ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

প্রশ্ন রেখে চলে গেলেন রাফা

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:১৭, ১৩ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রশ্ন রেখে চলে গেলেন রাফা

নিজস্ব প্রতিবেদক : ২৩ বছরের তরুণী জারিন তাসনিম রাফা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন, একজন নামকরা চিকিৎসক হবেন। সমাজের অসহায় গরিব মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেবেন। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি সিঁড়ি বেয়ে স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি এসেও তা অধরাই রয়ে গেল তার।

আদ দ্বীন উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী জারিন তাসনিম রাফা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় মারা গেছেন। তার ভাই রিদওয়ানুল ইসলাম অর্ণব  ফেসবুকে বিষয়টি জানিয়েছেন। তিনি দিল্লি থেকে লিখেছেন, ‘আমার বোন জারিন তাসনিম রাফা আজ রাত সাড়ে ৩টায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সবাই ওর জন্য দোয়া করবেন। আর কিছু লিখতে পারছি না।’

গত ২৮ জুন দিল্লির বি এল কাপুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে রাফার বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়। এরপর রাফার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। রাফার মা বলেছিলেন, ‘আমার মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ। আমার মেয়ের ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবার পর থেকে যে যুদ্ধ করে যাচ্ছে তা নিজ চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। শরীরের সব জায়গায় ওর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খাওয়া বন্ধ হয়েছে বহু আগেই। সবার কাছে ওর জন্য দোয়া কামনা করছি।’

আদ দ্বীন উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন জারিন তাসনিম রাফা। আর কিছুদিন পরই শিক্ষাজীবন শেষে শুরু হতো নতুন জীবন। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন ছিল একেবারেই কাছে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের আগেই থমকে যেতে হলো তাকে।

তিন মাস আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন রাফা। রোগ ধরা পড়ার পর দেশের বাইরে নিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি। তাকে নেওয়া হয় ভারতের বোম্বের টাটা মেডিক্যালে। সেখানে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন, তার বোনম্যারো পুনঃস্থাপন করতে হবে। যার চিকিৎসা ব্যয় প্রায় ৮০ লাখ টাকা। এ বিপুল পরিমাণ অর্থের ব্যবস্থা করা রাফার বাবার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। ইতোমধ্যে তার চিকিৎসায় প্রায় ২২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এর আগে অ্যাপোলো হাসপাতালে রাফাকে কেমোথেরাপি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। তখনই চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, দ্রুত তার বোনম্যারো পুনঃস্থাপন করা প্রয়োজন। নয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।

পটুয়াখালীর গলাচিপার বাশতলা গ্রামের এম এ বাশারের মেয়ে রাফা। পরিবারের সবাই দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীতেই থাকেন। পরিবারের বড় সন্তান রাফা। তার বাবা এম এ বাশারের নিউ মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা আছে। তবে গত বছরে ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ায় এখন তিনি আর কোনো কাজ করতে পারেন না। ছোট ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

এম এ বাশার বলেন, অনেক চেষ্টা করেও আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারলাম না। টাকার জন্য মেয়েকে চিকিৎসা করাতে পারিনি। কেমোথেরাপি দিয়েই রাখতে হয়েছে। ৮০ লাখ টাকার অভাবে মেয়েটা মারা গেল।

মৃত্যুর আগে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করা রাফা অসংখ্যবার তার ফেসবুকের মাধ্যমে সাহায্যের আকুতি জানিয়েছিলেন্। এমনকি প্রধানমন্ত্রী বরাবর খোলা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আজ না পেরে বাধ্য হয়ে আপনার কাছে খোলা চিঠি লিখছি। আমি জানি না, ঠিক কোন ঠিকানায় আর ফোন নম্বরে আমি আপনাকে খুঁজে পাব। তাই খোলা চিঠি লিখে দিলাম, কেউ যদি দয়া করে আমার এই আহাজারি আপনার নিকট পৌছায়!

আমার বয়স ২৩। আমি একজন ফাইনাল ইয়ারের মেডিকেল ছাত্রী। আজ আড়াই মাস ধরে মৃত্যুর সাথে লড়ছি! আমার একিউট মায়েলোব্লাস্টিক লিউকেমিয়া বা এক ধরনের ব্লাড ক্যান্সার যা মধ্যম পর্যায়ে ধরা পড়ে। এখন আমাদের দেশের বিভিন্ন অভিজ্ঞ ও স্বনামধন্য ডাক্তাররা আমাকে বলেছেন, হাতে বেশি সময় নেই। আমাকে দ্রুততম সময়ে অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্ল্যান্টে যেতে হবে, যা বাংলাদেশে এখনো শুরু হয়নি এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে যার উন্নত চিকিৎসা রয়েছে কিন্তু অত্যন্ত ব্যায়বহুল (৮০ লক্ষ টাকা), যা আমার মধ্যবিত্ত বাবা মায়ের পক্ষে ব্যায় করা সম্ভব নয়।

কেমো নিয়ে নিয়ে আমরা সর্বশান্ত। আরও যত দেরী হবে ততই কেমো খরচ এবং আমার মৃত্যুঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। আমার জীবনের শুরুতেই আজ মেঘের অন্ধকার নেমে এসেছে। হায়াত আল্লাহর হাতে, তবু চেষ্টা করে দেখতে যদি পারতাম! যদি আমার চিকিৎসাটা হতো! যদি আপনাদের মাঝে ফিরে আসতে পারতাম! আপনি তো কত অসহায়ের পাশে ছিলেন, কত পিতামাতাহারা সন্তানের দায়িত্ব নিয়েছেন, আমিও এই দেশের এবং আপনারই সন্তান তবে কেন আমাকে বুকে টেনে নেবেন না, এই দিনে? আমি মানি, আমি বিখ্যাত সাবিনা ইয়াসমীন না, আমি ছোটখাটো একজন মেডিকেল ছাত্রী। তাই বলে কি আমার জীবনের কোন মূল্যই নেই? বেঁচে থাকলে দেশের জন্য আমি কি কিছুই করতে পারতাম না? আমিও তো মেডিকেল কমিউনিটিরই একজন। প্রতি মুহূর্তে আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এক একদিন সময় আমার জীবনের প্রদীপ নিভিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। দেশমাতা! আপনি কি এই অসহায় মেয়েটির বেঁচে থাকার এই যুদ্ধে শামিল হবেন?’

অনেকে রাফার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সাহসও দিয়েছেন। ২৬ মে রাফা তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘এতদিন আমি একাই ব্লাড ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলাম, এখন আমার হয়ে পুরো বাংলাদেশ লড়ছে! এভাবে মৃত্যুও অনেক শান্তির! যখন শরীরের কষ্ট অসহনীয় হয়ে ওঠে, চোখ ফেটে পানি গড়িয়ে পড়ে, তখন আমার মনে পড়ে, আমার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ লড়ে প্রতিদিন, হাজারো আশীর্বাদের হাত আমার মাথায়। প্রতিদিন হাজারো ফোন কল আর ম্যাসেজ শ্রদ্ধেয় এবং স্বনামধন্য প্রফেসরদের। আরে! তোর কিচ্ছু হবে না! সিনিয়র, জুনিয়ররা সবাই আমার জন্য এখানে ওখানে কোথায় না দৌড়ায়। যদি নাও হয় পুরো টাকার জোগান, যদি বেঁচে নাও থাকি সব মনে থাকবে... আর যতদিন বেঁচে থাকব! মনে থাকবে...’

এর আগে ২৪ মে নিজের ফেসবুকে জারিন লিখেন, ‘আমার একটা প্রশ্ন পুরো ডাক্তার সমাজের কাছে! একজন ডাক্তার মারা যাচ্ছে টাকার অভাবে, আপনারা চেয়ে চেয়ে দেখবেন? দেশের লক্ষাধিক প্রফেসর, ডাক্তাররা এগিয়ে আসলে কি আমি বাচঁতে পারতাম না? মৃত্যুর আগে এই প্রশ্নটা রেখে গেলাম।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জুলাই ২০১৮/সাওন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়