ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের আগ্রহ কমছে কেন

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ২ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অভিভাবকদের আগ্রহ কমছে কেন

অলোক আচার্য : প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রথম ধাপ। সব ধরণের যুগোপযুগী পদক্ষেপ নেয়ার পরও সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোর প্রতি অভিভাবকদের আস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি বছরই প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে। তথ্য মতে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ২০১৫ সালে ভর্তি হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬১ জন। পরের বছর ২০১৬ সালে ১ কোটি ৮৬ লাখ ২ হাজার ৯৮৮ জন এবং ২০১৭ সালে ভর্তি হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার ৩৫০ জন। শেষ বছরে ভর্তি কমেছে আগের বছরের চাইতে ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৩৮ জন। তবে এর মধ্যে আশার কথা হলো শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমলেও গত তিন বছরেই কমেছে শিক্ষার্থী ঝরে পরার হার। এটাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি বড় সাফল্য।

শিক্ষার্থী হার কমতে থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর আস্থাহীনতা বাড়ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ অন্যদিকে দেশে অলিতে-গলিতে,বিল্ডিংয়ের কোণায় ব্যাঙের ছাতার মত কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা তারা সেরকম কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডারগার্টেনে উপেক্ষিত। কারণ তাদের নজরদারি করার কেউ নেই। বছরের শুরুতেই নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে তারা। আশপাশের এলাকার বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে চলে রীতিমত প্রতিযোগিতা। অভিভাবকরাও আজকাল কেবল ফল পেতে আগ্রহী। যে প্রতিষ্ঠানে ভালো ফল হয়, সেখানে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য তারা অধীর হয়ে ওঠে। ডোনেশন দিয়ে হলেও ভর্তি করাতে ব্যাস্ত হন। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে মফস্বল এলাকার অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর আসন ফাঁকা থাকে। তাহলে সমস্যা কোথায়? কেন এত সুযোগ-সুবিধা দেয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রতি তাদের অনাগ্রহ। কারণ ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে।

সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ডিজিটাল করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিচ্ছে। তাছাড়া সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা রয়েছে এবং ইতিমধ্যেই অনেক এলাকায় তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আর শিক্ষকের কথা বললে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছেন তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও রয়েছে বৃত্তি সুবিধা। এছাড়াও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ,স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। এগুলোর কোনোটিই আমাদের সময়ে ছিল না। এখন সরকারিভাবে তা করা হচ্ছে। অপরদিকে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে লেখাপড়া করা শিশুদের মাসে মোটা টাকা বেতন দিতে হয়, অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। কিন্তু তারপরও সেখানেই অভিভাবকদের আস্থা জন্মেছে। অথচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে না।

এ ক্ষেত্রে প্রথমেই একটা প্রশ্ন আসে- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা চাকরি করেন তাদের সন্তানরা সবাই কি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে? অনেক সময় দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা প্রায়ই এলাকার নামীদামি কোনো কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করছে। নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াতে আস্থা না থাকে, তাহলে অন্য অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এটা একটা কারণ; কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে। আমি কিন্ডারগার্টেনের উপর ভরসা করলে অন্যরা তা করবেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি অনেকটা দীর্ঘ বলে মনে হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। অপরদিকে দেশের কিন্ডারগার্টেনের সময়সূচি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বারোটার আগেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী বাড়ি ফেরে। বিষয়টি নিয়ে দেশের শিক্ষাবিদরা গবেষণা করতে পারেন। একটু কমানো বা সময়সূচি নতুন করে করা যেতে পারে। আর একটা বিষয় হচ্ছে, একজন সহকারী শিক্ষক হিসেবে যখন যোগদান করেন তখন পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক বা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে বা তার চেয়েও বড় পদে চাকরির আশা করতে পারেন। কিন্তু অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে এখানে ততটা নেই। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হলেও সেই প্রক্রিয়া খুব দীর্ঘ।

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অভিভাবকরা কিন্ডারগার্টেনমুখী হচ্ছেন। অথচ প্রাথমিক শিক্ষায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে সরকার। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারি চাকরিজীবির কতজন তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করান। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের সন্তান কোন নামীদামি কিন্ডারগার্টেনে পড়ে। প্রশ্ন যখন নির্ভরতার তখন নিজেকে দিয়েই শুরু করা উচিত। এর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক পড়ানোর প্রজ্ঞাপন শিক্ষা অধিদপ্তর জারি করলেও তা বাতিল করা হয়। নিজেই যদি নিজের ঘরে বিশ্বাস না রাখতে পারি তবে অন্য অভিভাবক কেন বিশ্বাস করবে? কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বছর গেলেই বৃদ্ধি পাবে এটা নিশ্চিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিযোগিতা হয়। আর প্রতিযোগিতার মূল বিষয় নির্ভরতা। একথা এখন নিশ্চিত যে কারিগরি সুযোগ সুবিধার চেয়ে শিক্ষার মানের নিশ্চয়তা এবং ফল বেশি প্রভাব ফেলে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কারিগরি সুযোগ-সুবিধা কিন্ডারগার্টেনগুলোর চেয়ে বেশি। তারপরও যে তারা ছাত্রছাত্রী বেশি পাচ্ছে, তার কারণ ঐ একটাই- শিক্ষার মান। তাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুরও এদিকেই বেশি নজর দিতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়