ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

আত্মহত্যা নিয়ে কুসংস্কারগুলো দূর হোক

সাবিহা জাহান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আত্মহত্যা নিয়ে কুসংস্কারগুলো দূর হোক

আফ্রিদা তানজীম মাহির একটি চিত্রকর্ম

সাবিহা জাহান: লেখার বিষয়বস্তু জীবন নিয়ে, জীবনের কথা বলতে চাই আজ। যদিও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে মুদ্রার অপর পিঠ নিয়েও আলোকপাত করার প্রয়াস থাকবে। তথাপি এই লেখাটা জীবন নিয়েই, তা জোর দিয়ে বলতে চাই এবং পাঠককে আহ্বানও করতে চাই জীবনের প্রতি।

আমরা মনোবিজ্ঞানীরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে, প্রত্যেকটা মানুষের জীবন অজস্র গল্পের সমন্বয়ে তৈরি। অর্থাৎ আমাদের জীবন নানা ধরনের, নানা বিষয়ের, নানা আকারের গল্প দিয়ে তৈরি হয় যা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা আদৌ নয়। অনেকগুলো ঘটনা পুঁতির মতো সুতা দিয়ে গাঁথতে গাঁথতে আমরা এক একটা গল্পের মালা তৈরি করি। কোনো কোনো গল্পের মালা অনেক বড় করে গাঁথতে থাকি, আবার কোনো কোনো মালা আমরা বড় করি না বা করতে চাই না। অসমাপ্ত করে রাখি। এই বিষয়গুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো আফ্রিদার আত্মহত্যার বিষয়টি শোনার পর থেকেই। আমি বলছি, শিল্পী আফ্রিদা তানজীম মাহির কথা। যিনি অতিসম্প্রতি জীবনের পথে চলতে চলতে চিরতরে থেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বারবার খালি মনে হচ্ছে তার জীবনের গল্পগুলো কেমন ছিল? কোন গল্পগুলো তাকে বলতো- আমার শিল্প হলো আমার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রমাণ? আর কোন গল্পগুলো তার অস্তিত্বকে ছিনিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলো? মাহি কি তার জীবনের গল্পগুলো কাউকে বলেছিলো অথবা বলতে চেয়েছিলো? আমরা কি তার গল্পগুলো শুনতে পেয়েছিলাম অথবা বুঝতে চেয়েছিলাম? দৃষ্টিপাত করতে হয় মুদ্রার অপর পিঠে, যাকে আমরা বলি আত্মহত্যা।

কোন একক কারণ দিয়ে আত্মহত্যার মতো জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করা যায় না। আত্মহত্যাকে সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে সম্মিলিত অবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও কিছু ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে আবেগের বশবর্তী হয়েও ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু সাধারণত মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে একে মানুষের আচরণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রয়োজন সচেতনতা সবপর্যায়ের এবং সবার। গবেষণা অনেক রকমের কথা বললেও কিছু উন্নত দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি পাওয়া যায়। কোনো কোনো গবেষণা এমনও প্রকাশ করে যে, বৈশ্বিকভাবে আত্মহত্যা হল ২য় প্রধান মৃত্যুর  কারণ যাদের বয়স ১৫-২৯ এর মধ্যে। এর থেকে কি আমরা কোনো সংকেত বা শিক্ষা পেতে পারি?

নানান কারণে একজন মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার ইতিহাস আছে (নিজের বা পরিবারের কারো) এমন মানুষ আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। আরো কিছু ব্যাখ্যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধ বা বিপর্যয়, দৈনন্দিন ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক চাপ মোকাবিলা করতে না পারা, একাকিত্বে ভোগা, বৈষম্যের স্বীকার হওয়া, নির্যাতনের স্বীকার হওয়া, আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন, মানসিক কোনো চাপ বা রোগ থাকলে একজন মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকতে পারে। এতো গেল সাধারণ কিছু কারণ যা মানুষকে ঝুুঁকিতে ফেলে দেয়। যা দেখে সমাজের সাধারণ মানুষ সচেতন হতে পারেন। আবার আমাদের মধ্যে আত্মহত্যা নিয়ে কিছু কুসংস্কার কাজ করে যা আমাদের সচেতন হতে বাধা দেয় এবং জীবনের গল্পগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যেমন:

কুসংস্কার ১: যারা আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলে তারা আসলে আত্মহত্যা করে না। কিন্তু সত্যটা হলো: যারা আত্মহত্যার কথা বলে তারা হয়তো এর মাধ্যমেই তার জীবনের কোনো না কোনো গল্পের কথা বলতে চায় এবং সাহায্য কামনা করে। অনেকেই আছে যারা আত্মহত্যার আগে তাদের উদ্বিগ্নতা, বিষণ্নতা এবং হতাশার কথা বলতে চায় যা তাকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যাচ্ছে।

কুসংস্কার ২: বেশিরভাগ আত্মহত্যা হঠাৎ করে ঘটে, কোন সংকেত দেয় না। এ কথাটিও সত্য নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যক্তি কোনো না কোনো সংকেত প্রদান করে তার আশেপাশের মানুষকে। এটা প্রকাশিত হতে পারে এবং অপ্রকাশিত বা আচরণগতও হতে পারে। হ্যাঁ, অবশ্য এর ব্যতিক্রমও হতে পারে তবে জরুরি বিষয় হলো সংকেতগুলো জানা।

কুসংস্কার ৩: যার মধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা এবং প্রবণতা থাকে সে আসলে মরতেই চায়। এখানে সত্যটা হলো: প্রকৃতপক্ষে, কিছু মানুষ থাকে যারা জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে দ্বন্দ্বে ভোগে। তার মানে এই না যে তারা নিজেকে শেষ করে ফেলতে চায়। ধরা যাক, কেউ হয়তো ঝোঁকের বশে কিছু করে ফেলল বা বিষ খেয়ে ফেলল এবং কিছুদিন পর মারা গেল। তাদের মধ্যেও বেঁচে থাকার তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। সঠিক সময়ে আবেগীয় এবং মানসিক সমর্থন অনেক সময় আত্মহত্যা সফলভাবে প্রতিরোধ করতে পারে।

কুসংস্কার ৪: কেউ যদি আত্মহনন করার চেষ্টা করে তবে বুুঝতে হবে তার মধ্যে সবসময়ই আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে যায়। সত্য হলো: তীব্র মাত্রার আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশিরভাগ সময়ই ক্ষণস্থায়ী এবং কোননা তা কোনো পরিস্থিতি নির্ভর হয়ে থাকে। আত্মহত্যার চিন্তা ব্যক্তির মধ্যে ফিরে আসলেই যে তা স্থায়ী হবে এমন নাও হতে পারে। অনেকেই আছেন তার পূর্বের আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা থেকে বের হয়ে অনেক দূর চলে গেছেন তার জীবনের পথে।

কুসংস্কার ৪: মানসিক রোগ বা অসুস্থতা যাদের আছে তারাই কেবল আত্মহত্যা করে। এটিও সব সময় সত্য নয়। আত্মহত্যা নির্দেশ করে কোনো ব্যক্তির মধ্যে তীব্র অসুখী অনুভূতি যা সবসময় মানসিক রোগ নাও হতে পারে। অনেক মানসিক রোগী আছেন যারা কোনোদিনও আত্মহত্যার কথা ভাবেন না। আবার অনেকেই আছেন যারা মানসিক রোগী না কিন্তুু আত্মহত্যা করার চিন্তা করেন।

কুসংস্কার ৫: আত্মহত্যা কথা বললে বা প্রচার করলে মানুষ আরো আত্মহত্যা করার প্ররোচনা পাবে। এটি সঠিক নয়। সত্য হলো: অনেক সময়ই যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে তারা জানে না কোথায় কার সাথে কথা বললে সে তার জীবনের গল্পগুলো বলতে পারবে বা মনের কষ্টের গল্পগুলো বলে হালকা হতে পারবে।

লেখা শুরু করেছিলাম মাহির জীবনের গল্পগুলোর প্রতি মনোবৈজ্ঞানিক কৌতূহল ব্যক্ত করে। তা অব্যাহত রাখতে চাই শেষ পর্যন্ত। জানি না মাহি কোনো গল্প বলতে চেয়েছিলো কিনা, যা এই অসচেতন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং স্টিগমা আক্রান্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে আমরা আদতে শুনতে বা বুঝতে পারিনি। দায়টা নিতেই হচ্ছে। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। তবুও আক্ষেপটা যেন ছাপিয়েই ওঠে। দেশ ও জাতির জন্য তরুণদের গতি যেখানে তীব্র হওয়া প্রয়োজন সেখানে এমন থেমে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতিই নির্দেশ করে। আমরা নিশ্চয়ই চাই না এমন ক্ষতি আরো হোক। সচেতন হই, আত্মহত্যা প্রতিরোধ করি। জীবনের গল্পগুলোকে বড় করি, মৃত্যুর  গল্প নয়।



লেখক: ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, ঢাবি

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়