ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার ঢাকা জয়

মেহেদী হাসান ডালিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার ঢাকা জয়

নিজের চেম্বারে অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া

মেহেদী হাসান ডালিম: ভোলা জেলার চরফ্যাশনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার। ছোটবেলায় পড়াশোনার সময় তিনি বিদ্যুতের আলো পাননি। এই পরিবেশেই স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে দাখিল-আলিম পাশ করে ভর্তি হন বরিশাল বিএম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। অনার্স পাশ করার পর বরিশাল ল কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করেন। তারপর উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে খালি হাতে পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। মালিবাগে ভাড়া মেসেই শুরু হয় ঢাকার জীবন। ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া এক পর্যায়ে শুভাকাঙ্খীর পরামর্শে হাইকোর্টে এক আইনজীবীর জুনিয়র হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিজ এলাকা ভোলায় পোস্টার লাগিয়ে জানান দেন তার আইনজীবী হয়ে কাজ শুরু করার খবর। শুরুতেই চাকরি সংক্রান্ত একাধিক মামলায় রায় পক্ষে নিয়ে আসায় এলাকায় ছড়িয়ে পরে সুনাম। পরিশ্রমী আর সহজ-সরল মনের অধিকারী ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়াকে সফলতার মুখ দেখার জন্য বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।

সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্যানেল শিক্ষকদের মামলা করে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তার প্রচেষ্টায় উচ্চ আদালতের রায়ে চাকরি জাতীয়করণ হয় প্রায় ৭০০০ জন প্যানেল শিক্ষকের। দেশের সকল গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয় সে খবর। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পযন্ত সফল আইনজীবী হিসেবে ছড়িযে পরে অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহর নাম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাকরি সংক্রান্ত আরো শত শত মামলা আসতে থাকে তার কাছে। কম খরচে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই করে হাজারো তরুণের ভাগ্য গড়ে দেন তিনি। ভাগ্য বদল হয় তার নিজেরও। প্রথম জীবনে মেসে থাকা ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া কম সময়ের ব্যবধানে অর্থ, যশ, খ্যাতি সব অর্জন করেন। দেশের লাখো মানুষের কাছে পরিচিতি পান শিক্ষক বন্ধু হিসেবে। দ্বীপ জেলা ভোলা থেকে এসে করেন ঢাকা জয়। ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার ভাষায়, ‘আজকে যে আমার সফলতা, আমার যে অর্জন, এটাকে সবসময় আল্লাহর রহমত বলে মনে করি। অনেক বেশি পেয়ে গেছি। এত বেশি পাওয়ার যোগ্য আমি না। সত্যিই স্বপ্নের মত মনে হয়।’

রাইজিংবিডির সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় নানা বিষয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির সুপ্রিম কোর্টের প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।

রাইজিংবিডি: জন্ম, শৈশব-কৈশোর, পড়ালেখা …

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: জন্ম ১৯৮০ সালে ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফরিদাবাদ গ্রামে। একেবারে গ্রাম বলতে যেটা বোঝায়। আমরা যখন গ্রামে ছিলাম তখন বিদ্যুতের আলো ছিল না। বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষার হাতে খড়ি। স্থানীয় মাদ্রাসা থেকে দাখিল-আলিম প্রথম বিভাগে পাশ করি। এরপর বরিশাল বিএম কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স ভর্তি হই। অনার্স পাশ করার পাশাপাশি বরিশাল ল’ কলেজ থেকে আইন বিষয়ে অধ্যয়নও শেষ করি।
 

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়ার সঙ্গে কথা বলছেন রাইজিংবিডির প্রতিবেদক


রাইজিংবিডি: ঢাকার প্রথম জীবন এবং আইন পেশার শুরুটা জানতে চাই …

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া : ২০০৬ সালের শেষের দিকে  ভোলা ছেড়ে আসি। আমার এক ভাই নারায়ণগঞ্জে থাকতো। প্রথমে সেখানে থাকতাম। পরবর্তী সময়ে মালিবাগ চৌধুরী পাড়া মেসে উঠি। ওই মেসে বিএম কলেজের এক বড় ভাই ছিলেন। উনি একদিন বললেন, তোমার তো ল করা আছে, তুমি তো যে কোন লইয়ারের সঙ্গে থাকতে পারো। পরে উনি আমাকে তার পরিচিত অ্যাডভোকেট গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী আলালের কাছে নিয়ে যান। এরপর তার সঙ্গেই কাজ শুরু করি। তখনও মেসে থাকতাম। সিনিয়র আমাকে যৎসামান্য যে টাকা দিতেন সেটা দিয়েই আমার মেসের খরচ চলে যেতো।

রাইজিংবিডি: প্রথম মামলা পাওয়ার গল্প জানতে চাই ...

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: ২০১৩ সালে হাইকোর্টে এনরোলমেন্ট হওয়ার পরে আমি নিজে নিজেই মামলা করতে শুরু করি। আমাদের এলাকার গরীব পরিবারের একটা ছেলে আলামিন ভোলা জজকোর্টে অফিস সহকারি পদে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। কিন্তু ভাইভার পর রেজাল্ট আটকে গেছে। এ খবর শুনে বললাম, কাগজগুলো নিয়ে আসো। টাকা-পয়সা লাগবে না আমিই করবো। প্রথমে আমি মামলাটা নিয়ে এক বড় ভাইকে বললাম, মামলাটা করে দেন। যে কারণেই হোক তিনি করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে আমি মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের কোর্টে নিজেই পারমিশনের জন্য যাই। আমি হেয়ারিং করলাম, রুল পেলাম। রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আলামিনের পক্ষে রায় দেন। চাকরিতে যোগ দেন আলামিন। এইতো শুরু।

রাইজিংবিডি: যে মামলা করে আপনার জীবনের মোড় ঘুরে যায় বা যে রিট মামলাগুলো আপনার জীবনের অতি স্মরণীয় ...

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: সারাদেশের বেসরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ২০১০ সালে একটা সার্কুলার দেয়া হয়। বহু চাকরিপ্রার্থী সেখানে আবেদন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৬ শত ১১ জন চূড়ান্তভাবে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

এর মধ্যে ১০ হাজার জনকে নিয়োগ দেয় সরকার। ৩২ হাজার থেকে যায়। এর মধ্যে থেকে নওগাঁর ১০ জন প্রথম সংশোধিত সার্কুলার চ্যালেঞ্জ করে বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট দায়ের করেন। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ১০ জনের পক্ষে রায় দেন। কম সংখ্যক হওয়ার কারণে বিষয়টি আলোচনায় আসে নি। ২০১৪ সালে এসে আমার এলাকার কয়েকজন বলেন, আমরাও তো এইরকম টিকেছি, ৪২ হাজারের মধ্যে আছি কিন্তু আমাদের চাকরি হচ্ছে না। প্রথমে আমি এত গুরুত্ব দেইনি। পরে আমার ছোট ভাই বললেন, আমাদের এলাকারই তো কষ্ট করে মামলাটা করি। প্রথমে ৭০ জনের পক্ষে মামলা করি। আদালত রুল জারি করেন। রুল জারির বিষয়টি পত্রিকায় আসে। পত্রিকায় দেওয়ার পরে বরিশাল বিভাগের আরো ৩/৪ শ প্যানেল শিক্ষক আমার কাছে আসেন মামলা করার জন্য। তাদের পক্ষেও আদালত রুল জারি করেন। এই হল মামলার শুরুর কাহিনী। ২ বছরের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার জনের পক্ষে মামলা আমি একাই করি। ২০১৫ সালে মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আমার ও অন্যান্য আইনজীবী মিলে ৩৬৪টি রিট মামলা চূড়ান্ত নিস্পত্তি করে প্রথম ধাপে প্রায় ১০ হাজার জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য রায় দেন। রায়ের বিষয়টি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়। আবার একই বছর শেষের দিকে আরো ১৯০টি রিট মামলার রায় দেন একই কোর্ট। এখানে অনেক আইনজীবীর মামলা ছিল। এই মামলার অগ্রভাগে আমি সব সময় ছিলাম।সব লইয়ার মিলে মিনিমাম ২৫ হাজারের মত শিক্ষকের পক্ষে মামলা করা হয়েছিল। আদালতের রায়ের পরও যখন চাকরিতে নিয়োগ দিতে গড়িমসি হচ্ছিলো তখন আমরা বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে কনটেম্পট ফাইল করি। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডিজি অফিস থেকে যোগাযোগ করে বলা হয়, আমরা নিয়োগের ব্যবস্থা করছি, আমরা যে আপিল করেছি সেগুলো উঠিয়ে নেব। পরে  তারা ৩২ হাজার জনকে প্যানেল শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এই যে ৩২ হাজার নিয়োগ পেলেন এর মধ্যে শুধু আমার মাধ্যমে রিট করে প্রায় ৭ হাজার প্যানেল শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। এই মামলায় আপিল বিভাগে জ্যেষ্ঠ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার সিনিয়র হিসেবে ছিলেন। পরে তো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ বঞ্চিত আড়াই হাজারের মত চাকুরিপ্রার্থীর পক্ষে মামলা করে তাদের অনুকূলে রায় নিয়ে আসি। শুরু থেকে শিক্ষকদের প্রতি আমার ন্যাচারালি একটা টান রয়েছে। একারণে আমাকে সবাই শিক্ষকবন্ধু বলে অভিহিত করেন।

প্যানেল শিক্ষকদের মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিজয়ী হওয়ার দিনে ব্যারিস্টার রফিক উল হক ও অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদারের সঙ্গে অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া


রাইজিংবিডি: দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা যে কারণে আপনার কাছে ছুটে আসে ...

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া : আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, আমাকে দেখলে বা আমার সঙ্গে কথা বললে তারা আমার মধ্যে একটা সরলতা পান। যখন কেউ আমার কাছে মন খারাপ করে আসেন এটা দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়। এটা তারা বুঝতে পারেন। দেখা গেছে আমি যে জিনিসটা পারি না তারাই বলেন আপনি চেষ্টা করেন পারবেন। এই সরলতাটা তারা ফিল করেন বলেই তারা আমার কাছে আসেন। আমি সবসময় বলি আমি বেশি টাকার মামলা করতে পারি নাই কিন্তু বেশি লোকের মামলা করতে পেরেছি। এটাই সার্থকতা।

রাইজিংবিডি: মামলার ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে কি ধরণের নীতি অনুসরণ করেন ?

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: আমার এক মামলায় দুইশত/আড়াইশত জন পিটিশনার থাকে। নরমালি যে টাকা নেই না তা না। শুরু থেকে আমি ফি নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনও জোর করি  না। যে টাকা দেন তাই রেখে দেই। কখনও দেখি না কত টাকা দিলেন। আমি আজ পর্যন্ত ফি গুণে কারো কাছ থেকে কখনও নেই নি। যদি বলে যে এখানে এই টাকা আছে, আমি ঠিক আছে বলে রেখে দেই। আমি নিজেকে খাদেম বা জনগণের সেবক মনে করি।’

রাইজিংবিডি: আপনি সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত কতগুলো রিট করেছেন বা কত মানুষের পক্ষে রায় এনে দিতে পেরেছেন?

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: আমি তো ২০১৩ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো মামলা করেছি সবগুলোই সার্ভিস মেটার। এছাড়া অনেক প্রজেক্টের মামলা করেছি। প্রায় এক হাজারের মত রিট মামলা করেছি। তার মধ্যে ম্যাক্সিমাম পজিটিভ। নেগেটিভ এখনও হয়নি। একটা কথা, সার্ভিস ম্যাটারে কোর্ট সব সময় সফট থাকেন।

রাইজিংবিডি : আপনি তো অনেকের মামলা করেছেন, এর মধ্যে একটা ঘটনা বলুন যা মনে হলে এখনও আবেগপ্রবণ হয়ে যান।

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: মামলা করার সময়ের দুটি ঘটনা এখনও আমার খুব মনে পড়ে। প্যানেল শিক্ষকদের মামলার যখন রায় হয় তখন হঠাৎ করে রাতে হবিগঞ্জ থেকে একটা ফোন আসে ‘স্যার আমার মামলাটা করে দেবেন। আমি বললাম এখন তো রায় হয়ে গেছে। এখন মামলা করতে হলে ২০/২৫ হাজার টাকা নিয়ে আসতে হবে। শুনে ওই ছেলে ফোন কেটে দিল। ১০ মিনিট পর ভাবলাম আমি তো কারো কাছে থেকে এত টাকা নেইনি। এই ভেবে আমি ওই ছেলেকে নিজে থেকেই ফোন দিলাম। বললাম, তুমি টাকা পয়সা কত দিতে পারবে। ফোন দেওয়ার পরে ওই ছেলে বলে স্যার আমার একটু কথা শোনেন, স্যার আমার তো পা নেই। আমি তো জন্ম থেকেই পঙ্গু। আমার তিনটা সন্তান। আপনার ওইখানে যে যাব সেই ভাড়ার টাকাটাও আমার কাছে নেই। তখন আমি আর কোন কথা বলতে পারছিলাম না। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে হল আমার জীবনে ঝড় নেমে আসছে। পরবর্তী সময়ে হবিগঞ্জের সেই পঙ্গু রোকন মিয়ার মামলা আমি সম্পূর্ণ ফ্রি করে দেই। রোকন মিয়ার চাকরিও সরকারি হয়ে যায়। এখনও মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে বলে ‘স্যার আমি তো আপনাকে কিছু দিতে পারি নাই। দিতেও পারবো না। কিন্তু যখনই মসজিদে যাই তখনই আল্লাহর কাছে বলি, আল্লাহ স্যারকে তুমি ভাল রেখো।’ এখনও রোকন মিয়ার কথা শুনলে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে যাই।

দ্বিতীয়ত, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের প্রতিবন্ধী রাসেল পরিবার পরকল্পনা সহকারী পদে রিটেন ও ভাইভা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু তার একটি হাত ও একটি পা না থাকার কারণে তাকে চাকরি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। শুনে আমি খুবই ব্যথিত হই। হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। মাননীয় বিচারপতি নাইমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ প্রতিবন্ধী রাসেলকে নিয়োগ দেয়ার আদেশ দেন। মানবিক জায়গা থেকে রাসেলের মামলার যাবতীয় খরচ আমি নিজেই বহন করি। রাসেলের চাকরির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পেরে এখনও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়।

সহোদর ভাই মনিরুল ইসলামসহ জুনিয়রদের সঙ্গে অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া


রাইজিংবিডি: কোর্টে মামলা শুনানিকালীন বিশেষ কোন স্মৃতি কি মনে পড়ে ?

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: ২০১৩ সালে সবে আমার এনরোলমেন্ট হয়েছে। চাকরিসংক্রান্ত একটা মামলার শুনানি চলছে মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের কোর্টে। পুঙ্খানুপুঙ্খানু ভাবে মামলা দুই/তিন ধরে শুনলেন। আমি তো খুব চিন্তায় আছি। সবাই বললেন, এত কম বয়সে রায় নিতে হয় না, বড়দের নিয়ে যেতে হয়। আমি যখন শুনানি করছিলাম তখন আমার প্রেরণা মাননীয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বললেন আপনি চেষ্টা করলেই পারবেন। নিজে চেষ্টা করেন। শুনানির পর উনি বললেন, আমি স্যাটিসফাইড, আমি জাজমেন্ট দেবো। এরপর তো জাজমেন্ট পক্ষে আসলো।

আরেকটি ঘটনা, প্যানেল শিক্ষকদের মামলা নিয়ে কনটেম্পট করতে গেলাম মাননীয় বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের কোর্টে। কোর্টে একদিন কথায় কথায় বলেছি মাই লর্ড আমি তো শিক্ষকদের অনেক মামলা করেছি। তখন উনি বললেন, অনেক মামলা করলেই  হয় না। অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হয়। অনেক মামলা করেছেন কিন্তু আমাকে বোঝাতে পারেননি।

আমার শুনানি আধা ঘণ্টার মত শুনে বললেন, আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। দুইটার পর আবার আসবেন। সেকেন্ড হাফে যখন আবার দাঁড়িয়েছি তখন মাননীয় বিচারপতি বললেন, আপনি সকালে বোঝাতে পারেননি, এখন চেষ্টা করেন। এক মিনিট বলার পরেই বললেন, এটাই মেইন পয়েন্ট। এটা আপনি সকাল থেকে বোঝাতে পারেননি, এখন বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। আপনাকে মনে রাখতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে, জানতে হবে। আগে নিজে জেনে হজম করতে হবে। তার এই বক্তব্য আমার জন্য অনেক প্রেরণাদায়ক ছিল।

রাইজিংবিডি: আপনি তো ঢাকায় এসে প্রথমে মেসে থেকেছেন। মাত্র ১০/১২ বছরের ব্যবধানে অর্থ, যশ সব অর্জন করেছেন। এই সাফল্যর রহস্য কি ?

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: অর্থনৈতিকভাবে আমি আমার সাফল্যকে কখনও মূল্যায়ন করি না। আমি শুরু থেকে পরিশ্রম করে আসছি। প্রতিটা সময়ই আমি পরিশ্রম করি। পরিশ্রম, সততা এবং দায়িত্বের প্রতি অবিচল থাকাই আমাকে এ পর্যায়ে এনেছে। আমার বাবা-মায়ের দোয়া ও হাজারো মানুষের দোয়া এ পর্যায়ে আসতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে এবং আমার চলার পথের পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। একটা কথা বলি, ২০০৮ সাল থেকে ১৮ সাল- এই ১০ বছরে আমি কোথাও বেড়াতে যাইনি। পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। চেম্বার থেকে বাসায়-বাসা থেকে কোর্টে এইতো আমার দুনিয়া। আর একটি কথা না বললেই নয়, আমার যে আজকের অবস্থান তার পেছনে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন স্যারের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তিনি সব সময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।

রাইজিংবিডি: দেশব্যাপী আপনার পরিচিতির পেছনে সুপ্রিম কোর্টে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ভূমিকা কিভাবে মূল্যায়ন করেন ?

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া : ৩২ হাজার পরিবারের  সদস্য চাকরি পেয়েছেন, কোর্ট ন্যায় বিচার করেছেন। আর সাংবাদিকরা তা প্রতিনিয়ত ফলোআপ করে কর্তৃপক্ষকে বাস্তবায়নে বাধ্য করেছেন। আমার পরিচিতির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অবদানের কথা কখনও ভুলবো না। সারাজীবন সাংবাদিকদের অবদানের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবো।

ছেলের সঙ্গে অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া


রাইজিংবিডি: আইন পেশায় যারা নতুন আসতে চান তাদের জন্য আপনার পরামর্শ ...

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: এই পেশায় সফল হতে হলে পড়তে হবে, শিখতে হবে এবং সিনিয়রদের ফলো করতে হবে। কোর্টকে ফলো করতে হবে। এটাকে ডেভেলপারের ব্যবসা, শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা বা অন্য ব্যবসার মত মনে না করে সেবামূলকভাবে নিতে হবে।

রাইজিংবিডি: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাই …

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: সাধারণ মানুষের পাশে থেকে আইনি সহায়তা দিয়ে যাওয়া। যার জন্য আমি আমার ছোট ভাইকেও নিয়ে এসেছি। যাতে বংশ পরম্পরায় এ পেশায় থেকে যাওয়া যায়। আমি যতদিন বাঁচি গরীব মানুষকে আইনি সহায়তা দিয়ে আমার ব্যক্তিজীবন সার্থক করে তোলার কথা ভাবি। আমার বেশি টাকার দরকার নেই। আমি যেন বেশি মানুষের সেবা করে যেতে পারি- এটাই চাওয়া।

রাইজিংবিডি: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাই ...

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: আমার বাবা-মা আছেন। আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন। সব ভাই ঢাকায় থাকেন। এক ভাই আমার সঙ্গেই আছেন। অন্য ভাইয়েরা ব্যবসা-চাকরি করেন। আমার স্ত্রী গৃহিনী, আমার তিন সন্তান; এক ছেলে দুই মেয়ে।

রাইজিংবিডি: জীবনের এই পর্যায়ে এসে কি মনে হয় আপনি স্বপ্নের থেকে বেশি কিছু অর্জন করেছেন ?

অ্যাডভোকেট ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া: আজকে আমার যা কিছু প্রাপ্তি তাকে আমি সবসময় আল্লাহর রহমত বলে মনে করি। অনেক বেশি পেয়ে গেছি, এত বেশি পাওয়ার যোগ্য আমি না, যা আমার স্বপ্নের বাইরে ছিল। ক্লায়েন্টদের ভালবাসা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি যে চেয়ারে বসে আছি এটা একজনের ভালবাসার নুমনা। মানুষের ভালবাসা আমি উপলব্ধি করি। অনেকে আমাকে বলে আপনি তো পীর সাহেবদের মত। আমের সিজনে আম, কাঁঠাল সব চলে আসে এমনিতে। সিলেটের চা, পাটি, আবার ঠাকুরগাঁওয়ের চাল, রাজশাহীর কাঁচা কলার ফানা, মানিকগঞ্জের গুড়, সুনামগঞ্জের হাওরের মাছ আমার জন্য নিয়ে আসে। এতো মানুষের ভালবাসা পেয়েছি যে, তার প্রতিদান দেওয়ার সামর্থ আমার নেই। অনেকে বলেন, এখন তো আপনার টাকা-পয়সা, গাড়ি-বাড়ি সব হয়েছে। সেটাকে আমি বড় করে কখনও দেখি না। মানুষের ভালবাসাকেই আমি বড় করে দেখি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮/মেহেদী/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়