ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাংলাদেশের রহস্যময় তিনটি স্থান

মনিরুল হক ফিরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ১৩ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশের রহস্যময় তিনটি স্থান

ডেস্ক রিপোর্ট : পৃথিবীজুড়ে রয়েছে কতশত রহস্য। হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলীর মতো প্রচণ্ড যুক্তিবাদী লোকেরাও অনেক সময় রহস্যের কাছে মাথা নত করেছেন। তৈরি করেছেন অমীমাংসিত ফাইল। আজ আপনাদের এমন তিনটি রহস্যের কথা বলব যা বাংলাদেশেই রয়েছে। যার সমাধান এখনো হয়নি। চলুন জেনে নেই এই তিনটি রহস্য সম্পর্কে।

গানস অব বরিশাল
উনবিংশ শতাব্দীতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশাল এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিকট শব্দ শোনা যেত। ব্যাখ্যা করা যায় না এমন শব্দগুলোকে একত্রে বলা হয় মিস্টপুফার্স। বরিশালের মতো ভারতের গঙ্গা নদীর তীর, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, স্কটল্যান্ড, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ফিলিপাইন, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর সাগরসহ আরো কিছু এলাকায় এ ধরনের শব্দ শোনা গেছে। ১৮৭০-এর দিকে প্রথমবারের মতো বরিশাল গানসের কথা নথিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায়। তবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই এটি শোনা যেত বলে নথিপত্রগুলোতে উল্লেখ করা হয়। ১৮৮৬ সালে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির হিসাব অনুযায়ী খুলনা, বরিশাল, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, হরিশপুর প্রভৃতি স্থানে বরিশাল গানস শোনা গেছে। বরিশাল গানস কেবল গাঙ্গেয় বদ্বীপ নয়, ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপেও শোনা গেছে। যেসব বিকট শব্দ শোনা যেত তার সঙ্গে ঢেউয়ের শব্দের চেয়ে কামানের গোলা দাগার শব্দের বেশি মিল ছিল। কখনো কখনো একবার শব্দ শোনা যেত, আবার কখনো দুই বা তিনবার শব্দ একসঙ্গে শোনা যেত। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল থেকে শব্দগুলো বেশি শোনা যেত।

প্রথম দিকে ব্রিটিশদের ধারণা ছিল শব্দগুলো জলদস্যুদের কামান দাগার আওয়াজ, কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজি করেও কোনো জলদস্যু জাহাজ বা ঘাঁটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। কবি সুফিয়া কামাল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তাঁর শৈশবে এ ধ রনের রহস্যময় বিস্ফোরণের শব্দের কথা তিনি মুরুব্বীদের কাছে শুনেছেন। তাঁর কথায়, ১৯৫০ এর পরে তিনি কখনো এই শব্দ আর কেউ শুনেছে এমন কথা শোনেননি।

বরিশাল গানস প্রকৃতপক্ষে কীভাবে উদ্ভূত হয় সে সম্পর্কে বেশ কয়েকটি প্রকল্প অনুমান করা হয়েছে, তবে এদের কোনটিই প্রমাণিত হয়নি। ভূমিকম্প, বজ্রপাত, মোহনায় ঢেউয়ের ধাক্কা প্রভৃতির সঙ্গে এর তুলনা করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন সাগরে কোনো গ্যাস ফিল্ড অথবা কোনো মৃত আগ্নেয়গিরির শব্দ। যেহেতু কোনো প্রমাণ মেলেনি তাই এটা এখনো রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।

খুলনার ভূতের বাড়ি
বাড়ির দুজন বাসিন্দা আত্মহত্যা করেছেন। যে কারণে অন্যরা বহু আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। সেখানে এখনো রাতে নারী কণ্ঠের খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পান অনেকে। আবার কখনো অশরীরী ছায়ামূর্তিও দেখেছেন বলে অনেকের দাবি। সব মিলিয়ে শহরবাসীর কাছে পরিত্যক্ত এই বাড়িটি ‘ভূতের বাড়ি’ নামে পরিচিত। খুলনা শহরের খানজাহান আলী রোডের টুটপাড়া কবরস্থানের পাশে এই বাড়ির অবস্থান।

কথিত আছে, রাজা দয়ারামের এক ভাগিনির নাম ছিল শীলা। তিনি রাজার তহসিলদার অমূল্য ধনের পুত্র নিশিকান্তের প্রেমে পড়েন। দুজন পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই দ্রুত বিয়ে দেওয়া হয় শীলা রানীকে নিধুরাম নামের এক যুবকের সঙ্গে। শীলা রানী ও নিধুরামকে উঠতে হয়েছিল পরিত্যক্ত এই ভূতের বাড়িতেই। শীলা নিধুরামের সঙ্গে এলেও তাকে স্বামী হিসেবে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। এজন্য তার দেহ তিনি নিধুরামকে স্পর্শ করতে দেননি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ বাড়তে থাকে। এক রাতে শীলা আত্মহত্যা করেন। শীলার পরিণতি দেখে নিধুরামও আত্মহত্যা করেন। সকালে ঘরে দুজনের লাশ দেখে চাকর-বাকরও ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এই থেকেই বাড়িটি নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এই ভূতের বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করার জন্য জামায়াতে ইসলামী নেতা মওলানা এ কে এম ইউসুফ একাত্তরের মে মাসে এই বাড়িতে ৯৬ জন জামায়াত যুব ক্যাডার নিয়ে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলেন। শোনা যায় ‘রাজাকার’ নামটি তিনিই দিয়েছিলেন। এটাই ছিল একাত্তরের প্রথম রাজাকার ক্যাম্প। ভূতের বাড়িটি বর্তমানে আনসার ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এতকিছু ঘটে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ভবনটি সম্পর্কে ভীতিকর ধারণা পোষণ করে। কবরস্থানের পাশে হওয়াতে এই ভীতি আরো বেড়ে গেছে।

চিকনকালা গ্রাম
মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের অন্যতম উঁচু আর সবচেয়ে দুর্গম গ্রামগুলোর একটি ‘চিকনকালা’। এ অঞ্চল একদমই যেন পৃথিবীর বাইরে। মুরং সম্প্রদায়ের এই গ্রামটির অবস্থান বাংলাদেশ-বার্মা নো-ম্যানস ল্যান্ডে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭০০ ফুট উপরে অবস্থিত চিকনকালা গ্রাম। গ্রামের লোকজনের ধারণা, অতৃপ্ত অপদেবতার বাস রয়েছে গ্রামটির জঙ্গলে। প্রতি বছর হঠাৎ একদিন কোনো জানান না দিয়েই বনের ভেতর থেকে বিচিত্র ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়। শব্দ শুনলে গ্রামের শিশু-বৃদ্ধ সবাই আতঙ্কে জমে যায়। তারা মনে করে, পিশাচের ঘুম ভেঙেছে। বনের ভেতরে থাকা কাঠুরে বা শিকারীর দল ভয় পেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবছরই এক দুজন পিছনে রয়ে যায়। তারা আর কোনোদিন গ্রামে ফিরে আসে না। কদিন পরে হয়তো জঙ্গলে তাদের মৃতদেহ আবিষ্কার হয়। সারা শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। কিন্তু লাশের চেহারা দেখে মনে হয় সাংঘাতিক ক্লান্ত আর ভয়ঙ্কর কোনো কিছু দেখে আতঙ্কে অস্থির। কী দেখে ভয় পেয়েছে আর কীভাবে কোনো ক্ষতচিহ্ন ছাড়া মারা গেছে, সেই রহস্য এখনো চিকনকালার লোকেরা ভেদ করতে পারেনি।

এই ছিল রহস্যময় তিনটি জায়গা। রহস্য না হয় থাকুক রহস্য হিসাবে। সব রহস্য ভেদ হয়ে গেলে আর মজা কোথায়?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জুন ২০১৯/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়