ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

খালেদার অনুপস্থিতিতেই চলবে বিচারকাজ

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খালেদার অনুপস্থিতিতেই চলবে বিচারকাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় কারাগারে থাকা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ চলবে বলে আদেশ দিয়েছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত  দুদকের একটি আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান এ আদেশ দেন।

একই সঙ্গে এদিন মামলাটির অপর ২ আসামির পক্ষে আংশিক যুক্তি গ্রহণ শেষে আগামী ২৪, ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য করা হয়েছে।

এদিকে আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন প্রাক্তন এ প্রধানমন্ত্রীর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার।

এর আগে বৃহস্পতিবার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে স্থাপিত নবগঠিত অস্থায়ী আদালতে ১১ টা ৩৩ মিনিটে বিচারক বিচারকাজ শুরুর জন্য এজলাসে আসেন।

প্রথমে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল আদালতের কাছে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিচার চলা সংক্রান্ত আদেশ দেয়ার অনুরোধ জানান।

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে বুধবার দেখা করেছি। আমাদের বলেছেন, তিনি আদালতে আসতে অনিচ্ছুক নন। অসুস্থতার জন্যই আদালতে আসতে পারছেন না। সুস্থ হলেই তিনি আদালতে আসবেন। আমরা বিশেষায়িত একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আদালতেও একটি আবেদন দিয়েছি।’ আইনজীবী আরও বলেন, ‘মাননীয় আদালত, আপনি জানেন, ম্যাডাম তার ছেলের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনও আপনার আদালতে এসেছেন।’

এ সময় বিচারক বলেন, ‘আমি কিন্তু সেদিন তাকে আসতে বলিনি। বলেছিলাম আপনি না আসলেও চলবে। কিন্তু তারপরও তিনি এসেছিলেন।’

এরপর ওই আইনজীবী বলেন, ‘ম্যাডামকে সুস্থ হওয়ার সুযোগ দিন। তিনি আদালতে উপস্থিত থেকে মামলার বিচারকাজ দেখতে চান।’

এরপর আরেক আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘খবরে দেখলাম আইজি প্রিজনের কাছে মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ চলে এসেছে। খুব শিগগিরই হয়তো হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা হবে। আর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারায় অনুপস্থিতিতে বিচারের বিষয়ে যদি বলার সুযোগ দেন।’

তখন বিচারক বলেন, ‘আজ এ সম্পর্কে কোন কিছু বলার সুযোগ নেই। গত ১৩ সেপ্টেম্বর আপনাদের বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, আপনারা বলেন নাই। আজ আদেশের জন্য আছে।

এরপর উপস্থিত আসামি মনিরুল ইসলাম খান ও জিয়াউল ইসলাম মুন্নার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ও মো. আখতার হোসেন বক্তব্য বলতে গেলে বিচারক বলেন, ‘আপনাদের আসামি উপস্থিত, আপনারা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেন না।’

উত্তরে আইনজীবী আমিনুল বলেন, ‘বলতে পারি।’

এরপর বিচারক বলেন, ‘আপনি (আইনজীবী আমিনুল) গত ১২ সেপ্টেম্বর কোরামের প্রশ্ন তুলেছিলেন। কথা ছিল গত ১৩ সেপ্টেম্বর আপনি এ সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেবেন, কিন্তু দেননি।’

জবাবে আইনজীবী আমিনুল বলেন, ‘মাননীয় আদালত আপনি আদেশ দেবেন দেন। আমরা বাধা দিচ্ছি না। তবে আমরা আজ সম্পূরক বক্তব্য দিতে পারি। এভাবে যদি আমাদের কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে ন্যায় বিচার কিভাবে হবে?’

তখন বিচারক বলেন, ‘আপনি তো বেগম জিয়ার আইনজীবী নন।’

উত্তরে আইনজীবী আমিনুল বলেন, ‘আমি বেগম জিয়ার পক্ষে বলছি না, আমি আমার আসামির পক্ষে বলছি। বিচারক তাকে বলার অনুমতি দেন।’

এরপর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারার বিধান কারাগারে থাকা আসামির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় উল্লেখ করে পাকিস্তানের লাহোর হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরেন। এছাড়া বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে এ সংক্রান্তে কোন সিদ্ধান্ত নেই বলেও জানান।

এরপর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারায় দরখাস্ত দেওয়ার এখতিয়ার প্রসিকিউশন পক্ষের নেই। এ দরখাস্ত আসামি পক্ষকেই দিতে হবে। তাই তার আবেদন খারিজ হবে।’

উত্তরে দুদকের পিপি কাজল বলেন, ‘আমিন সাহেব যে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা একজন পলাতক আসামিকে নিয়ে। আমরা কোন পলাতক আসামিকে নিয়ে কথা বলছি না। আমাদের এখতিয়ার নেই এমন কথা এখানে নেই। তাদের কথা অনুযায়ী যদি আদালত চলে তবে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পরবে।’

এরপর বিচারক আদেশ দেওয়ার সময় বলেন, ‘আদালতের সামনে এখন ৪টি প্রশ্ন। ১। ৫৪০ (এ) ধারার দরখাস্ত পিপি সাহেব দিতে পারেন কি না? ২। আসামিপক্ষ ৫৪০ (এ) ধারায় দরখাস্ত দিতে পারেন কি না? ৩. কোন দরখাস্ত ছাড়া আদালত নিজে এই ধারার প্রয়োগ করতে পারে কি না? এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার জামিনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে কিনা এবং ৪। এ অবস্থায় যুক্তিতর্ক শুনানি করা যাবে কি না?’

এরপর বিচারক দুদকের পিপির দরখাস্ত এবং আসামি পক্ষের বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার পক্ষে ৩২ বার সময় নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তারা সময় নিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়ার ওকালতনামায় দেখা যায় ১২৬ জন আইনজীবী রয়েছেন। তার আইনজীবীরা এ মামলায় গৃহীত ৩৩ জন সাক্ষীকে জেরাও করেছেন। তাই তার আইনজীবীরা তার পক্ষে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়।’

বিচারক ভারত ও পাকিস্তান হাইকোর্টের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত তুলে ধরে আদেশে আরও বলেন, ‘আদালত কোন পক্ষের আবেদন ছাড়াই ৫৪০ (এ) ধারা প্রয়োগ করতে পারে। মামলাটি ৭ বছর ধরে চলছে। বিচার পর্যায়ে বেগম জিয়ার পক্ষে ৪০ বার সময় নেওয়া হয়েছে। আত্মপক্ষ শুনানিতে ৩২ বার সময় নেওয়া হয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি আর আদালতে আসেনি। সর্বশেষ গত ৫ সেপ্টের্ম্ব এসে বলেছেন বারবার আসতে পারবেন না। গত ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বরও তিনি আদালতে আসতে অনিচ্ছুক মর্মে জানিয়েছেন। বৃহস্পতিবারও তিনি আদালতে আসতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে অপরগতা প্রকাশ করেছেন। এতে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, খালেদা জিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে মামলার বিচারকাজকে বিলম্বিত করার জন্য আদালতে আসছেন না। অথচ মামলার অপর দুই আসামি প্রতিদিন হাজির হচ্ছেন। তাই ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪০ (এ) ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে তার হাজিরা মওকুফ করে বিচার কাজ শুরু করলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে। মামলাটিও দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। তাই ৫৪০ (এ) ধারা প্রয়োগ করে আসামি খালেদা জিয়ার উপস্থিতি মওকুফ করা হলো। আর দুদকের প্রসিকিউটরের আপত্তি না থাকায় তার জামিনের মেয়াদও আগামী ধার্য তারিখ পর্যন্ত বর্ধিত করা হোলো। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ইচ্ছা করলে তার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারবেন। আর বৃহস্পতিবার চিকিৎসা সংক্রান্তে দাখিল করা আবেদনের বিষয়ে ২টায় সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে এবং ওই সময় উপস্থিত আসামিদের পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হবে। এ আদেশ প্রদান করে বিচারক ১টা ৪৫ মিনিটে এজলাস ছেড়ে যান। এরপর বেলা সোয়া ২টার সময় বিচারক এজলাসে উঠলে উপস্থিত আসামিদের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আজ যুক্তি উপস্থাপন করতে পারব না। তবে শুরু করেছি বলে আপনি (বিচারক) ধরতে পারেন। এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া ও মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, আমরা আপনার আদেশে সংক্ষুব্ধ। তাই ওই আদেশের বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। আমাদের সময় দিন। এরপর বিচারক যুক্তি উপস্থাপন শুরু হলো মর্মে উল্লেখ করে আগামী ২৪, ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী যুক্তি উপস্থাপনের দিন ধার্য করেন।

উল্লেখ্য, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় গত ১ ফেব্রুয়ারি আসামি জিয়াউল হক মুন্নার পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি অব্যাহত রয়েছে এবং খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন বাকি আছে।

এদিকে একই বিচারক গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছর কারাদ- দেন এবং ওইদিনই তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তিনি পুরান ঢাকায় নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন।

২০১১ সালের ৮ আগস্ট খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা দায়ের করে দুদক। এ মামলায় ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।

মামলাটিতে বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী এবং তার তৎকালীন একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রাক্তন মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান আসামি।

মামলাটিতে খালেদা জিয়া ও অপর আসামিদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ তৎকালীন বিচারক বাসুদেব রায় অভিযোগ গঠন করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়