ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দেশে দেশে ঈদ উদযাপনে ভিন্নতা

মারুফ খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৫ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেশে দেশে ঈদ উদযাপনে ভিন্নতা

সৌদি আরবের রিয়াদে ঈদের নামাজ শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়

মারুফ খান: এক মাস সিয়াম সাধনার পর এসেছে ঈদুল ফিতর। মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ ও আনন্দের দিন এটি। আমাদের দেশের মানুষের ঈদ নিয়ে থাকে নানান পরিকল্পনা। নামাজ পড়া, সেমাই খাওয়া, প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি যাওয়া- সব মিলিয়ে আনন্দে কেটে যায় ঈদের দিন। বিশ্বের অন্য দেশের মুসলিমদের কাছেও ঈদ মানে খুশি। তবে ঈদের দিন ঘিরে দেশ ভেদে রয়েছে উদযাপনের ভিন্নতা। চলুন জেনে নিই- কোন দেশে কেমনভাবে হয় ঈদ উদযাপন।

সৌদি আরব: সৌদি আরবে ঈদ অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালন হয়ে থাকে। যদিও অঞ্চলভেদে ঈদ উদযাপনের কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে একটি বিষয়ে সবার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তা হলো— উদারতা। ঈদের নামাজ শেষে বাড়িতে বিশেষ খাবার রান্না হয়। শিশুদের উপহার হিসেবে অর্থ দেয়া হয়। এছাড়া অনেক দোকানে ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড়া প্রদান করা হয়। এদিকে সৌদি মুসলিমরা বাজার থেকে বেশি পরিমাণে চাল কিনে এনে তা বাড়ির প্রবেশ দরজার সামনে অসহায় ও ভাগ্যতাড়িত মানুষের সাহায্যার্থে রেখে দেন। এটি জাকাত ও ফিতরার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া সৌদি আরবের বড় বড় শহরগুলোতে রাতে আতশবাজি পোড়ানো হয়ে থাকে।

তুরস্ক: তুরস্কে ঈদকে বলা হয় ‘রামাদান বেরামি’ (রামাদান উৎসব) ও ‘সেকার বেরামি’ (মিষ্টির উৎসব)। ঈদের সবাই নতুন পোশাক পরে ও স্থানীয় মসজিদে নামাজ আদায় করে এবং পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানায়। পারিবারিক কবরস্থান বা সমাধিক্ষেত্রে গিয়ে মৃতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে। স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি উপহার দেয়ার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করে তারা। বড়দের ডান হাতে চুম্বনের মাধ্যমে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করার রীতি উল্লেখযোগ্য। শিশুরা প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের বাসায় বেড়াতে যায় এবং তাদের ‘তুর্কিস ডিলাইট’, ‘বাকলাভা’ ও অন্যান্য মিষ্টি খেতে দেয়া হয়। বিভিন্ন স্থানে শিশুদের মনোরঞ্জনের জন্য ‘শ্যাডো পাপেট শো’ আয়োজন করা হয়। ঈদ উপলক্ষে তিনদিন ছুটি থাকায় অনেকে বিভিন্ন স্থানে বেড়াতে যায়।
 

আবুধাবির আকাশে ঈদের রাতে আতশবাজি


মিশর: ঈদুল ফিতরে মিশরে তিন দিনব্যাপী ছুটি থাকে। সকালে নাস্তা ও পরবর্তী সময়ে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে তারা দিন শুরু করে। এদিন তারা ভালো কাজের সুফলের কথা স্মরণ ও বছরজুড়ে অন্যের প্রতি উদার থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। বড়রা উপহার হিসেবে শিশুদের অর্থ প্রদান করে। এদিন মিশরের পার্কগুলোতে শিশুদের ভিড় জমে। কায়রোর মতো বড় শহরগুলোর রাস্তায় দিন-রাত সবসময়ই ভিড় থাকে। ‘ফাতা’ (চাল, মাংস, রসুন, ভিনেগারের মিশ্রণে রান্না), ‘কাহক’সহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না হয়। তবে উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মাছের তৈরি বিভিন্ন রেসিপি।

তিউনিসিয়া: স্থানীয় অধিবাসী এবং সেখানে বসবাসরত প্রবাসীরা বিশেষ ধরনের বিস্কুট ‘বাকলাওয়া’ ও ‘কায়ক’ তৈরি করে আত্মীয় ও বন্ধুদের বাড়িতে পাঠানোর মাধ্যমে ঈদ উদযাপন করে। চলতি সময়ে অনেক কিছুর বদল হয়েছে ঠিকই, তবে অতীতে কিন্তু তিউনিসিয়ার অধিবাসীরা একসঙ্গে রাতের খাবারের আয়োজনের পাশাপাশি নাচ ও সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে উৎসবের আনন্দকে একে অন্যের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিত।

সোমালিয়া: সোমালিয়ায় ঈদ মানে ব্যয়বহুল খাবার আয়োজন। এদিন স্থানীয়রা ভুট্টার গুঁড়া, চিনি, মসলা ও তেল দিয়ে তৈরি ‘হালভো’ নামের বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরি করে।

কেনিয়া: কেনিয়ার এক তৃতীয়াংশ মানুষ মুসলমান এবং দেশটির বেশিরভাগ মুসলিম উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করে। মোম্বাসায় রমজানের শেষ দশ দিন স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল ও সামাজিকতা পালন করা হয়। ইফতার শেষে এই উৎসব শুরু হয়। সেখান থেকে সবাই বন্ধু ও পরিবারের জন্য বিভিন্ন উপহার কেনে।
   

ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ উদযাপন

 
আফগানিস্তান: ‘খানা তাকানি’ বা ঘরদোর পরিষ্কারের মাধ্যমে আফগানরা ঈদুল ফিতর উদযাপনের আয়োজন শুরু করে। ঈদের নামাজ শেষে তারা পরস্পরের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘ঈদ মোবারক, রোজা ওয়া নামাজ কবুল।’ ঈদের দিন প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠজনদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বড়রা ছোটদের উপহার দেয়। অতিথিদের ‘জালেবি’ খেতে দেওয়া হয়। পরিবারের ছোটরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এ সময় তারা বলে, ‘খালা ঈদেত মোবারক’। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে সন্ধ্যার পর ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করা হয়। আফগানদের ঈদ উদযাপনের মধ্যে অন্যতম ‘তখম জাঙ্গি’। এতে পুরুষরা ফাঁকা ময়দানে একত্রিত হয়ে পরস্পরের দিকে সিদ্ধ ডিম ছোড়ে।

মালয়েশিয়া: ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে মালয়েশিয়াতে ঈদের দিন পালন হয়। বিশেষ এই দিনে খাবার তালিকায় থাকে মাংসের তৈরি ‘রেনডাং’, কাবাব বা ‘কেটুপাত’, ‘ডোডল’ (এক ধরনের মিষ্টি)। এছাড়া থাকে বাঁশের মধ্যে রান্না করা ভাত, যা ‘লেমাং’ নামে পরিচিত।

ইন্দোনেশিয়া: ইন্দোনেশিয়ায় ঈদের দিনকে বলা হয় ‘হারি রায়া ঈদুল ফিতরি’। এদিন ‘লেবারান’ হিসেবেও পরিচিত। মুসলিমরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। পুরুষরা পরে ‘বাজু কোকো’। অন্যদিকে নারীরা পরে ‘কেবায়া কুরুং’। অনেকে গোরস্থানে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের জন্য প্রার্থনা করে এবং সম্মান দেখিয়ে কবর পরিষ্কার করে। দেশটিতে ‘মুদিক’ প্রথার প্রচলন আছে। এতে যারা কাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শহরে যায় ঈদের আগে আবার নিজ শহরে ফিরে আসে। এছাড়া ‘বালিক কামপুং’ প্রথার মাধ্যমে পরিবার ও আত্মীয়রা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করে ও ক্ষমা চায়। ঘর সাজাতে ‘পেলিটাস’ (প্রদীপ) জ্বালানো হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ হওয়ায় ঈদের দিন খাবারও এ অঞ্চলের দেশগুলোর মতোই আয়োজন করা হয়।

আমেরিকা: আমেরিকায় প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন মুসলিম বসবাস করে। অন্যান্য দেশগুলোর মতোই এখানে ঈদ উদযাপন হয়। এদিন রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুটি না থাকলেও মুসলিমরা কাজ থেকে বিশেষ ছুটি নেয়। ঈদের নামাজ পড়া হয় বিভিন্ন ইসলামিক সেন্টার, কনভেনশন হল ও পার্কের মতো উন্মুক্ত স্থানে। এখানে বসবাসরত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসলিম জনগোষ্ঠী একসঙ্গে ঈদের নামাজে শরিক হয়। কিছু শহর আছে, যেখানে ঈদের নামাজ আদায় করতে এত বেশি লোক সমাগম হয় যে, কয়েক দফায় ঈদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রাখতে হয়। দিনটি ঘিরে কখনো কখনো প্রমোদ উদ্যান ভাড়া করে দিনব্যাপী আনন্দ-উৎসবের ব্যবস্থা রাখা হয়। এদিকে ২০১৬ সাল থেকে নিউইয়র্কের পাবলিক স্কুলগুলোতে ঈদ উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া আমেরিকার পোস্ট অফিসের পক্ষ থেকে বিশেষ স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয়। ২০০১ সাল থেকে মুসলমানদের প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে ইউনাইটেড স্টেটস পোস্টাল সার্ভিস (ইউএসপিএস) ঈদ স্ট্যাম্প প্রকাশ করে আসছে।
 

মিশরে ঈদে পরিবারের জন্য মিষ্টি প্রস্তুত করছেন এক গৃহিণী


কানাডা: আমেরিকার মতো কানাডায় বসবাসরত মুসলমানরাও ঈদের দিন পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে সময় কাটায়। সাধারণত এদিন তারা অফিস থেকে ছুটি নেয়। টরেন্টো, মন্ট্রিয়ল, ভ্যাঙ্কুভার, অটোয়ার মতো বড় শহরে কয়েক দফায় ঈদের নামাজ পড়ানো হয়। এদিন মুসলমানরা পরস্পরের বাড়িতে বেড়ানোর পাশাপাশি বিখ্যাত ওপেন হাউজে সম্মিলিত হয়ে উৎসব উদযাপন করে। শিশুদের জন্য ঈদের সালামির পাশাপাশি দিনব্যাপী থাকে চকোলেট, মিষ্টি ও মজার সব খাবারের ব্যবস্থা। তবে এদিন দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য মুসলমানরা স্থানীয় ফুড ব্যাংকে অর্থ দান করে। কানাডার নতুন আইনে ঈদের জন্য দুই থেকে তিনদিন স্কুল বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। কারণ ইসলাম সংস্কৃতিতে ঈদ বড় ধরনের ছুটির উৎসব হিসেবে স্বীকৃত।

মিয়ানমার: বার্মিজরা সুজির তৈরি এক ধরনের মিষ্টি খাবার তৈরি করে। এছাড়া ঈদ উৎসবে মাংস ও বাদাম দিয়ে ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি তৈরি করে।

মরক্কো: অন্যান্য দেশগুলোর মতো মরক্কোর মুসলমানরা ঈদের নামাজ পরার মধ্যে দিয়ে দিনের শুরু করে। এরপর পরিবারের সবাই একত্রিত হওয়ার প্রচলন রয়েছে। দেশটির অন্য উৎসবগুলোর মতো ঈদেও বিভিন্ন খাবারের আয়োজন থাকে। নারীরা ঈদের আগের দিন বিভিন্ন ধরনের খাবার ও পিঠা তৈরি করে। সকালের নাশতায় পুদিনা পাতার চায়ের সঙ্গে ‘মেসেমেন’ ও ‘বাঘরির’ নামের পিঠা খাওয়া হয়। পুরুষরা মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী জুতার সঙ্গে জেলাবা বা জাবাদোর (djellaba or jabador) নামক পোশাক পরে থাকেন। অন্যদিকে নারীরা পরেন ‘কাফতান’ পোশাক।

ফিলিস্তিন: নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে যাওয়া ও ঈদের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ঈদের দিন শুরু হয়। ফিলিস্তিনিদের নারীরা ঈদের আগের দিন রাতে কায়েক নামে এক ধরনের মিষ্টি খাবার তৈরি করে, ঈদের দিন তা মসজিদে এনে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। নামাজ শেষে মৃত আত্মীয়স্বজনদের কবরে গিয়ে দোয়া প্রার্থনার প্রচলন আছে। ফিলিস্তিনিরা ঈদের দিন আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। খাবার দিক থেকে ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রিয় ভেড়ার মাংস। ধনীরা আস্ত ভেড়ার রোস্ট তৈরি করে, অন্যরা ভেড়ার মাংস দিয়ে ‘মানসাফ’ নামে এক ধরনের খাবার রান্না করে।
 

কাবুলে ঈদের নামাজ শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়


জর্দান: মধ্যপ্রাচ্যের দেশ জর্দানে ঈদ পালন হয় আতিথেয়তার মাধ্যমে। ঈদের তিন দিন পর্যন্ত তারা আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। তাদের আতিথেয়তার মূলে থাকে অ্যারাবিক কফি ও চকোলেট। নারীরা খেজুর দিয়ে বিভিন্ন রেসিপি তৈরি করে অতিথিদের মাঝে পরিবেশন করে।

সিঙ্গাপুর: দেশটিতে ঈদের দিনটিকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘হরি রয়া পসা’। রমজান মাস আসার পর থেকেই মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ঈদের আমেজ শুরু হয়। বাড়িঘর, দোকানপাটে আলোকসজ্জা করা হয়। সুলতান মসজিদ ও আরব স্ট্রিট অঞ্চলে মুসলমানদের বসবাস। ঈদের দিন নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে নামাজ আদায় করে তারা। এদিন বন্ধু ও আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে ঈদ উদযাপন করে।

কুয়েত: মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় কুয়েতে বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই ঈদ পালন হয়। তিন থেকে চার দিন ঈদের আমেজ থাকে। ঈদের দিন নতুন পোশাক পরে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে কুয়েতিরা পরস্পরের সঙ্গে সৌহার্দ্য বিনিময় করে। ছোটদের ঈদী দেয়া হয়। সেমাই খাওয়া হয়। এদিন অন্য খাবারের সঙ্গে বিশেষ আয়োজনে থাকে ভেড়ার মাংসের নানা রেসিপি। পুরুষদের তলোয়ার নৃত্য বা আর্ধা প্রদর্শনের রীতি প্রচলিত আছে। 

ইরানে ঈদের দিন দান করার বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়। অভাবগ্রস্তদের মাঝে অর্থ ও বিভিন্ন খাবার বিতরণ করা হয়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ৫ জুন ২০১৯/মারুফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়