারের মতো সবাই তাদের ঠকাতেই যায় কেবল।

বরুণ কৈরি, গৌতম মুণ্ডা, শান্তি রানি বাকতি এদের নামগুলোতে বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পূর্বপুরুষের পদবি। এদের রয়েছে নিজস্ব সমাজ ব্যবস্থা। পঞ্চায়েত পদ্ধতির ব্যবস্থা। এই পঞ্চায়েত তারা নির্বাচন করে নিজেরা ভোট দিয়ে আর নিজেরাই মেনে চলে পঞ্চায়েতের করে দেয়া নিয়ম।

ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে তারা সিন্ধু নদী তীরবর্তী অধিবাসী হিসেবে হিন্দু ধর্মের অনুসারী। হিন্দু ধর্মীয় রীতি প্রথাগুলো যেমন অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়, তাদেরও তেমনি রয়েছে নিজস্ব কিছু ধর্মীয় আচার। এগুলোর মধ্যে দিওয়ালী, হোলি বা ফাগুয়া উৎসব, জিউতিয়া (জন্মাষ্টমী) কুলদেবতার পূজা, পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে ‘বাড়ান’ দেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বংশানুক্রমে এইসব রিচুয়াল পালাপার্বণ ক্ষীণ ধারায় টিকে থাকলেও প্রায় দুইশ বছর বাঙালি সংশ্লিষ্টতা তাদের নামগুলোর মতোই ধর্মীয় আচরণেও ঘটেছে মিথস্ক্রিয়া। বাঙালি সমাজের মতো তাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হয়ে উঠেছে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজার মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো।

সেই সূত্রে চৈত্রসংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখও তাদের বাঙালি হিন্দুদের আচারের সঙ্গে মিশে গেছে। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে তারা মহাবিষুব সংক্রান্তি পালন করে। নিরামিষ আহার ও পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে। জাতিসত্তায় বাঙালি না হওয়া সত্ত্বেও বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি চা বাগানে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি রয়েছে। কাছাকাছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নানা আয়োজনে তারা যুক্ত হয়। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় দেউন্দি চা বাগানে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনব্যাপী নাট্যোৎসব। দেশের প্রখ্যাত নাট্য সংগঠনসহ, নাট্যকর্মী, নাট্যব্যক্তিত্বদের মিলনমেলায় পরিণত হয় বাগানটি।

কোনো বাগানের নাটমণ্ডপে বসে চৈত্রসংক্রান্তির বান্নি। হবিগঞ্জের চা বাগান পরিবেষ্টিত রঘুনন্দন পাহাড়। স্থানীয়দের বিশ্বাস হনুমান গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে যাবার সময় এখানে পড়েছিল পাহাড়ের কিছু অংশ, যা এই রঘুনন্দন পাহাড় নামে পরিচিত। পহেলা বৈশাখে আশেপাশের কয়েকটি বাগানের অধিবাসীদের স্রোত চলে এই পাহাড় অভিমুখে, পূণ্য লাভের প্রত্যাশায়।

নিত্য অনটন আর আর্থিক টানাপোড়েনেও সাধ্যমতো নতুন কাপড় পরিধান করে তারা। তাদের ঘরে ভালো মন্দ রান্না হয়। এসবই তারা গ্রহণ করেছে বাঙালি সমাজ সংশ্লেষ থেকে। পুরুষানুক্রমে ইতিহাস বিস্মৃত এই চা বাগানের কুলি কামিন শ্রমিকরা, যাদের শেকড় প্রোথিত রয়েছে বৃহত্তর ভারতের বিহার উড়িষ্যায় তারা ঠিকঠাক জানেও না আদৌ তাদের নিজস্ব কোনো নববর্ষ রয়েছে কিনা। তারা সমুদ্রমুখী নদীর মতো নিজস্ব গতি হারিয়ে বাঙালি সমাজে সমুদ্রের বিশালতায় মিশে গেছে, মিশে যাচ্ছে। এই যে দিনের পর দিন এদের বাঙালি সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হওয়া, নিজেদের মুলুক পরিচয় বেমালুম ভুলে যাওয়া বাঙালি সমাজ কী তাদের সেভাবে গ্রহণ করেছে? এরা যেভাবে ভাষা কিংবা নামের স্বাতন্ত্র ঘুচিয়ে নিজেদের মূলধারার সাথে একাত্ম হতে চাইছে বাঙালি সমাজ কিছুতেই তাদের সেভাবে গ্রহণ করছে না। ভদ্র সমাজে তারা এখনো সোকল্ড ‘লেবার’ নামেই পরিচিত। ভালো থাকার নিষ্পাপ অভিপ্রায় তাদের ঠেলে দিয়েছে যে অভিশপ্ত পরবাসী জীবনে, সভ্যতায় হয়তো এর থেকে মুক্তি নেই এদের।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়