ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চে গুয়েভারা: বিপ্লবী চেতনার অনন্ত উৎস

দীপংকর গৌতম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৪ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চে গুয়েভারা: বিপ্লবী চেতনার অনন্ত উৎস

|| দীপংকর গৌতম ||

আমাদের যার কিছু নাই রে

কেউ নাই যে-

ভাত খাই না, আলো পাই না

কালো ফাটা পা, আর চলে না।

জমি ফুটিফাঁটা, রেশনিং কাটা

কেউ দেখে না, কেউ শোনে না।

ফাটা হাত তাই শূন্যে জাগাই

মুষ্টি করি, শ্লোগান ধরি-

ভেতরেতে কে? কমরেড চে।

(অনুবাদ : দীপংকর গৌতম)


আর্নেস্তো চে গুয়েভারা (১৪ জুন, ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭)। এই নাম বিশ্বব্যাপী বিপ্লবী প্রেরণার এক অনন্ত উৎস। বহু পরিচয়ে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যায়। মার্ক্সবাদী বিপ্লবী তো বটেই, এর বাইরে তিনি চিকিৎসক, লেখক, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সমর তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম আর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না। তবে তিনি পৃথিবীর মানুষের কাছে কেবলমাত্র ‘চে’ নামেই বেশি পরিচিত।

তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। সেসময় ওই অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। এই ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে- ওই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো- একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান বিশ্ব বিপ্লব। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বৈপ্লবিক আদর্শের চেতনা বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তাঁর সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর পরিচয় হয়। চে তাঁদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদদপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য চে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। অনতিবিলম্বে চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে তিনি গৌরবময় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। আর এভাবেই চিকিৎসক চে হয়ে ওঠেন আমৃত্যু এক বিপ্লবী। 

চে কবিতাপ্রেমী। পাবলো নেরুদার ‘ক্যান্টো জেনারেল’ তাঁর প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। যদিও কবি হিসেবে তাঁর পরিচিতি আমরা খুব একটা পাই না।  কবি পাবলো নেরুদা ঠিকই বলেছেন, ‘তাঁর জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে কবিতা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে।’ সে বিচারে বলা যায়, কবিতা চে’র ছুটে চলার, বিপ্লবী নেশার প্রেরণা। কবিতা যে তাঁর জীবনের কতটা জুড়ে ছিল এর প্রমাণ মেলে তারুণ্যে, তার পাঠাভ্যাসে। সেখানে মার্ক্স-এঙ্গেলস, ফ্রয়েড  ছাড়িয়ে কবিতাই প্রধান। এর মধ্যে লাতিন আমেরিকার কবিতাই ছিল তার প্রিয়। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। ডায়েরি লেখক হিসেবেও চে’কে আমরা চিনি। আজ বিশ্বব্যাপী তার ডায়েরি পঠিত হয়। সেখান থেকে তরুণ প্রজন্ম নেন নতুন কোনো বিপ্লবের প্রেরণা।

সেই উনিশ বছর বয়সে যখন বিপ্লবের স্বপ্ন তার মনে  জেগে ওঠেনি তখনই তিনি দেখেছেন তার বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত দেহ। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মনে- তিনি কি ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলেন? বলিভিয়ার অখ্যাত গ্রামে বুলেটে-ঝাঁঝরা তার দেহ?  মৃত্যু নিয়ে লেখা তাঁর কবিতা শুধু বিস্ময়কর নয়, বরং মনে করিয়ে দেয় স্পেনীয় কবি লোরকার নিজ মৃত্যু নিয়ে লেখা কবিতার কথা। দু’য়ের মধ্যে আশ্চর্য মিল! দু’টোই অদ্ভুতভাবে সত্য হয়ে ওঠে তাদের জীবনে; তাদের যেন ভবিষ্যতদ্রষ্টার মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। হ্যাঁ, লড়াইয়ে তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই তার কবিতা সত্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিপ্লব মৃত্যুহীন। যে কারণে পৃথিবীব্যাপী উচ্চারিত হয় সেই অমর পঙ্‌ক্তি- চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

একথা আজ আমরা সবাই জানি, বিশ্বের নিপীড়িত, শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য চে সংগ্রাম করেছেন। যে কারণে তাঁর নাম ষাট ও সত্তরের দশকে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া তথা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে বিপ্লবের সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদের মূর্ত প্রতীক। দার্শনিক জ্যাঁ পল সার্ত্রে তাঁকে আমাদের কাছে ‘একজন সম্পূর্ণ মানুষ’ হিসেবে পরিচয় করিয়েছেন। যেখানেই বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভব করেছেন চে ছুটে গেছেন। মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন। তাঁর চেতনার মন্ত্রবলে মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে। ছুটে গিয়ে রুখে দিয়েছে শোষণের হুঙ্কার। শোষকের বন্দুকের সামনে দাঁড়াতেও তাঁরা তখন দ্বিধা করেনি। এগুলো করতে গিয়ে জীবনকে তিনি অবলীলায় তুচ্ছজ্ঞান করেছেন। মনে পড়ছে ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর দিনটির কথা। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট বলিভীয় সেনাবাহিনীর হাতে আহত অবস্থায় বন্দি হন চে। পরদিন ৯ অক্টোবর তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহ গুম করে ফেলা হয়। কিন্তু বিপ্লবী চেতনাকে যে গুম করা যায় না, হন্তারকরা বুঝে উঠতে পারেননি। তাই যত দিন গেছে চে আরো জীবিত হয়ে উঠেছেন। বিশ্বের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর চেতনার মর্মবাণী। আজ এই আমৃত্যু বিপ্লবীর জন্মদিন। রইল তাঁর প্রতি গভীর প্রণতি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়