ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ইলিশ ধরার ট্রলার: সমুদ্রের ঘোড়া

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪১, ২ মে ২০১৯   আপডেট: ১৬:৩০, ৮ ডিসেম্বর ২০২২
ইলিশ ধরার ট্রলার: সমুদ্রের ঘোড়া

খায়রুল বাশার আশিক : রুপালি ইলিশের আশায় ঘোড়ার গতিতে তার ছুটে চলা। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে, নোনা জলের উথাল-পাথাল ঢেউ সামলে তাকে যেতে হয় গভীর সমুদ্রে। টিকে থাকতে হয় ঝড়-বৃষ্টি, তুফানসহ শত প্রতিকূলতার মধ্যে। বলছিলাম ইলিশ ধরার ট্রলারগুলোর কথা। এই বিশেষ ধরনের ট্রলার নিয়ে উপকূলীয় জেলেরা মাঝ সমুদ্রে ইলিশ আহরণে যায়। তখন এই ট্রলারটি হয়ে ওঠে জেলেদের জীবনে বেঁচে থাকার একমাত্র সঙ্গী। পাঠক, চলুন জেনে নেই, ইলিশের ট্রলার কীভাবে তৈরি হয়? কোথায় কীভাবে হয় এর সারাই? কেমনই বা তার জীবনচক্র?

ইলিশের ট্রলারগুলো তৈরি করা হয় এমনভাবে যাতে সেগুলো দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়। উত্তাল সমুদ্রের প্রতিকূল স্রোতের মাঝেও ঘণ্টায় ২০ থেকে ২২ কিলোমিটার এবং স্রোতের অনুকূলে ঘণ্টায় ৩৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে ট্রলারগুলো। সুজুকি, ইসুজু ইত্যাদি নামী-দামি কোম্পানির রিকন্ডিশন ইঞ্জিন ব্যবহার হয় এসব ট্রলারে। ব্যবহৃত ইঞ্জিনগুলো সাধারণত ট্রলারের আকার-আকৃতির ভিত্তিতে ১৪০ থেকে ২৯০ হর্স পাওয়ারের হয়। ইলিশ ধরার ট্রলারগুলো সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। প্রস্থে ১৪ থেকে ১৫ ফুট। এসব ট্রলার নির্মাণের কাজ করা হয় উপকূলের স্থানীয় ডক ইয়ার্ডগুলোতে। ব্যবহার করা হয় গর্জন, চাম্বল, ত্রিশূল ইত্যাদি কাঠ।



ট্রলার বানাতে পর্যায়ক্রমে কাজ করেন একাধিক মিস্ত্রি। ট্রলার বানানোর কাজ শুরু করেন কাঠ মিস্ত্রি। তিনি প্রথমে ট্রলারের কাঠামো তৈরি করেন। এরপর সেই কাঠামোর সঙ্গে একের পর এক কাঠ জুড়ে দিয়ে বানানো হয় দেহ-কাঠামো। আস্তে আস্তে বানানো হয় গলুই, চান্দিনা, ছই, রান্নাঘর, পায়খানা ইত্যাদি। এই দেহ-কাঠামো সম্পাদনে দশজন শ্রমিকের প্রায় একমাস সময় লেগে যায়। এরপর লম্বা লম্বা কাঠের জোড়ার ফাঁকে শুরু হয় সুতার সলতে ঢুকানোর কাজ। এই কাজকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘গাইনির কাজ’। চিকন লোহা এবং হাতুড়ি দিয়ে অতি সূক্ষ্মভাবে এ কাজ করা হয়।

গাইনির কাজ শেষ হলেই শুরু হয় পুটিংয়ের কাজ। কেরোসিন তেলের সঙ্গে ধূপ ও পানি মিশিয়ে বানানো হয় আঠালো পুটিং। এরপর ট্রলারের নিচের অংশে আলকাতরা লাগাতে হয়। একাধিক প্রলেপ লাগানোর পর তার উপরে লেপটে দেয়া হয় কাদামাটির প্রলেপ। লেপটে দেয়া সেই কাদা শুকিয়ে এলে ট্রলারের তলায় আগুনের তাপ দিয়ে আলকাতরাকে ট্রলারের নিচের অংশের কাঠের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হেয়। এতে টেকসই হয়। এরপর শুরু হয় ইঞ্জিন বসানোর কাজ। ইঞ্জিনের সঙ্গে লাগানো হয় পেছনের পাখা। পাখা লাগানোর কাজ যিনি সম্পন্ন করেন তাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘বুশমিস্ত্রি’। সবশেষে করা হয় রঙের কাজ। গাইনি, পুটিং ও মেরামত, রং করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন মিস্ত্রি থাকেন। স্থানীয় ডক ইয়ার্ডগুলোতে প্রতিটি ট্রলার মেরামতের জন্য প্রতিদিন ভাড়া গুনতে হয় প্রায় এক হাজার টাকা। কোনো ট্রলার ১৫ দিন থাকলে ১৫ হাজার টাকা শুধু ডক চার্জ দিতে হয়। কাঠ মিস্ত্রির দিনপ্রতি মজুরি কমপক্ষে এক হাজার টাকা।



উপকূলীয় জেলাগুলোর সাধারণ সব ডক ইয়ার্ডে সমুদ্রগামী ট্রলার তৈরির কাজ করা হয়। তবে বছরের যে সময় ইলিশ ধরার কাজ থাকে না, তখন এই ট্রলার তৈরি ও মেরামত করার ধুম পরে। এ সময় অধিকাংশ ট্রলারের মালিক ট্রলার মেরামত করিয়ে নেন। কেউবা বানিয়ে নেন নতুন করে। মালিক তখন একটা সুযোগ গ্রহণ করেন। অবসরে বসে থাকা জেলেদের স্বল্প টাকায় খাটিয়ে নেন। অনেক জেলে নতুন ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার স্বপ্নে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। মেরামতের কাজ জেলেরা বিনে পয়সাতেও অনেক সময় করে দেয়। মাঝি ও জেলেরা মনে করে, নতুন ও রঙিন সাজানো একটি ভালো ট্রলার ঈদের নতুন জামাকাপড়ের মতোই আনন্দের।

ইলিশ ধরার ট্রলারগুলোতে মাছ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত বরফ নেয়া হয়। তাছাড়া জাল-দড়ি-কাচি-বয়া ছাড়াও জেলেদের প্রয়োজনীয় সব থাকে সেখানে। নিতে হয় প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ, স্যালাইন, খাবার পানি, খাদ্য, মুরি বা খই ইত্যাদি। এক কথায় প্রয়োজনীয় সব কিছুই রাখা হয় এসব ট্রলারে। কেননা সেগুলো ডাঙা থেকে প্রায় ১৫ দিন দূরে সমুদ্রে ভেসে থাকে। তারপর ট্রলারগুলো পেট বোঝাই মাছ নিয়ে ফিরে আসে ডাঙায়। তখন মানুষের হাঁক-ডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে ট্রলারের চারপাশ। এ যেন যুদ্ধ জয় করে ফিরে আসা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ মে ২০১৯/ফিরোজ/তারা

ফিরোজ/তারা

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়