ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ডিজিটাল উপকূল-১

ডিজিটাল সেবা বদলে দিচ্ছে উপকূলের প্রত্যন্ত গ্রাম

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ১৬ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডিজিটাল সেবা বদলে দিচ্ছে উপকূলের প্রত্যন্ত গ্রাম



‘সব ধরনের খবরাখবর পাই মোবাইলে। হাটবাজারে কিংবা বাড়িতে টেলিভিশনের সামনে বসেও খবর দেখি। অন্যদের কাছ থেকে ইন্টারনেটেও খবর পাই। তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া পৌঁছার আগে মনে হতো অন্ধকারে ডুবে আছি। এখন তা মনে হয় না। খবরাখবর জানা আর সব মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় জীবনটা যেন অনেক সহজ হয়েছে।’
কথাগুলো বলছিলেন একেএম আবুল বাশার। বয়স ৭০। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। বাড়ি উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের লুধুয়া গ্রামে। অবসর জীবনে মোবাইল তাকে অনেকটাই সচল রাখছে। একই এলাকার আরেক বয়সী ব্যক্তি দুলাল বেপারীও একই অভিমত দিলেন। একেএম আবুল বাশারের কথায় তিনি যোগ করেন, ‘মোবাইল, ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান দিচ্ছে। পণ্যের ন্যায্য দাম পেতে, স্বজনদের খোঁজ নিতে মোবাইল খুবই দরকারি।’   

উপকূলের প্রান্তিক জনপদ সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ডিজিটাল সেবা উপকূলের প্রত্যন্ত গ্রামের চেহারা বদলে দিয়েছে। নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধনের প্রমাণপত্র কিংবা অন্য কোন কাগজপত্রের জন্য এখন আর ইউনিয়ন পরিষদের বারান্দায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় না। অপেক্ষা করতে হয় না চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে তারা পাচ্ছেন সব সেবা। অনলাইনে দরকারি সকল সেবা পাওয়ায় মানুষের জীবনটাই যেন সহজ হয়ে গেছে।
কমলনগর উপজেলার মেঘনা তীরবর্তী চর ফলকন ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা আরিফুর রহমান বলছিলেন পরিবর্তনের কথা। ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠার আগে সাধারণ নাগরিকেরা এতটা সুবিধা পেতেন না। ডিজিটাল সেবা না থাকায় সেবা দিতেও অনেক সমস্যা ছিল। এখন তা কেটে গেছে। সব শ্রেণীর মানুষ অনায়াসে এখানে আসতে পারছেন।

চর ফলকনের দুর্গম জনপদের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে ছেলের চাকরি হয়েছে জানতে পেরে আনন্দাশ্রু নুরুল হক মাঝির। যথাসময়ে অনলাইনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে না পারলে ছেলেকে বাবার সাথে নদীতে মাছ ধরতে যেতে হতো। চর ফলকন ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের জাফর আলম রাকিব বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-তে সিপাহী পদে যোগদান করে দরিদ্র বাবাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করেছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের কল্যাণে। একই ইউনিয়নের হাবিবপুর গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম এর ছেলে মো. ইব্রাহিম বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে ছিল না নাগরিক সনদ। মংলা থেকে সকাল সাড়ে আটটায় ইব্রাহিম ঘটনাটি মোবাইলে ইউপি চেয়ারম্যানকে জানালে সকাল ৯টার মধ্যে এই কাগজ তিনি হাতে পান। ইউপি চেয়ারম্যান তাৎক্ষণিকভাবে নিজের স্বাক্ষর স্ক্যান করে নাগরিক সদন পাঠিয়ে দেন ই-মেইলে। ফলে নৌবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ হয় ইব্রাহিমের। এখানেই শেষ নয়। এমন ঘটনা আরো আছে। একই ইউনিয়নের হাবিবপুর গ্রামের হতদরিদ্র কৃষক আলমগীর হোসেনের ছেলে রাশেদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরির জন্য দাঁড়াবে। কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মোবাইলে বিষয়টি জানতে পেরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সিল স্বাক্ষর করে ই-মেইলে ফেরত পাঠিয়ে দেন চেয়ারম্যান। রাশেদ পরের দিন লাইনে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ পান।

মেঘনা পাড়ের এই ইউনিয়নের ডিজিটাল সেবা পৌঁছে গেছে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশে। ইউনিয়নের জাপানী পাড়ার আলী করিমের ছেলে মামুন, একই গ্রামের কৃষক রুহুল আমিনের ছেলে প্রবাসী শ্রমিক ফারুক সৌদি আরবে কর্মরত অবস্থায় মারা যান। তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইংরেজী ও আরবী ভাষায় অনুবাদ করে ই-মেইল এর মাধ্যমে সেদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়। এতে খুব সহজে স্বজনের লাশ ও পাওনাদি বুঝে পায় পরিবার। প্রত্যন্ত এলাকায় ডিজিটাল সেবার বহু উদাহরণের মধ্যে এগুলো কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। বিচ্ছিন্ন জনপদের মানুষও যে অনলাইন সেবার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হতে পারে, তার দৃষ্টান্ত চর ফলকন।



সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের দোতলায় একটি কক্ষে তথ্যসেবা কেন্দ্রে কাজ চলে। কয়েকটি কম্পিউটার ও ল্যাপটপে কাজ করছে তিনজন তরুণ। অনলাইনের নিউজ কিংবা উন্নয়ন তথ্য জানাতে এখানে প্রোজেক্টর ও বড় পর্দা রয়েছে। কেন্দ্রে সকাল, দুপুর, বিকেল সারাক্ষণই সেবা নিতে আসা মানুষের ভিড় থাকে।  শুধু তথ্যসেবা নয়, বহু ছেলেমেয়ে এখান থেকে কম্পিউটার শিখে নিজেদের চাকরি পাওয়ার পথ সুগম করে তুলছে। কেউ আবার ফেইসবুক চালানো থেকে কম্পিউটারের মাউস ধরা শিখে এখন ওয়েবসাইট তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করেছে। ডিজিটালের কল্যাণে গ্রামেই তৈরি হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি। প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থান করলেও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের কল্যাণে এখানকার মানুষ সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ত থাকছে দূরের স্বজনদের সঙ্গে। এই এলাকার বহু মানুষ বিদেশে অবস্থান করলেও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। প্রত্যন্ত এই গ্রাম থেকে বহু মানুষ বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে স্কাইপিতে অনায়াসে কথা বলেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন বাড়িতে রেখে যাওয়া মা-বাবা, বৃদ্ধ দাদা-দাদী, স্ত্রী-সন্তান পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসীর। 

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে জানা গেল, বিদ্যুৎ না থাকলেও সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা কেন্দ্রটি চালু রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হরতাল অবরোধে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও কোন প্রভাব পড়েনা চর ফলকনের প্রত্যন্ত পল্লীতে। সব কাজই চলে অনলাইনে। ছাত্র-ছাত্রীরা লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তির আবেদন ফরম পূরণ করতে পারছেন। চাকুরী প্রার্থী এমনকি শিক্ষক নিবন্ধনের জন্য আবেদন এখন চর ফলকন গ্রামে থেকে করা যায় অতি সহজেই।
এই গ্রামের চাকুরীপ্রার্থীদের নিয়োগ পরীক্ষা, শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল জানতে এখন আর কোন প্রকার বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন দপ্তরে দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না। চর ফলকন ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্রে পাবলিক পরীক্ষা ও নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল জানা এবং তা ডাউনলোড করে ফলাফলের প্রিন্ট কপি সংগ্রহ করা যায়।

সরেজমিন ঘুরে পরিবর্তনের আরেকটি দৃষ্টান্ত মেলে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাটা ইউনিয়নে। সেখানে তথ্য আদান-প্রদান আর প্রযুক্তি সেবার সব কাজই উদ্যোক্তা জোবায়ের ইসলামকে ঘিরে। শুধু চরবাটা ইউনিয়ন নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও বহু লোকজন তার কাছে ছুটে আসেন। প্রতিদিনের চাকরির বিজ্ঞাপন, ভর্তির তথ্যাবলী জানা, কোথাও অনলাইনে আবেদন পাঠানো, ছবি স্ক্যান করা এমনকি বিমানের টিকেট বুকিংয়ের জন্য লোকজন এখানেই ছুটে আসেন। এ প্রসঙ্গে জোবায়ের ইসলাম বলছিলেন, এলাকার মানুষ যেসব কাজের জন্য আগে ৩৫ কিলোমিটার দূরের জেলা সদরে যেতেন, সে কাজ এখন এখানে বসেই সমাধান হয়ে যায়। বিমানের টিকিটের জন্য এখানে লোকজন আসেন। কৃষি বিষয়ক তথ্যের জন্য কৃষকেরা আসেন। ছাত্ররা ভর্তির খোঁজ-খবরের জন্য অসেন। পরীক্ষার ফল জানা, বিসিএস পরীক্ষার আবেদন করার জন্যও এখানে অনেকেই আসেন। অনেক ক্ষেত্রে কোনো সেবা ব্যয় নেওয়া হয় না।

সুবর্ণচরের চর ওয়াপদা ইউনিয়নের মাজার মার্কেটে আলাপ হচ্ছিল কয়েকজনের সঙ্গে। এদের একজন আবদুর রহিম। বয়স ২৮। ভূষামালের ব্যবসা করেন। ১২-১৩ বছর ধরে মোবাইল ব্যবহার করেন। ব্যবসার কাজে, ধার দেয়া টাকা আদায়ে, স্বজনদের সাথে যোগাযোগ মোবাইল তার জীবনে এখন অপরিহার্য। তিনি বলেন, ‘মোবাইল যখন ছিল না, তখন অনেক সমস্যা ছিল। এখন জীবন সহজ হয়েছে।’ এই কথার সঙ্গে যোগ করে দিন মজুর আবু তাহের বলেন, ‘ছোট কর্ম করি। তবুও মোবাইল খুবই দরকারি। কাজের জন্যই মোবাইল খুব প্রয়োজন।’ আবু তাহের শুধুমাত্র মোবাইলের কল রিসিভ করতে পারেন। তবুও তার কাছে এটা খুবই প্রয়োজনীয়। সুবর্ণচরের দাশেরহাট বাজারে এক সন্ধ্যায় নৃত্যলাল মজুমদারের দোকানে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা হচ্ছিল। যোগ দিলেন বেশ কয়েকজন। দশ জনের মধ্যে মোবাইল আছে সাত জনের। এদের মধ্যে দুজন ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অন্যরাও ইন্টারনেটে সংযুক্ত, তবে সরাসরি নয়। ছেলেমেয়ে কিংবা নাতিদের কাছে আছে ইন্টারনেট। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন ধরণের খবরাখবর পান। এদের মধ্যে একজন কিশোর আবদুল মান্নান। সে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। কথা বলার জন্য তার যেভাবে মিনিট লাগে, তেমনি মেগাবাইট লাগে। বন্ধুদের নেটে দেখে তার খুব ভালো লাগে। ডাউনলোড করতে পারে ছবি। এর পাশাপাশি খবরাখবর জানা, আবহাওয়ার খোঁজ রাখার প্রয়োজনে তথ্যপ্রযুক্তি তার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে।

বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে নৃত্যলাল মজুমদার (৬৭), লালমোহন দাস (৭৮), মো. সিদ্দিক (৬৭), হরেকৃষ্ণ দাস (৫০)সহ আরও অনেকে সুর মেলালেন আবদুল মান্নানের কথায়। তারা বলেন, ‘আগে তো মোবাইল-ইন্টারনেট ছিল না। এসবের দরকার বুঝি নাই। এখন দেখি এটা খুব দরকারি জিনিস। রাতের অন্ধকারে গ্রাম ঘুমালেও আমরা জরুরি প্রয়োজনে যে কোন সময় সব খবরাখবর পাই। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের জীবনে আলো নিয়ে এসেছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়