ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ওয়ানস্টপ সেল গঠন করা জরুরি : বিজিএমইএ সভাপতি

নিয়াজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৪, ২১ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওয়ানস্টপ সেল গঠন করা জরুরি : বিজিএমইএ সভাপতি

বিজিএমইএর সভাপতির সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন রাইজিংবিডির অর্থনৈতিক প্রতিবেদক নিয়াজ মাহমুদ (ছবি : শাহীন ভূঁইয়া)

তৈরি পোশাকশিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ওয়ানস্টপ সেল গঠন করা জরুরি বলে মনে করেন পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান।

 

সম্প্রতি রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিজিএমইএ ভবনে তার কার্যালয়ে রাইজিংবিডিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান।

 

রাইজিংবিডির অর্থনৈতিক প্রতিবেদক নিয়াজ মাহমুদকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্যাসের স্বল্পতা আছে। সরকার এলএনজি গ্যাস আমদানি ও সরবরাহের কথা ভাবছে। এ বিষয়গুলো অবিলম্বে জনসমক্ষে আসা উচিত। এতে উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে, এখন থেকে তারা বিদ্যুৎভিত্তিক নাকি গ্যাসভিত্তিক কারখানা করবেন। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা, সর্বোপরি একটি জ্বালানি নীতি একান্ত প্রয়োজন।’

 

পোশাক মালিকদের শীর্ষ এই নেতার সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী আলাপচারিতায় গুরুত্ব পায় বর্তমান তৈরি পোশাকশিল্প খাতের সমস্যা-সম্ভাবনা ও আগামী বাজেট প্রসঙ্গ। কথোপকথনের সারাংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

 

রাইজিংবিডি : বর্তমানে পোশাকশিল্প খাতের অবস্থা কী?

সিদ্দিকুর রহমান : পোশাকশিল্প বর্তমানে একটি ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এ শিল্পকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।

 

রাইজিংবিডি : চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধি কেমন?

সিদ্দিকুর রহমান : এ সময়ে পোশাকশিল্পে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। এটি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) আমাদের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২.৯৮ শতাংশ। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের কিছু বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এর পেছনে পোশাকশিল্প মালিকদের যেমন ভূমিকা আছে, তেমনি সরকারের নীতিসহায়তাও ভূমিকা রাখছে। সবচেয়ে বড় অবদান আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের। এ জন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, শিল্পের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা দিনে দিনে কমছে।

 

রাইজিংবিডি : রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরে পোশাক খাত কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে?

সিদ্দিকুর রহমান : রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ও রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে বিপর্যয় ঘটেছিল। সে সময় আমরা ক্রেতাদের আস্থা হারাতে বসেছিলাম। সেই আস্থা ধরে রাখার জন্য অনেক উদ্যোক্তা লাখ লাখ টন পণ্য এয়ার শিপমেন্ট করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে ডিসকাউন্ট, ক্যানসেলেশন, ডেফার্ড পেমেন্টের শিকার হয়ে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীনও হয়েছিলেন। সে অবস্থাতেই আমরা শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের কথা ভেবে এবং অব্যাহত রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অক্ষুণ্ন রাখতে শ্রমিক ভাইবোনদের মজুরি বাড়িয়েছি। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের ক্রমাগত দরপতন, স্থানীয় পর্যায়ে অব্যাহত উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মুদ্রাগুলোর বিপরীতে আমাদের মুদ্রা শক্তিশালী হলেও শুধু শিল্পকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে মুনাফার দিকে না তাকিয়ে লোকসান দিয়ে উৎপাদন করেছি। সে সময়কার ক্ষতি অনেকেই এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

 

রাইজিংবিডি : ক্রেতারা কি পোশাকের মূল্য বাড়াচ্ছে না?

সিদ্দিকুর রহমান : সারা পৃথিবীতে সবকিছুর দাম বাড়লেও একমাত্র তৈরি পোশাকের দাম কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পোশাক পণ্যের দাম ৪০ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরেও এই দরপতনের ধারা অব্যাহত আছে। অপরদিকে, প্রতিবছর আমাদের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে ৮-১০ শতাংশ হারে। দরপতন ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির চাপে আমরা যখন পিষ্ট হচ্ছি, তখন প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের মুদ্রা শক্তিশালী হওয়া আমাদের অবস্থাকে আরো সঙিন করে তুলেছে।

 

রাইজিংবিডি : ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখছেন?

সিদ্দিকুর রহমান : অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের মাধ্যমে কারখানাগুলোকে যে রিমেডিয়েশন প্ল্যান দেওয়া হচ্ছে, তা বাস্তবায়ন করতে একটি ক্ষুদ্র/মাঝারি শ্রেণির কারখানাকে গড়ে ৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়, ক্ষেত্রবিশেষে যা ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছায়। উপরন্তু, একটি কারখানা নিরাপত্তা সংস্কার বাবদ ৫ কোটি টাকা খরচ করলে ৭ শতাংশ ডেপ্রিসিয়েশন (অবচয়) বাবদ বছরে অতিরিক্ত ব্যয় হয় প্রায় ৩৫ লাখ টাকা,  যা নিঃসন্দেহে একটি বাড়তি চাপ।  

 

রাইজিংবিডি : স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

সিদ্দিকুর রহমান : প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও গ্যাসলাইন কিংবা নতুন সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে অনেক পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিরাপদ কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য কারখানা স্থানান্তর করতে চাইছে। অনেক নতুন কারখানা গ্রিন হয়েছে, আবার অনেক কারখানা গ্রিন হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু গ্যাসের অভাবে কারখানা সচল করতে পারছে না। গাজীপুর জেলার চান্দোরা, পূর্ব চান্দোরা, তেলিপাড়া, সালনা, সফিপুর, কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, ভোগড়া, ভাসন, মালেকের বাড়ী, গাজীপুর চৌরাস্তা ও গাজীপুর সদর এলাকায় তৈরি পোশাকশিল্পে গ্যাসের চাপ অত্যন্ত কম থাকায় ওই এলাকাগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারখানাগুলোর মেশিন বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

আমাদের গ্যাসের স্বল্পতা আছে। সরকার এলএনজি গ্যাস আমদানি ও সরবরাহের কথা ভাবছে। এ বিষয়গুলো অবিলম্বে জনসমক্ষে আসা উচিত। এতে উদ্যোক্তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যে, এখন থেকে তারা বিদ্যুৎভিত্তিক নাকি গ্যাসভিত্তিক কারখানা করবেন। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা, সর্বোপরি একটি জ্বালানি নীতি একান্ত প্রয়োজন।

একইভাবে আমরা বিদ্যুৎ সমস্যাও মোকাবিলা করছি। যদিও প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের তৈরি হয়েছে। উৎপাদন হচ্ছে ৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আবার আরইবি যে সঞ্চালন লাইনগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ করছে, সেগুলোর দুরবস্থার কারণে অনেক লোডশেডিং হচ্ছে। আমরা শিল্পে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। আমাদের ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পোশাক খাতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ওয়ানস্টপ সেল গঠন করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

 

রাইজিংবিডি: অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহণের সুযোগকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সিদ্দিকুর রহমান : আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই যে, সরকার আমাদের ৫ শতাংশ সুদে অফশোর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে আমাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদের হার অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশে যেখানে সুদের হার ১২-১৪ শতাংশ, সেখানে চীনে সুদের হার প্রায় ৬.৫০ শতাংশ। এত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন যুক্তিযুক্ত নয়।

 

রাইজিংবিডি : দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করা সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ কী?

সিদ্দিকুর রহমান : গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট ও ব্যাংক সুদের হার বেশি থাকায় শিল্পে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে অর্থনীতিতে যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। গত দুটি অর্থবছরে আমাদের দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ৬ লাখ লোকের। যেখানে  প্রতিবছর শ্রমবাজারে ২০ লাখ লোক যুক্ত হচ্ছেন। বেসরকারি খাতে পোশাকশিল্প নারীদের জন্য সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে এবং আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নারীদের সমঅংশগ্রহণ অপরিহার্য। এই বিবেচনায় পোশাক খাতের দিকে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।

 

রাইজিংবিডি : আসছে অর্থবছরে কেমন বাজেট চান?

সিদ্দিকুর রহমান : বাজেট হতে হবে জনবান্ধব। শুধু একপক্ষকে সুযোগ-সুবিধা দিলেই হবে না। সব খাতকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আর করের পরিমাণ না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর প্রতি সরকারকে নজর দিতে হবে।

 

রাইজিংবিডি : আসছে বাজেটে পোশাক খাতের পক্ষে কী কী প্রস্তাব দিয়েছেন?

সিদ্দিকুর রহমান : জাতীয় অর্থনীতি ও রপ্তানির বৃহত্তর স্বার্থে তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য ১০ শতাংশ হ্রাসকৃত হারে করারোপের মেয়াদ আগামী ৫ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা। সেই সঙ্গে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য উৎসে কর কর্তনের হার ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মতো করার জন্য অনুরোধ করছি। শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প ভ্যাটমুক্ত হলেও রপ্তানিসহায়ক সেবাগুলোর ওপর ভ্যাট প্রযোজ্য রয়েছে। রপ্তানিসহায়ক সেবাগুলো ভ্যাটমুক্ত করার জন্য অনুরোধ করছি। এ ছাড়া কারখানাকে নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, কমপ্লায়েন্ট ও পরিবেশবান্ধব করতে যেসব অগ্নিনির্বাপক ও আধুনিক বিদ্যুৎসাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়, সেসব যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ শুল্কমুক্তভাবে আমদানির অনুমোদন দিতে অনুরোধ করেছি।

 

প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত দেশে পরিণত করার রূপকল্প ঘোষণা করেছেন। এটি করতে হলে আরো শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পোশাকশিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ করের বোঝা না চাপিয়ে অর্থনীতিতে এর সামগ্রিক অবদানগুলো বিবেচনা করে প্রত্যক্ষ করের আওতামুক্ত রাখলে সামগ্রিক অর্থনীতি বেশি লাভবান হবে।

 

রাইজিংবিডি : মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সিদ্দিকুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ। ধন্যবাদ রাইজিংবিডি পরিবারকে।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মে ২০১৬/নিয়াজ/রফিক/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়