ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বাঙালি সংস্কৃতির বৈশ্বিক প্রকাশ ঘটবে: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২১, ১৪ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাঙালি সংস্কৃতির বৈশ্বিক প্রকাশ ঘটবে: সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সমকালীন বাংলা সাহিত্যে ভাষা-দুর্বলতা, অভিজ্ঞতা ও গবেষণার অভাব মাড়িয়ে যে ক’জন গল্পকার পাঠক সমাদৃত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অন্যতম। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। নাগরিক জীবনে বৈশাখ, এই আনন্দযজ্ঞে পুঁজিবাদী আগ্রাসন, মৌলবাদী আস্ফালন এমনকি মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক বিষয়ে তাঁর ভাবনা নিয়ে এই কথোপকথন। যেখানে উঠে এসেছে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের প্রত্যাশা এবং আমাদের করণীয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু বকর ইয়ামিন

রাইজিংবিডি: নাগরিক জীবনে বৈশাখি উৎসবের চর্চা বেড়েছে- বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: এটি অবধারিত ছিল। কারণ নগর মানেই হচ্ছে আবদ্ধ জায়গা এবং সেখানে মানুষের স্বাধীনতা অনেকটাই বিঘ্নিত হয়। যারা বিত্তশালী তাদের চিত্তবিনোদনের অনেক উপায় থাকে কিন্তু যারা নিম্নবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত তাদের জন্য প্রতিদিনের জীবন একটা ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে পড়ে যায়। মানুষ নিয়মের দাস নয়, মানুষ নিয়ম থেকে মুক্তি চায়। সে জন্য যেকোনো উৎসব বা পালা পার্বণ মানুষকে সেই মুক্তির স্বাদ দেয়। জীবন যত জটিল হয় মানুষ ততই বিনোদনের উপায় খুঁজতে থাকে। আগে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ ধরনের বিনোদনপিয়াসী মানুষ খুব কম দেখা যেত। কারণ জীবন জটিল ছিল না, জীবনের অবসর ছিল, আনন্দ ছিল। কিন্তু এখন জীবন এতই যন্ত্রশাসিত যে মানুষের ক্ষুধা থাকে বিনোদনের জন্য, আনন্দের জন্য।

আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি, এটা তো আমাদের শোকের দিন এবং পুরো মাসটাই শোকের কিন্তু একটা সময় শোককে মানুষ শক্তিতে পরিণত করেছে। এখন উদযাপনের মাসে পরিণত করেছে। আমরা কী উদযাপন করি? আমাদের ভাষার শক্তি, আমাদের সংস্কৃতির শক্তি, আমাদের শহীদদের আমরা হৃদয়ে ধারণ করে একটা শক্তি খুঁজে তাদের অবদান আমরা উদযাপন করি। ফলে এই শোকের মাসটাতেও দেখেছি আমি, মানুষ একটু চিত্তের খোরাকের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। আর মার্চ মাসটাও আমাদের জন্য কঠিন একটা মাস। ২৫ বা ২৬ মার্চ বাদ দিলেও এ কথা বলা যায়, ৭ মার্চ বহুদিন স্বীকৃত হয়নি। এখন ৭ মার্চ সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কারণটা হচ্ছে এই, যেভাবেই হোক, একটা দিন উপলক্ষ হিসেবে পাওয়া। এই একই কারণে বাঙালি পয়লা বৈশাখকে আবার পুনঃআবিষ্কার করেছে। এবং খেয়াল করে দেখবে, যখন এই উদযাপনটা শুরু হয় তখন আমাদের একটা দৈন্যদশা চলছিল। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় হলে ছিলাম তখন কয়েকটা হলের ছেলেরা পানি উৎসব করত । কারণ চট্টগ্রামে বৈসাবিতে পানি খেলা হয়। চাকমা, মারমা, রাখাইন সম্প্রদায়ের পানি উৎসব হয় পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে। তো সেই বন্ধুদের হাত ধরে ঢাকাতেও পানি উৎসব শুরু করি । কিন্তু এই পানি উৎসব খুব অমলিন একটা উৎসব ছিল। দুপুরবেলা পর্যন্ত চলত।

রাইজিংবিডি: এখন হলগুলোতে এ উৎসব দেখা যায় না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
না। এটা আমাদের সময়ে ছিল; ৭২-৭৩ সালের কথা বলছি। ৭৪ সালের দিকে দেখলাম, কোথাও কোথাও কিছু উদযাপন শুরু হয়ে গেছে। কারণ তখন একটা অভাবের দিন ছিল। কঠিন একটা দিন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ এবং সম্ভাবনাগুলো খুব সংকটাপন্ন ছিল। এরপর তো ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। তারপর একধরনের সামরিক শাসন আমাদের ওপর চেপে বসল। একটা পাকিস্তানি চিন্তাভাবনার পুনর্জাগরণ ঘটল। এটি লজ্জাজনক এবং দুঃখজনক একই সঙ্গে। তখন পর্যন্ত ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের কথা বলি, অথবা পয়লা বৈশাখের যত উদযাপনের কথা বলি, সেগুলো জোরেশোরে শুরু হয়নি। এরপর এরশাদের আমল চলে এল।  তখন আমরা একধরনের দ্বন্দ্বের ভেতর নিপতিত হলাম। আমরা কি এই গণতন্ত্র চেয়েছিলাম? ছাত্রসংগঠনগুলো খুব সক্রিয় ছিল। তখন এই ক্যাম্পাস একটা আদর্শিক যুদ্ধের ভূমি ছিল। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল তাদের নিজস্ব সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের জন্য অ্যাকশন নিল । ওই সময় পয়লা বৈশাখটা আবার নতুন মহিমায় উদ্ভাসিত হলো। অর্থাৎ যখনি আমাদের ক্রান্তিকাল গেছে তখন আমরা শক্তি খুঁজেছি আমাদের শিকড় থেকে। আর পয়লা বৈশাখ আমাদের গ্রামীণ শিকড় । এটা আমাদের এত পুরোনো একটা শিকড় যে, আমরা বলি সম্রাট আকবরের সময় এর শুরু হয়েছিল।

আমি মনে করি, নববর্ষের বা ফসল ফলানোর যে মৌসুম থাকে ফসল কাটার মৌসুমটা; এই উৎসবগুলো একেবারে সর্বজনীন। এগুলোর একটা রূপ পরিগ্রহ করেছে পয়লা বৈশাখ। আর দ্বিতীয় একটা কারণ বলে শেষ করি, প্রকৃতিও সে সময় নতুন রূপে সাজে। এই যে আমাদের শীত শেষ হয়, বসন্ত চলে আসে। বসন্তের পরপর একদম গরমের কালটা শুরু হচ্ছে। এই গরমের প্রথম দরজাটা হচ্ছে বৈশাখ। তো আমরা বোধ হয় ওই উত্তাপটা আমাদের নিজেদের মধ্যে ধারণ করি। একটা উৎসবে রূপ দিই।

রাইজিংবিডি: আমরা একটা জিনিস দেখি যে, এই উৎসবগুলোর সঙ্গে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িয়ে পড়ছে। এটা ভালো না খারাপ?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
না। এটাকে খারাপ বলব না আমি। কারণ যেখানে একটা চাহিদা থাকে এবং সরবরাহ থাকে, সেখানে বাজার সৃষ্টি হয়ে যায়। এখন আমাদের যে তরুণ প্রজন্ম পয়লা বৈশাখের উৎসবের শামিল হলো, এরা গ্রামের পিঠা কোনো দিন খায়নি সত্যিকার অর্থে । গ্রামে থেকে একটা নারিকেল পেড়ে গাছ থেকে তারা সেটা কোনো দিন খায়নি। এদের অনেকের কোমল পানীয় হচ্ছে কোকাকোলা। অথবা ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টে বসে কিছু সময় কাটানো। শুধু যে উচ্চবিত্ত ছেলেরা এমন করে তা নয়, আমি মধ্যবিত্ত ছেলেদেরকেও দেখেছি। একটা বার্গার নিয়ে তিনজনে মিলে খাচ্ছে। কিন্তু বসে আনন্দ করছে। এদের কাছে যখন মোবাইল ফোন এল, কাজেই মোবাইল ফোন কোম্পানি বা কোমল পানীয় কোম্পানি তারা যখন স্পন্সরশিপ নিয়ে এগিয়ে এল, তখন মানুষ বিষয়টি খুব সহজভাবে গ্রহণ করল। তাদের উদ্দেশ্য বাজার সৃষ্টি।

আমাদের কতগুলো উৎসব আছে যেগুলো ধর্মীয় নয়, সর্বজনীন উৎসব। পয়লা বৈশাখটাও ওরকম সর্বজনীন। ফলে আমরা যখন এই উৎসবে শামিল হই তখন আমরা আমাদের ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এগুলো থেকে ওপরে উঠে একটা সর্বজনীন আনন্দের সন্ধান করি এবং বিনোদনের সন্ধান করি। তাতে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সুযোগ বুঝে এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে তাদের স্বার্থে। তারা কি আমাদের অন্য কিছুতে স্পন্সর করছে না? এখন খবরের শিরোনাম হচ্ছে, অমুক ইস্পাতের শিরোনামে। আবার বাণিজ্য সংবাদ কিনে নিচ্ছে আরেক দল। এই যদি অবস্থা দাঁড়ায় তাহলে দেখা যাবে কিছুদিন পর আমাদের হয়তো সিলেবাস যারা প্রণয়ন করছি; অমুক ব্যাংক সিলেবাস। এটা হতেও পারে, বলা তো যায় না।

আমরা এই বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন ঠেকাতে পারব না । কারণ আমাদের যত উন্নতি করতে হবে অর্থনৈতিক ততই আমাদের এই পুঁজির আচ্ছাদন করতে হবে । উপায় নেই। এখন আমরা এই পুঁজির ব্যবস্থাপনাতেই এগিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। ভবিষ্যতে ৮ শতাংশ হবে। সেগুলো ওই বৈশ্বিক পুঁজির আচ্ছাদনেই হচ্ছে। ফলে ওই বাজার থেকে আমরা কখনো দূরে থাকতে পারব না। যেটা করতে হবে ওই বাজার যেন আমাদের সংস্কৃতির ভেতর অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঢুকিয়ে দিতে না পারে, সেটি দেখতে হবে। আমি তরুণ সম্প্রদায়কে এই জাগ্রত চেতনার অধিকারী হতে বলব। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আমরা নেব আমাদের স্বার্থে । আমরাও যদি আমাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখি, অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটাতে না দিই তাহলেই তো সেখানে একটা ভারসাম্য হয়ে গেল। ভারসাম্যটাই আমি চাচ্ছি। ভাগাভাগি। নাও তোমাদের কিছু লাভের অংশ নিয়ে নাও, আমাদের লাভটা হচ্ছে তোমাদের ব্যবহার করে আমাদের নতুন শিল্পী পাচ্ছি। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যেতে পারছি। এবং অনেক মানুষকে উৎসবে শামিল করতে পারছি। আয়োজনটা তাদের সহযোগিতায় পরিপূর্ণতা পেতে পারে।

রাইজিংবিডি: আপনার ছেলেবেলার বৈশাখ কতটা আপনাকে আন্দোলিত করে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
ছেলেবেলার বৈশাখ বলে সেরকম কিছু ছিল না। চৈত্রসংক্রান্তি হতো। আমি সিলেটে যেখানে বড় হয়েছি আমাদের বাসা ছিল মণিপুরি রাজবাড়ির কাছে। তো মণিপুরিদের একটা অবস্থান ছিল। তারাই ছিল আমাদের পাড়ায় সংখ্যাগুরু। তারপর ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। মুসলমান আমরা কয়েক ঘর ছিলাম। ফলে আমি বেড়ে উঠেছি তিনটি সংস্কৃতির মিলনে। এবং আমাদের ওই মাঠে চৈত্রসংক্রান্তির মেলা হতো । মেলাটা ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক। কারণ, বেলুন কিনতে পারতাম, পুতুল কিনতে পারতাম। তারপর যত রকমের সুখাদ্য কিনে এনে খেতাম। এবং এই মেলাটা আমাকে মনে করিয়ে দিত যে, আমাদের বৈশাখ বুঝি অসম্ভব সুন্দর একটা ঘটনা।

আর বৈশাখের দিন আমাদের যারা প্রতিবেশী ছিল তাদের বাসায় বিশেষ রান্না হতো। দেখা যেত আমাদের বাসাতেও বেশ কিছু বিশেষ রান্না হচ্ছে। কারণ, যখন একটা বাড়ি থেকে বিশেষ খাদ্য আসছে, তখন তাদেরও কিছু একটা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল । এটা কিন্তু এখন আর নেই। তো পয়লা বৈশাখের স্মৃতি হচ্ছে যে, আমার সবার সঙ্গে মিলে সবার অংশগ্রহণে সম্মিলিত একটা উদযাপন। এবং সে উদযাপনে বাহুল্য ছিল না। এ জন্য আলাদা কোনো জামাকাপড় ছিল না।

আরেকটা বিষয় ছিল আমরা দোকানে দোকানে ঘুরতাম। বাতাসা এবং মিষ্টি কিনতাম। হালখাতা। লাল রঙের যে খেরো খাতা সেগুলো বদল হতো। সে অনুষ্ঠানে আমরা যেতাম। সেখানে বাতাসা বা মিষ্টি একটা তো পাওয়া যেত। মহাজনপট্টি নামে একটা জায়গা ছিল । সেটি ছিল ব্যবসাকেন্দ্র। দোকান, আড়ত  ছিল। সেখানের প্রতিটি দোকানে হালখাতা হতো। আর সেখানের মিষ্টি এবং বাতাসা আমরা শার্টের মধ্যে করে নিয়ে আসতাম। আসতে আসতে খেতাম সবাই মিলে।

রাইজিংবিডি : বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু আমরা এখনো এই মানসিকতায় পৌঁছতে পারিনি। দেখা যাচ্ছে, গ্রামীণ জীবন এবং আমাদের শহুরে জীবন নিয়ে বেশ বড় তফাত এখনো রয়ে যাচ্ছে। আসলে এটা কেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
এটা তো খুবই অবধারিত যে, সমাজ বিভাজিত। শ্রেণিবিভাজন আছে, শিক্ষার বিভাজন আছে। বিভাজনটা আমরা মেনে নিচ্ছি কিন্তু আমাদের দায়টা তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছি। দরিদ্র বলছি। বলছি না আমরা ধনী। দরিদ্র বলছি ওদের । ‘দরিদ্র’ শব্দটার মধ্যে একটা নেতিবাচক ভাব চলে আসে। আমাদের দেশে সব সময় একটা প্রতিযোগিতা বিরাজমান। সন্তানকে শেখানো হয়, তুমি প্রথম হও। বলা হয় না তুমি তোমার সাথে প্রতিযোগিতা করো। বলা হয় পড়াশোনায় প্রতিযোগিতা করে তোমাকে প্রথম হতে হবে। অর্থাৎ আমি এবং অন্য এই বিভাজনটা অটোমেটিক তৈরি হয়ে যায়। এবং যখন বিত্তের বিভাজন আসে তখন তো বিত্ত সব সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ জন্য দারিদ্র্য একদিন দূর হবে, এটা কিন্তু একেবারে ভুল ধারণা। সম্পদ নিজের সুরক্ষার জন্য দারিদ্র্য তৈরি করবে। দরিদ্র যদি না-ই থাকে তবে ধনী মানুষের আনন্দটা কোথায়? আমি যদি আমার গাড়িটা শহরের রাস্তায় রিকশার মাঝখান দিয়ে নিয়ে নাই ঘুরলাম তাহলে আমার গাড়ি কিনে লাভ কী?

এই যে চমকের সমাজ। সময়টা তো চমকের সমাজের। এবং এই চমকের সমাজে এটিই অবধারিত। এখন যেটা প্রশ্ন, সর্বজনীন উৎসবটার একটা উপলক্ষ থাকে যখন বিভাজন থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হয়। কিন্তু সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের শহর গ্রামের বিভাজন। গ্রাম থেকে নিয়ে আসছি আমরা উৎসবটা। আবার প্যাকেজিং করে গ্রামেই ফেরত দিচ্ছি। আর সেই প্যাকেজিংয়েই তাদের দরিদ্র বলা হচ্ছে। সুবিধাবঞ্চিতরা, প্রান্তিক মানুষজন তারা বাদ পড়ে যাচ্ছে।

আর দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের সাম্প্রদায়িকতা তো আছে। আমাদের রাজনীতির হাত ধরে, উগ্রবাদের হাত ধরে এবং কিছু কিছু নতুন যে শক্তি বাংলাদেশে গজিয়েছে, ওদের হাত ধরে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। সাম্প্রদায়িকতা বিষবাষ্প ছড়ায় সবখানে। তো এই ধরনের চিন্তা এখন বিশ্বের সর্বত্র, শুধু বাংলাদেশে না। বার্মাতেই দেখো, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর উগ্রতা দেখাচ্ছে। এটি কি বৌদ্ধধর্ম সমর্থন করে? আমি মনে করি গৌতম বুদ্ধ সবচেয়ে দুঃখিত মানুষ। যখন তিনি দেখেন তারই ভিক্ষুরা শান্তির প্রতীক যাদের বলা হচ্ছিল, তারা এই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার করছে, মেয়েদের ধর্ষণ করছে। এর থেকে নিম্নশ্রেণির আর কি হতে পারে? তো এটা আমরা একার সমস্যা না। আমাদের দেশের একা দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু আমাদের যেহেতু একটা সংস্কৃতি আছে, পয়লা বৈশাখ আমাদের শেখাচ্ছে সবার সাথে সবার হৃদয়ের মেলা।

আমাদের সংস্কৃতির ভেতর এ ধরনের উগ্রতা বা সাম্প্রদায়িকতা চলতে পারে না। আমার মনে হয় ক্রমাগত একটা স্রোত ভেতরে তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। বিভাজনটা বাড়ছে। খুব মূল্যবান একটা প্রশ্ন। আমি আগের প্রশ্নে যেরকম একটা প্রস্তাব রেখেছিলাম তরুণদের প্রতি, এ প্রস্তাবটা আমি রাখতে চাই আমাদের সংস্কৃতির যে শক্তি আছে, আমাদের আশপাশের দেশগুলো থেকেও আমাদের সংস্কৃতিটা অনেক বেশি সমৃদ্ধিশালী। এবং আমাদের সংস্কৃতিতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বলে যাদের বলি তাদের সংস্কৃতিরও একটা শক্তি জড়ো হয়েছে।

তারপরও বিভাজনটা সত্যি সত্যি বাড়ছে। আমি তরুণদের বলব, আমাদের সংস্কৃতির যে শক্তি আছে, আমাদের সমাজের যে সংহতি আছে, আমাদের সমাজের যে সহনশীলতার একটা ব্যাপার ছিল সেটি যেন আমরা বিস্মৃত না হই। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ধর্মে থাকব, ধর্মের সত্যিকার বাণীগুলো জীবনে বাস্তবায়ন করব। আমরা যেন উন্নত চরিত্রের মানুষ হতে পারি, আমাদের নীতিবোধ যেন থাকে। যে মানুষগুলো নীতিমান তাদের কাছে এই উৎসব অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। তারা বিভাজন বিশ্বাস করে না। আমি আশাবাদী ভবিষ্যতে এদের সংখ্যা আরো বাড়বে।

রাইজিংবিডি: বৈশাখি উৎসব গ্রাম থেকে শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু গ্রামগুলোতে এখন আর চৈত্রসংক্রান্তি, বৈশাখি উৎসব সেভাবে হয় না। অথচ একুশে ফেব্রুয়ারি শহর থেকে গ্রামে চলে যাচ্ছে- এর কারণ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
ওই যে বললাম, প্যাকেজিং করে তো গ্রামের জিনিসই আমরা ফেরত দিচ্ছি, তারাও গ্রহণ করছে। কিন্তু গ্রামের যে আদি উৎসব ছিল পয়লা বৈশাখে সেটা কিন্তু ফিরে আসছে। সেটিও অনেক সময় আমরা আমাদের প্রয়োজনে আবিষ্কার করছি। এবং করতে গিয়ে দেখলাম ওইখানে সত্যিটা। গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এই সত্যিটা আমরা অর্জন করতে পারি না । ফলে এটাও এখন শুরু হয়ে গেছে। আমি গ্রামে তো অনেক ঘুরি সুযোগ পেলেই। দু-তিন বছর আগে গ্রামে গিয়েছিলাম পয়লা বৈশাখে এবং সেখানে যে মেলাটা দেখলাম মনে হচ্ছিল ছোটবেলার সেই মেলা। পার্থক্য হচ্ছে, সেই মেলায় ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে। কোকটোকও আছে, ডাবও আছে, যা আমার জীবনে প্রথম দেখলাম। যার যেটা খুশি খাচ্ছে।

আরেকটা জিনিস বলি, যত বেশি উৎসব হবে তত বেশি মানুষের শুদ্ধতা বাড়বে। কারণ পয়লা বৈশাখের সময় যেটা হয় আমরা একসময় দেখেছি কিছু মানুষ অত্যন্ত নোংরা। প্রত্যেক সমাজেই আছে। সেই নোংরামি ভারতের হোলি উৎসবেও ঘটেছিল। কিন্তু তাদের পুলিশ যেহেতু জাগ্রত, অপরাধীদের ধরে নিয়ে গেছে। কোনো মাফ নেই। আমাদের দেশের পুলিশ তো আবার রাজনীতিকরা ফোন করলে অপরাধীদের ছেড়ে দেয়। কিন্তু যখন প্রতিরোধটা বেড়ে উঠবে, দেখা যাবে এরা তখন আর জায়গা পাবে না। এবং যখন দেখবে যে, শুদ্ধ চর্চাটা হচ্ছে, তখন তার নিজেরও মনে হবে,  কেন আমি এটি করেছি? এ জন্য আমাদের এই উৎসবগুলোর প্রয়োজন আছে।

রাইজিংবিডি: ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে। বৈশাখ সেভাবেই পালিত হবে। কিন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
বিভাজনের কোনো মানে নেই। যশোর থেকে হোক, চারুকলা থেকে হোক উভয়কেই স্বীকৃতি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যেন স্বার্থপর না হই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মিডিয়ার নজরে এসেছে চারুকলার শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহাসিক একটা ঐতিহ্য আছে। মঙ্গল শোভাযাত্রার বাণীটাতেই উল্লেখ থাকে-সবার মঙ্গল কামনা। আমাদের মতো এত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কারোরই নেই। একটা সুশীল, মনোহর উৎসব আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছোট-বড় সবাই পারিবারিক আবহে পালন করে এ উৎসব। এটা আমাদের নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। এটি নিয়ে বাড়াবাড়ির কিছু নেই। এটা সর্বজনীন উৎসব। কে আগে শুরু করেছে, কে পরে- এসব নিয়ে মাতামাতি না করে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে এক কাতারে এ উৎসবে মিলিত হই। সবাই সবাইকে ভালোবাসতে শিখি। এটা কেউ কারো পকেটে রাখবে না। এখানে অংশ নেবে ঢাকার শিশু, রাঙামাটির কিশোর, সাতক্ষীরার তরুণ, পঞ্চগড়ের যুবক, রংপুরের বৃদ্ধ। এটা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ। এটি নিয়ে বাড়াবাড়ির কোনো প্রয়োজন নেই।

রাইজিংবিডি: ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুসারে দিবসটি পালনে কোনো ভিন্নতা আসবে কি না?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
হতে পারে এটা একটা মডেল হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের সংস্কৃতির যে নান্দনিকতা আছে সেটি বৈশ্বিকভাবে প্রকাশ পাবে। বিশ্ব দেখবে যে, এখানে কত নান্দনিক উপায়ে এত সুশীল, স্নিগ্ধ একটি উৎসব হতে পারে। যে উৎসবে পরিবারের সবাই একসাথে শামিল হতে পারে। আনন্দ করতে পারে। কালক্রমে এর বিস্তার ঘটবে।

রাইজিংবিডি: একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবে আপনি বৈশাখের প্রকৃতিতে কী দেখতে পান?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
এতে আমি উত্তাপ দেখতে পাই, দেখতে পাই একটা উদ্দীপ্ত যৌবন, শক্তি দেখি। কালবৈশাখির মতো ভেঙে দেবে, গুঁড়িয়ে দেবে। আবার নতুনভাবে গড়বে। ভাঙাগড়ার এ শক্তি যখন এক হয়ে যায় তখন একটা সৃজনশীলতা প্রকাশ পায়। সে শক্তি আমি প্রকৃতিতে দেখতে পাই। পয়লা বৈশাখে অনেক সৃজনশীলতার উপাদান আমি দেখতে পাই। এ শক্তিটা আমি প্রকৃতি থেকে পাই।

রাইজিংবিডি: বাঙালি জাতি হিসেবে বৈশাখ থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
বৈশাখের সর্বজনীনতা। সকলে মিলে একটা জায়গায় অভিন্নভাবে অংশগ্রহণ, নতুনভাবে জাগরণের শিক্ষা পাই। আনন্দ উপাদান খুঁজে পাই। পুরোদিন উদযাপনের একটি দিন। অথচ পরদিন থেকেই মানুষ আবার কাজে নেমে পড়ে। অবসরের প্রয়োজনীয়তা, আবার কাজের প্রয়োজনীয়তা শিখতে পারি। আবার নিজের ভেতর আত্মসচেতনতা বিরাজ করে। বৈশাখে মানুষ নতুনভাবে সাজে। এই যে নতুনভাবে সাজতে শেখা, নিজেকে ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ করতে শেখা- এটাও কম নয়। বৈশাখের নতুন মাত্রা আমাদের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি দেয়। প্রকৃতির সাথে হৃদ্যতা বাড়ে। উদারতা শিখতে পারি।

রাইজিংবিডি: দেশে জঙ্গিবাদের একধরনের আস্ফালন দেখতে পাচ্ছি। তারা এসব উৎসবের বিরুদ্ধে। আসলে উৎসবের কোন জায়গাটি নিয়ে তারা ভীত?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
তরুণদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। তরুণদের দোষ দিই না। তাদের সামনে কোনো মডেল আমরা দিতে পারিনি। অনুকরণীয় মানুষ কয়জন আছে? তারা দেখছে সমাজে দুর্নীতি, দেখছে অপসংস্কৃতি, স্থানীয় রাজনীতির সয়লাব। তাদের না দুষে আমরা তাদের জন্য কী মডেল দিচ্ছি সেটি দেখতে হবে। পারিবারিক বন্ধন মজবুত নেই। তবে আস্তে আস্তে এ জাতীয় প্রবণতা কমছে। আরো কমবে। মানুষ যত বেশি সচেতন হবে ততই এ জাতীয় চর্চা হ্রাস পাবে।

যারা ধর্ম প্রচার করছে তারাও বলছে এ ধরনের কাজ জঘন্য পাপ। ইসলাম এটি সমর্থন করে না। এখানে নৈতিকতার বড় প্রয়োজন। সবাই এসব জানে, কিন্তু করে না। কারণ যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে বা ব্যবসা করে তারা এসবে বাধা দিলে তো তাদের ব্যবসা টিকবে না। বৈশ্বিক রাজনীতি এত প্রবল যে আমরা সেখান থেকে বেরুতে পারছি না। প্রত্যেকে নিজের ধর্মের চর্চা বাড়ালে এসব অনেকাংশে কমে যাবে। মানবতাকে জাগ্রত করতে হবে।

রাইজিংবিডি: সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে বা ধর্মান্ধতা রুখতে হলে আমাদের এখন কী করা প্রয়োজন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম:
সত্যিকারের ধর্ম অনুসরণ করতে হবে। নিজ নিজ ধর্মের চর্চা বাড়াতে হবে। অনেক বেশি ভাবতে হবে। জ্ঞানের চর্চা বাড়াতে হবে। পশ্চিম আমাদের জ্ঞান থেকে দূরে রেখেছে। বৌদ্ধরা যদি গৌতম বুদ্ধের বাণী চর্চা করত, তাহলে কখনো রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করতে পারত না। শিক্ষকদের উচিত ছাত্রদের ধর্মের মৌলিক শিক্ষা দান করা। তাদের বুঝিয়ে দেওয়া এটা তোমার ধর্মের আদর্শ। এটা গ্রহণ করো। কিন্তু অনেক শিক্ষক সেটি করে না। কারণ সে চর্চা তো নিজের ভেতরেই নেই। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এসবের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন তা হলো সুনীতির চর্চা বাড়াতে হবে। আদর্শিক জায়গা থেকে ভাবতে হবে। মানবতাকে জাগ্রত করতে হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়