ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

উপকূলের জেলেরা কীভাবে বাঁচবে?

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ২০ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উপকূলের জেলেরা কীভাবে বাঁচবে?

রফিকুল ইসলাম মন্টু: প্রশ্নটা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ভালো-মন্দে মাছের মৌসুম শেষ হয়। তারপর সংকটের দিন শুরু হয়। ধার-দেনা করে জীবন চলে। অবশেষে কাজের সন্ধানে শহরে যেতে হয়। উপকূলের বৃহৎ জেলে সম্প্রদায়ের এ এক অনিশ্চিত জীবন। নদী-সমুদ্রে মাছ ধরা এক সময় ভালো উপার্জনের পেশা হিসাবে পরিচিত থাকলেও এখন এটি ‘মৌসুমী’ পেশায় পরিণত হতে চলেছে। টানা দু’দুটি মাস পেশায় বিরতি। এমনিতে সপ্তাহে একটি দিনও বিরতি পাওয়া না গেলেও এই দুই মাস যেন তাদের জন্য ‘বাধ্যতামূলক অবসর’। কিন্তু অবসর তো দিলেন, অবসরকালে কি খেয়ে বেঁচে থাকবেন মানুষগুলো? ব্যবস্থা হয়তো একটা কিছু করা হয়েছে; তবে সেটা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। উপকূলের জেলেদের জীবনে এমন সময় বারবার আসে। তবে মার্চ-এপ্রিলের সময়টা একটু বেশিই দুঃসময়ের। এরপর আবার ক’দিন মাছ ধরতে পারবে কে জানে? তাহলে এই প্রশ্নটা আসা খুবই স্বাভাবিক- জেলেরা বাঁচবে কীভাবে?

মার্চ-এপ্রিলে নদীতে যে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়; মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহকারী মানুষগুলোর কাছে সেটাই নিষিদ্ধ সময়। আর এই সময় তাদের জীবনে যে সংকটের কাল আসে; সেটা দুঃসময়। এই পেশার মানুষেরা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাদের দু’মাসের ত্যাগ, কষ্টে থাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে ইলিশের উৎপাদন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুনাম কুড়াচ্ছে। কিন্তু এই সুনামের মূল কেন্দ্রে থাকা মানুষেরা এর সুফল কতটা পাচ্ছেন? ন্যূনতম প্রাপ্যটুকু নিয়েও টালবাহানার শেষ নেই। 

প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিলে জেলেদের দুঃসময়ের গল্প শুনি। জীবিকার প্রয়োজনে নদী সমুদ্রে ব্যস্ত থাকা এই মানুষগুলো নিষিদ্ধ সময়কালে হাত-পা গুটিয়ে ঘরে বসে থাকেন। এই সময়ে কেউ জমানো টাকা খরচ করেন, কেউ ধারকর্জ করেন, কেউ ঘরের মালামাল বন্ধক রেখে, কেউবা মহাজনের কাছ থেকে অগ্রিম দাদন নিয়ে দিনগুলো পার করে দেন। দিন চলে যায় ঠিকই; কিন্তু সংকটের দিনের রেশ থেকে যায় আরও বহুদিন। এসব কারণে মাছধরা পেশায় নিয়োজিত মানুষেরা মাথা তুলতে পারেন না। তাদের মেরুদণ্ড আর সোজা হয় না। মহাজনের কাছে এক একটি পরিবার বাঁধা থাকে যুগ যুগ। প্রতিবছর মাছধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় এলে এইসব আলোচনাই ঘুরেফিরে আসে। আলোচনা হয়; দাবি ওঠে; কর্তৃপক্ষের কাছেও হয়তো পৌঁছায় দাবিগুলো; কিন্তু তাতে সংকটাপন্ন পরিবারগুলোর অবস্থা কতটা বদলায়?

উপকূলে নদ-নদীতে মাছধরা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন, নদী যেন জেলেদের কাছে ফসলি মাঠ। ফসলি মাঠে যেভাবে কৃষকদের সীমানা নির্ধারণ করা থাকে, নদীতেও তাই। কার পরে কে জাল ফেলবে, কে কতটুকু স্থান দখল করবে, অধিকাংশ স্থানেই তা নির্ধারিত থাকে। এই মাছ ধরার জন্য বছরজুড়ে জেলেদের সকল আয়োজন। অধিকাংশ জেলে মহাজনের কব্জায় বন্দি থাকে ঠিকই; তারপরও মাছ পাওয়া না পাওয়ার ওপর তাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। বছরের সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধকাল মার্চ-এপ্রিলে সংকট তাই অনেকখানি বেড়ে যায়। এই সময়ে কাজের সন্ধানে বহু জেলে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র যায় বলেও শোনা যায়। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমার সঙ্গে প্রতি বছরই বহু জেলের কথা হয়। খুব কম সংখ্যক জেলের দেখা পাই, যারা পুনর্বাসন সহায়তা পেয়েছেন। আবার এমন অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, যারা জেলে না হয়েও পুনর্বাসনের চাল পান। কেন পান না? এই প্রশ্নের জবাব অনেক দীর্ঘ। এক লেখায় হয়তো এর বৃত্তান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। তবে মোটা দাগে এটুকু বোঝা যায়, প্রথমত দুর্নীতির কারণে প্রকৃত জেলেরা পুনর্বাসন সহায়তা পান না। এর সঙ্গে রয়েছে বরাদ্দে অপ্রতুলতা। ৫ হাজার জেলে অধ্যুষিত কোন এলাকায় পাঁচশ জনকে সহায়তা দেওয়া হলে সহায়তাপ্রাপ্তদের খুঁজে পাওয়া ততটা সহজ হবে না। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা কিংবা জনপ্রতিনিধি সকলেই ‘অপ্রতুল বরাদ্দের’ কথা বলেই দায়িত্ব সারেন। তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে, বরাদ্দটা বাড়ানো হচ্ছে না কেন?

এ বছর জাটকা মৌসুমের শুরুতে আলাপ হচ্ছিল উপকূলের বিভিন্ন এলাকার জেলে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। ভোলার ইলিশা, তুলাতলী, লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার, টাংকিঘাটসহ আরও কয়েকটি স্থানের জেলেদের অভিমত নেওয়া হয়। আলাপের বিষয় ছিল মাছধরা নিষিদ্ধ, পুনর্বাসন সহায়তা এবং জেলেদের জীবিকা। প্রায় সকল স্থান থেকে একই ধরনের চিত্র পাওয়া যায়। অভিযোগ মেলে পুনর্বাসন সহায়তার কার্ড বিক্রি হয় অর্থের বিনিময়ে। পুনর্বাসন সহায়তার তালিকা তৈরির জন্য নীতিমালা রয়েছে; তা অনুসরণও করা হয়। সব নিয়মের মধ্যে থেকেই তালিকা তৈরিতে দুর্নীতি হয়। তালিকা তৈরির জন্য ইউনিয়ন পরিষদে সভা বসে। নীতিমালা অনুযায়ী বিতরণের জন্য ইউনিয়ন দল (যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে) পাবে ২০ শতাংশ কার্ড। এরপরে যতগুলো কার্ড থাকবে সেগুলোর অর্ধেক পাবেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। বাকি কার্ডগুলো ইউনিয়ন ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমিতি, বৃহত্তম মৎস্যজীবী সমিতি, আওয়ামী মৎস্যজীবী সমিতি, ইউপি ওয়ার্ড সদস্য এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মাঝে বণ্টন করা হবে। মানে এদের মাধ্যমে ‘মৎস্যজীবী কার্ড’ আছে এমন জেলেদের মাঝে বণ্টন করা হবে। যেহেতু সব জেলের জন্য কার্ড বরাদ্দ দেওয়া যাচ্ছে না, সে কারণেই এখানে বিরাট ফাঁকফোকর রয়ে যায়। বিতরণের জন্য যারা কার্ডগুলো পেলেন, তারা নিজেদের ইচ্ছামতো বিতরণ করেন। আর এজন্য অর্থ নেওয়ার অভিযোগ আসাটা খুবই স্বাভাবিক। আসছেও তাই অহরহ।

এবার আসি, পুনর্বাসন সহায়তাপ্রাপ্ত জেলেদের কথায়। সহায়তার চাল তারা কীভাবে পাচ্ছেন এবং তা সংকটকালে তাদের কীভাবে সহায়তা করছে? সেখানেও আরেক বড় প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়ায়। জাটকা মৌসুমে মাছধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে একজন জেলের জন্য পুনর্বাসন সহায়তা হিসাবে দেওয়া হয় ৪০ কেজি চাল। ৪ মাস ধরে তারা এ সহায়তা পান। এই চালের পুরোটা জেলের কাছে যায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সে প্রশ্ন এড়িয়ে ধরে নিলাম ৪০ কেজি চালই তারা পেলো। কিন্তু একজন জেলের ৪০ কেজি চালে ক’দিন চলে? যেসব জেলের সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাদের কারও মাসে ১০০ কেজি, কারও ৯০ কেজি, কারও ৬০ কেজি, আবার কারও ১১০ কেজি চাল লাগে। এটা নির্ভর করে পরিবারের সদস্য সংখ্যার ওপরে। গড় হিসাবে দেখা যায়, প্রতিটি পরিবারে প্রতিদিন ২ কেজি চাল লাগে। শুধু চাল দিয়ে ভাত রান্না করে তো তারা খেতে পারেন না। তরকারিসহ অন্যান্য বিষয়  যোগ হয়। আড়াইশ থেকে তিনশ টাকার নিচে কোন পরিবারের দিন চলে না। সে ক্ষেত্রে পুনর্বাসন সহায়তা হিসাবে সীমিত সংখ্যক জেলেকে মাত্র ৪০ কেজি করে চাল দেওয়ার কোন অর্থ আছে বলে হয় না।

জাটকা ধরা নিষিদ্ধ অভিযানে সরকার সফল। কয়েক বছর ধরে এই অভিযান কঠোরভাবে পরিচালিত হওয়ায় ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে বলে দাবি মৎস্য বিভাগের। মাঠ পর্যায়ে অভিযান পরিচালনায় কড়াকড়িও আছে। জাটকা নিষিদ্ধ এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের রাত জেগে নদী পাহারার খবর থেকে আমরা তেমনটাই ধারণা করতে পারি। আইন প্রয়োগ হোক, নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরা পুরোপুরি বন্ধ থাকুক, সেটাই সকলের কাম্য। কিন্তু যে পরিবারটি মাছ ধরার ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল; সে পরিবার নিষিদ্ধ সময়ে কী খেয়ে বাঁচবে- সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। পরিকল্পনার সময় বড় বড় কথা শুনি; মাঠে এসে তার কোন প্রতিফলন পাই না। তাহলে সে কথা বলার অর্থ কী? মার্চ এলে সংবাদপত্রে একই ধরনের খবর দেখি বারবার- ‘পুনর্বাসন সহায়তা পায়নি জেলেরা’, অথবা ‘পুনর্বাসন সহায়তা বিতরণে অনিয়ম’। আবার পাশাপাশি- ‘জাটকা ইলিশসহ জেলে আটক’, ‘নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নদীতে জাল ফেলায় জেলে গ্রেফতার’ এমন খবরও চোখে পড়ে। নিষিদ্ধ সময়ে এসব কোন খবরই প্রত্যাশিত নয়। সে জন্যেই পুনর্বাসন সহায়তায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।

সংকটকালে উপকূলের জেলেদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাতে তারা ঠিকভাবে তিন বেলা ভাত অন্তত খেতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। দুঃসময়ে জেলেদের সময় ফেরাতে কী করা যেতে পারে? এই সময়ে কীভাবে তাদের জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক করা যেতে পারে? প্রশ্নের জবাব খুবই ছোট। মাছধরা পেশায় নিয়োজিত সকলকে ‘মৎস্যজীবী কার্ড’ দিতে হবে, সব জেলের জন্য পুনর্বাসনের বরাদ্দ দিতে হবে, জেলেপ্রতি বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতে হবে, পুনর্বাসন সহায়তার কার্ড বিতরণে আরও সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর পাশাপাশি জাটকা নিষিদ্ধকালীন জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিতে হবে। বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা অনেক বার বলা হয়েছে। কিছু পদক্ষেপ নেয়াও হয়েছে। কিন্তু তা কতটা কার্যকর, তা খতিয়ে দেখতে হবে। দুঃসময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করলে হয়তো একদিন জেলে পেশাটাই ‘মৌসুমী’ পেশায় পরিণত হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়