ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ইতিহাস বিকৃতির দায় অনেকেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না: কামাল লোহানী

পলিয়ার ওয়াহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইতিহাস বিকৃতির দায় অনেকেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না: কামাল লোহানী

ছবি: সংগৃহীত

প্রখ্যাত সাংবাদিক। পাশাপাশি রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার কণ্ঠে বিশ্ববাসী আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়বার্তা জানতে পারে। তিনি সেই কাঙ্ক্ষিত খবরটি পাঠ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই ভিন্ন অস্ত্রে সংগ্রামের দিনগুলোর কথা বলেছেন কামাল লোহানী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি পলিয়ার ওয়াহিদ।

পলিয়ার ওয়াহিদ: ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীন বাংলা বেতারে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রথম বার্তাটি লিখেছিলেন আপনি। বিশ্ববাসীর কাছে সেই বিজয় বার্তা পৌঁছেছিল আপনার উচ্চারণে। সেই স্মৃতির শস্যেরা আপনার অনুভূতিতে কেমন দোলা দেয়?
কামাল লোহানী:
সেই অনুভূতি, সেই আবেগ এখন বর্ণনা করা সত্যিই কঠিন। এবং সেই সময় প্রচণ্ড রকমের আবেগ, উত্তেজনা, প্রাপ্তি, অর্জন আমাদের ভীষণভাবে আপ্লুত করে ফেলেছিল। যখন ভারতীয় পূর্বাঞ্চালীয় কমাণ্ড মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী গঠন করা হলো, তারা নানাভাবে চেষ্টা করছিল আক্রমণ করতে। তখনই তো পরিস্থিতি পাল্টে গেল। বিজয়ের কয়েকদিন আগে ১২ কি ১৩ তারিখ বেতারে একটা লিফলেট আসে। আমাকে বাংলা ও উর্দু করার দায়িত্ব দেয়া হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেই উর্দু করার ব্যবস্থা করা হয়। কারণ আগে থেকেই উর্দু বিভাগ চালু হয়েছিল। সেখানে উর্দু হেডলাইন ছিল: ‘হাতিয়ার ঢালদো’ মানে ‘অস্ত্র সংবরণ করো’। এবং লিফলেটটা যখন আমরা অনুবাদ করে দিলাম তখন বুঝতে পারি যে, কোনো একটা প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত একটা সুখবর আমরা পাবো। সেখানে এমন কিছু বিষয় জানানো হয় যে, আমরা বুঝতে পারি বিজয় আসন্ন। বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল থেকে খবর আসতে থাকে। চারপাশে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অর্জিত হচ্ছে। বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে বিজয়ের খবর পাচ্ছি। তখন আমাদের উপলব্ধি হলো লিফলেট ছাড়ার পিছনের কারণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া। তো এই চূড়ান্ত পর্যায়ে কখন কীভাবে পৌঁছাব, কার মাধ্যেমে হবে?- এসব জানার জন্য ওয়েভ ট্রান্সমিটারে চেষ্টা করতে থাকি। এবং একটা সময় ইথারে সংযোগ পেয়ে যাই। এবং জানতে পারি, ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী  আত্মসমর্পণ করবে বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে। যখন মিত্র বাহিনীর প্রধান অরোরা ও পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর কথোপকথন হলো বুঝতে পারলাম বিজয় সুনিশ্চিত। এটা যখন জানতে পারলাম, স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে প্রবল আবেগ ও উত্তেজনা কাজ করতে থাকে। তখন আমরা সবাই বসে ঠিক করলাম, কীভাবে অনুষ্ঠান সাজাব? আমার দায়িত্ব হলো নিউজ করা। তো নিউজটা কীভাবে করা হবে? তখন আমরা রেকর্ডিং করতে বসলাম আমাদের ১নং স্টুডিওতে। দুটো স্টুডিও ছিল। আমি ও আশফাকুর রহমান খান, বেলাল মোহাম্মদ, রাশেদ, আমিনুর রহমান, শরফুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল ফারুক আরো যারা ছিল সবাই একসাথে বসলাম। বসার পর আমাকে সেই সংবাদ লিখতে হলো। লেখার পর যে জিনিসটা লক্ষ্য করলাম, প্রচলিত ধারায় রেডিওতে যে সংবাদ পাঠ করা হয় তাতে যে ধরনের শব্দ, বাক্য ও ভাষা ব্যবহার করতে হয় তা বিপ্লবী রেডিওতে হবে না। তবুও মুক্তি বাহিনীর বিজয়, পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা, তাদের হাত থেকে মাতৃভূমি বা দেশ মুক্ত করা, মোটামুটিভাবে এই রকম সংবাদই যাচ্ছিল। কিন্তু যখন ১৬ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের খবরটা এলো তখন তো আমাদের ভাষা বদলে গেল। এবং সঙ্গত কারণেই আমাদের ভাষাটা হলো অত্যন্ত কঠিন।

পলিয়ার ওয়াহিদ: কিন্তু সংবাদ পাঠ করার দায়িত্ব ছিল বাবুল আকতারের, আপনার পাঠ করার কারণ বিশেষ কিছু কি ঘটেছিল?
কামাল লোহানী: এটা কিন্তু সৈয়দ হাসান ইমাম পড়তে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রথমটা যেহেতু আমি পড়েছি, শেষটাও আমি পড়ব। সেটাই যুক্তিযুক্ত। অনেক দিন একসঙ্গে কাজ করার ফলে একটা শৃঙ্খলা তৈরি হয়ে গেছে। একটা রুটিনও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর আমার সংবাদ পাঠ নিয়ে মজার ব্যাপার আছে। তখন বাবুল আকতার দায়িত্বে ছিলেন। এটা বাবুল আকতারের পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু সমস্যাটা হলো বাবুল আকতার যখন রেকর্ডিং করতে গেল দেখা গেল এই সংবাদ যেভাবে পাঠ করতে হবে, মানে যে ভাষা বা উচ্চারণে এটা পড়া দরকার সেটা তিনি পারছেন না। বা যে রকম তেজ ও কণ্ঠের বলিষ্ঠতা দরকার সেটা হচ্ছে না। তখন আশফাকুর রহমান খান ও বেলাল মোহাম্মদরা বললেন, লোহানী ভাই এটা আপনাকে করতে হবে। আর কাউকে দিয়ে হবে না। বাধ্য হয়ে আমি পড়লাম। এবং তখনকার ওই মুহূর্তের যে আবেগ ছিল সেই আবেগ দিয়েই কাজটা সম্পন্ন করলাম। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না যে, আমি কত বড় কাজটা করলাম! সঙ্গে সঙ্গে শহিদুল ইসলামের লেখা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানটি বেজে উঠল। এবং আমরা সবাই মিলে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। তখনই আমি বুঝতে পারলাম আমি একটা বড় কাজ করে ফেলেছি। এবং আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। এটা আমার জীবনের একটা অসাধারণ অর্জন বা সাফল্য। যেটা আমার জীবনকে সবচাইতে বেশি ধন্য করেছে। কিন্তু এটা আমি কখনো কাউকে বলিনি। ২০১০ সালে বিটিভির একটা অনুষ্ঠানে ওরা বলল, আপনি বলবেন না কেন? সেখানে বেলাল মোহাম্মদ, আশফাকুর রহমান খান, আশরাফুল আলম আর আমি ছিলাম। তো সেখানেই প্রথম আমি পাবলিকলি বলি যে, ওই সংবাদটি আমার লেখা এবং আমারই পাঠ করা।

পলিয়ার ওয়াহিদ: অনেক আগে চ্যানেল আই-এর একটা অনুষ্ঠানে সৈয়দ হাসান ইমাম আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করেছিলেন- মনে পড়ে?
কামাল লোহানী: ওরে বাব্বা…! সেটাও জানো নাকি? সে এক ঘটনা বটে। সৈয়দ হাসান ইমামের পরিচালনা ও উপস্থাপনায় মুক্তিযুদ্ধের একটা গানের অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানে আমি একবার অতিথী হয়ে গেলাম। অনুষ্ঠান শেষের দিকে তিনি আমাকে বললেন, লোহানী আপনার বিরুদ্ধে আমার একটা অভিযোগ আছে। ১৬ ডিসেম্বরের নিউজটি আমি পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি পড়তে দেননি। সেখানে আমি তাকে বলেছিলাম যে, ব্যাপারটা ঠিক এ রকম নয়। বেতারের তো একটা রুটিন ছিল। নিয়ম অনুযায়ী বাবুল আকতারের পড়ার কথা। তাকে পড়তে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেটা পারেননি। তখনই তো সবার অনুমতি সাপেক্ষে আমাকে পড়তে অনুরোধ করা হয়। সত্যি কথা বলতে কি, আমিও বাধ্য হয়েই পড়েছিলাম এবং বলেছিলাম, আমি যদি পড়ি বিষয়টা খারাপ দেখাবে। কিন্তু সবাই বলল, আপনি না পড়লে জিনিসটা ভেস্তে যাবে। এটাই বাস্তবতা। আর আমার তো সারাজীবন ধারাবিবরণী লেখা ও পাঠ করার অভ্যাস ছিল। সুতরাং এটা আমার কাছে খুব বড় কোনো সমস্যা ছিল না।

পলিয়ার ওয়াহিদ: যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীন বাংলা বেতারের ভূমিকা কতটা জোরালে ছিল বলে আপনি মনে করেন?
কামাল লোহানী:
পৃথিবীর সমস্ত মুক্তি সংগ্রামেই বিপ্লবী বেতারের একটা জোরালো ভূমিকা থাকে। এবং মনস্তাত্বিক যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবেও বেতার সমস্ত মানুষের মনে শক্তি ও সাহস জোগায়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, রণাঙ্গনে, দেশ-বিদেশে, মুক্তিফৌজে যে সমস্ত মানুষ আমাদের সহায়তা করছে। অথবা যারা আমাদের বিরোধীতা করছে তারাও অন্ততপক্ষে যেন জানতে পারে কেন আমরা লড়াই করছি? কার বিরুদ্ধে লড়াই করছি? তো আমরা যারা কাজ করছিলাম, তাদের মধ্যে একটা বিষয় ছিল, আমরা শুধুই কাজ করব। ফলে সেভাবে কোনো ঝামেলা হয়নি। কাজের বিনিময়ে আমরা কিছুই আশা করিনি। যেহেতু এটা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সেহেতু এখানে কাজ করব, খাব, ঘুমাব আর কাজ করব। কিছু পাওয়ার আশা করিনি। তবু সবাই তো আর সমান মন নিয়ে বা সমান মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে পারিনি।

পলিয়ার ওয়াহিদ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কেউ কেউ বেতন-ভাতার দাবি তুলেছিলেন…।
কামাল লোহানী: ওই যে বললাম, সবাই তো আর সমান মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে আসিনি। ঠিক মনে নেই। জুলাই কি আগস্ট মাসে একটা ঝামেলা তৈরি হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক তখন আমাদের মধ্যে কিছু লোকজন ছিলেন যারা হঠাৎ করে পদ ও পদবি দাবি করে বসলেন এবং তাদের বেতন ভাতার হার কত হবে প্রশ্নটা তুললেন। এটা নিয়ে তারা একটা মেমোরেন্ডাম তৈরি করলেন। এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে গেলেন। আমরা দু’তিনজন আপত্তি করলাম। আমি, শরফুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল ফারুক, বেলাল মোহাম্মদ। ভারি দুঃখের কথা। দাবিটা তুলেছিল শিল্পী সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ এরা। আমি ও শরফুজ্জামান একটা টেবিলে কাজ করছিলাম। ওরা এসে খুবই নোংরা ভাষায় আমাদের গালাগাল করল। তখন আমের সময় ছিল। জব্বারের হাতে একটা বড় আম কাটা ছুরি ছিল। সে আমাদের দিকে ছুড়ি নিয়ে তেড়ে এসেছিল। ভয় দেখিয়ে প্রায় টেনে হিচড়ে দুই নম্বর স্টুডিওর কোণায় নিয়ে বলল, এখানে স্বাক্ষর কর। ওটা ছিল তাদের দাবি আদায়ের কাগজ। যেখানে আমরা আগে স্বাক্ষর করিনি। কিন্তু তখন সেই কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হই। কিন্তু আমরা বললাম, এই স্মারকলিপি নিয়ে আমরা স্বশরীরে যাব না। তখন এক পর্যায়ে তারা সিন্ধান্ত নিল যে, কাজ বন্ধ করে দেবে। কর্মবিরতী বলতে গান রেকর্ড করবে না, কথিকা পাঠ করবে না, জল্লাদের দরবার হবে না, চরমপত্র পাঠ করা হবে না। এম আর আকতার মুকুল চরমপত্র পাঠ করত। তখন আমি নিউজের দায়িত্বে ছিলাম। তো তাদের কথায় আমি কান দিলাম না। আমি আমার মতো সংবাদ প্রচার করব ভাবলাম। বজ্রকণ্ঠ, কোরআন, গান রেকর্ড কিছু করাই ছিল। তারা তিন দিন কোনো কাজ করল না। সে সময় মন্ত্রী ছিলেন এ এইচ এম কামরুজ্জামান এবং প্রতিরক্ষা সচিব কামার (সে আমারই ক্লাসমেট, ছোট বেলায় আমরা একসাথে পড়তাম)। তারা দুজন এসে একটা বোঝাপড়া করলেন। তাদের পদ ও বেতনের একটা ব্যবস্থারও আশ্বাস দিলেন তারা। তারপর সব আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল।

পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার লেখা ‘মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ ও ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’ নামে বই দুটিতে কি এসব বিষয় এসেছে?
কামাল লোহানী: হ্যাঁ, বিস্তারিত এসেছে। এখন তো সব মাথায় থাকে না। অনেক আগে নব্বইয়ের আগে বা পরে আমি এই কথাগুলো একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম। দৈনিক সংবাদে তিন কিস্তিতে সেটা ছাপা হয়। সেখানে আমি তাদের নামগুলো ধরে ধরে বলেছি। কে কে আমাদের বাধা দেবার চেষ্টা করেছে। এসব বিষয়ে খেলামেলা লিখেছি। সত্যটা বলতে আমার ভয় নেই। সেখানে আপেল মাহমুদ, আবদুল জব্বার, সমর দাস নামগুলো ছাপা হয়েছিল।

পলিয়ার ওয়াহিদ: কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে লেখা অন্যদের বইগুলোতে এ বিষয় তেমন উঠে আসেনি।
কামাল লোহানী:
কারো বইয়ে এই তথ্য লেখা হয়নি। যেমন বেলাল মোহাম্মদ এটা নিয়ে ইতিহাস লিখেছেন। সেখানেও এটা নেই। শামসুল হুদা চৌধুরী যে বড় বই লিখেছে সেখানেও এই কথাগুলো লেখা হয়নি। কারণ তারা সমালোচনার ভয়ে বিষয়গুলো সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়। অত্যন্ত দুঃখজনক ইতিহাসের সত্য-তথ্য তারা গোপন রেখেছে। এটা জাতির সাথে এক ধরনের প্রতারণা। এই যে ইতিহাস বিকৃতির দায় আমরা স্বাধীনতাবিরোধীদের দিয়ে থাকি কিন্তু পিছন ফিরে তাকাই না যে, আমরা নিজেরাও এই কাজটি করেছি। ইতিহাস বিকৃতির দায় অনেকেই এড়াতে পারবেন না। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তির সংগ্রামে যারা কাজ করবে তারা কখনো বেতন-ভাতার জন্য কাজ করবে না। তারা কোনো স্বার্থের জন্য কাজ করবে না। তারা নিঃস্বার্থভাবে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজগুলো করবে।

পলিয়ার ওয়াহিদ: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাম শুরুতে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ ছিল। পরে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেয়া হয় কেন?
কামাল লোহানী: সেটা চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। পরে ২৫ মে আমরা কলকাতা চলে আসি। কলকাতা থেকেই পৃথিবীজুড়ে এটি প্রচার করা হতো। ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেয়া হয়েছিল ২৭ মার্চ। মেজর জিয়া যখন বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে তখন সে শব্দটি বাদ দিতে বলেছিল। তা না হলে সে ঘোষণা পাঠ করবে না। তখন যারা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদরা সবাই মিলে সিন্ধান্ত নিল যে, বেতারের নামের সাথে যখন স্বাধীন বাংলা শব্দটি আছে তাহলে বিপ্লবী শব্দটি না হলেও চলে। ফলে এটি বাদ দেয়া হয়। কারণ তখন বাঙালি সৈন্য যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে আছে, তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছে সেটা প্রমাণ করার জন্য মেজর জিয়াকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করানোটাই জরুরি মনে করেছিল।

পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনি আগরতলা থেকে ট্রেনযোগে কলকাতা যান এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগদান করেন। কীভাবে এটা হলো?
কামাল লোহানী: কোথায় যাব? কীভাবে কার সাথে যোগাযোগ করব? এ নিয়ে দ্বিধা ছিল। এমন সময় সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী আমাকে ‘জয়বাংলা’  পত্রিকায় নিয়ে যান। ওখানে কাজ করতে থাকি। একদিন বাংলাদেশ মিশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভিতরে যাব কিন্তু অনুমতি ছাড়া ঢোকা যাচ্ছে না। তখন অবস্থা আরো বেগতিক- কে কোন মতলব নিয়ে ঢুকছে! ফলে স্বাভাবিকভাবে খুবই কড়াকড়ি চলছে। আবার আমার পরিচয়ও আমি দিতে পারছি না। তখন আমি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তবু এই পরিচয় দেয়া যাবে না। কারণ তখন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম আমাকে এসে চেপে ধরবে। এবং সে সময় আমি ফয়েজ আহমেদের সম্পাদনায় ‘স্বরাজ’ পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলাম। সে পরিচয়টিও গোপন রাখলাম। কিন্তু মিশনে ঢোকার সুযোগ হচ্ছে না। হঠাৎ আমিনুল হক বাদশাকে পেলাম। ও আমাকে দেখে অনেকটা ‘হাইজ্যাক’ করার মতো ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিল। আমি বললাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? সে বলল, আপনারই পরিচিত জায়গায়। একটা ছোট গেটের সামনে দাঁড়াল গাড়িটা। তারপর বাড়ির ভেতরে নিয়ে দোতালার একটা ঘরে বসিয়ে বলল, লোহানী ভাই, এখন থেকে আপনি এখানে থাকবেন। সেদিন থেকেই তো কাজ শুরু হলো। সেদিন ২২ কি ২৩ তারখি- খেয়াল নেই। সেখানে তখন আয়োজন চলছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের। বালিগঞ্জের এ বাড়িটিতে মন্ত্রীরা বাস করতেন। তারা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এখানেই প্রচলিত রীতির যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও শক্তিধর সেই ট্রান্সমিটার উদ্বোধন করা হয়।

পলিয়ার ওয়াহিদ: বালিগঞ্জের বেতার কেন্দ্রটি কত তারিখে চালু হয়?
কামাল লোহানী: ২৫ তারিখে। কাগজ নাই, কলম নাই, প্যাড নাই, চেয়ার নাই, টেবিল নাই অথচ এর ভেতরেই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে। এর ভেতরেই সংবাদ বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করতে হবে। আমাকে পটুয়া কামরুল হাসান বলল তুমি ভয় পেও না। মেঝেতে বসে পড়ো। তিনি আমাকে সাহস দিলেন। আসলে একটা মানুষ যখন দায়িত্বের মুখোমুখি বা সংকটে পড়ে তখন সে সেটা শিখে ফেলে। আমি ইংরেজিটা করলাম। এরপর ধীরে ধীরে আলমগীর কবির, আলী যাকের, পারভিন হোসেন, নাসরিন আহমেদ এলেন। বাংলা নিউজটি সেদিন পাঠ করেন সালেহ আহমেদ। 

পলিয়ার ওয়াহিদ: এই ‘সালেহ আহমেদ’ কে ছিলেন?
কামাল লোহানী: (একটু হেসে) সৈয়দ হাসান ইমাম ‘সালেহ আহমেদ’ ছদ্মনামে সংবাদ পাঠ করতেন। কারণ তখন আসল নাম বলা বিপজ্জনক ছিল।

পলিয়ার ওয়াহিদ: বেতারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনি একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন।
কামাল লোহানী: ও হ্যাঁ, ওই অনুষ্ঠানে আমি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ আবৃত্তি করেছিলাম। আসলে প্রচণ্ড দ্রোহ কাজ করছিল মনে। কবিতাটি পাঠ করতে করতে আমি কাঁপছিলাম। আবেগে উত্তেজনায় থরথর করছিল মন ও শরীর। একটা কবিতা যে যুদ্ধে কতটা শক্তিশালী কাণ্ড ঘটাতে পারে তা বাস্তবতা ছাড়া বোঝানো সম্ভব না।

পলিয়ার ওয়াহিদ: কলকাতার বালিগঞ্জের বেতার কেন্দ্রটি চালু হয়েছিল কোনো ভারতীর সাহায্য ছাড়াই। এই অসম্ভবকে কারা সম্ভব করেছিল?
কামাল লোহনী:
আশফাকুর রহমান খান, টি এইচ শিকদার, তাহের সুলতান কেউই প্রকৌশলী ছিলেন না, তবু কোনো ভারতীয়র সাহায্য না নিয়েই চালু হয়েছিল এ কেন্দ্রটি। চট্টগ্রামে যারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখনো তারা কেউ পৌঁছাননি। কিন্তু বিপ্লবী বেতারে কি আর বসে থাকা যায়। যখন যাকে দায়িত্ব দেয়া হবে, তখন তা পালন করতেই হবে। এবং হয়েছেও তাই।

পলিয়ার ওয়াহিদ: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণীও আপনি দিয়েছিলেন। কখন ঢাকা ফিরে এলেন?
কামাল লোহানী: ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকা চলে আসবে। এ জন্য আমি আগেই ঢাকা চলে এসেছিলাম। ২৫ ডিসেম্বর আমাকে বেতারের দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারের পুনর্গঠনে কাজ করতে থাকি।

পলিয়ার ওয়াহিদ: বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণীও কি আপনার দেয়া?
কামাল লোহানী:
না আমি একা না, সাথে ছিলেন আশফাকুর রহমান খান।

পলিয়ার ওয়াহিদ: কিন্তু বেতারের ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক থাকাকালীন বেতার ত্যাগ করলেন কেন?
কামাল লোহানী:
তিনদিন পর ২৫ ডিসেম্বর থেকে তাজউদ্দিন আহমদ আমাকে বেতারের দায়িত্ব পালন করতে বললেন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে তখন নাম হলো ‘বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র’। কিন্তু আমি একমাত্র বাইরের লোক। সবাই দীর্ঘদিন বেতারে কাজ করছে। আমি হঠাৎ তাদের সবার মাথার উপরে কাজ করব। তাদের মধ্যে একটা বিভাজন লক্ষ্য করা গেল। তারা আমাকে সহ্য করতে পারল না। বছরখানিক কাজ করার পর আমাকে সরিয়ে দেবার পায়তারা করা হলো। এবং পাকিস্তান আমলেও যারা বেতারে কাজ করত তারাই সবাই মিলে একজোট হয়ে আমাকে তাড়ানোর জন্য বিদ্রোহ করল। একদিন আমি সচিবালয়ে মিটিংয়ে গেছি। এসে দেখি আমারই কাছের শ্রদ্ধেয় এক ব্যক্তি আমার চেয়ারে বসে আছেন! লোকটি প্রতিদিন দুপুরে আমার সঙ্গে ভাত খেত। আমার সিনিয়র। তাকে ঘির সবাই উল্লাস করছে। আমাকে দরজায় দেখে বলল, আয় আয় ভেতরে আয়। বলে আমার চেয়ার ছাড়লো কিন্তু আমি ততক্ষণে বুঝে ফেললাম আমার আর থাকা হচ্ছে না। তখন এম আর আকতার মুকুল ছিল ডিজির দায়িত্বে। তিনি আমাকে নিয়ে ডিজি অফিসে গেলেন। তারপর আমাকে আবার ট্রান্সক্রিপশন পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হলো। বছর দুয়েক সেই দায়িত্ব পালন করেছিলাম।

পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে মুক্তি বা মুক্তিযুদ্ধের ফল আমরা কতটা পেলাম?
কামাল লোহানী:
মুক্তিযুদ্ধ তো শেষ হয়নি। যুদ্ধ শেষ হয় না। মুক্তিযুদ্ধ সামনে হবে। কে বলেছে মুক্তিযুদ্ধ শেষ?

পলিয়ার ওয়াহিদ: আপনি ‘বঙ্গবার্তা’য় কাজ করেছেন। সেখানে আপনারা বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপতেন না। কারণ কী ছিল?
কামাল লোহানী: তখন ‘বঙ্গবার্তা’ চলত মওলানা ভাসানীর তত্ত্বাবধানে। ফয়েজ আহমেদ সম্পাদক। আমি নিউজ এডিটর। তখন আমি ভাসানীর চীনাপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলাম। তখন আমরা বঙ্গবন্ধুর কোনো সংবাদ প্রকাশ বা ছবি ছাপতাম না। তবে একদিন ছেপেছিলাম। সংবাদটা ছিল বাংলাদেশের সামাজতান্ত্রিক দলের (সিপিবি) কংগ্রেসে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। তো আঞ্চলিক ভাষায় যে স্টাইলে বক্তব্য রেখেছেন তা হুবহু ছেপে দিয়েছিলাম। পর দিন বঙ্গবন্ধু টেলিফোন করলেন। আমি টেলিফোন ধরলে বললেন, ফজা কইরে? ফজা মানে ফয়েজ আহমেদ। আমি বললাম, তিনি তো এখন নেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, ও বুঝছি প্রেসক্লাবে কাচ্চু খেলতে গেছে। তা তোরা তো আমার ছবি ছাপিস না। আজ এতো বড় ছবি ছাপলি ক্যান? আসলে বঙ্গবন্ধু অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। দিলখোলা ছিলেন। আন্তরিক ছিলেন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়