ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘একজনকে সেভ করতে আরেকজনকে বলি’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪২, ৮ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘একজনকে সেভ করতে আরেকজনকে বলি’

নিজস্ব প্রতিবেদক : নাইকো দুর্নীতি মামলার শুনানিতে আদালতে খালেদা জিয়া বলেছেন, একজনকে সেভ করার জন্য আরেকজনকে বলি দিবেন এটা ঠিক না। একই সঙ্গে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আদালতে হাজির করার দাবি জানান।

বৃহস্পতিবার পুরনো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ৯ নম্বর বিশেষ জজ মাহমুদুল কবীরের আদালতে শুনানিকালে এ কথা বলেন খালেদা জিয়া। আদালত মামলার পরর্বতী শুনানরি জন্য ১৪ নভেম্বর দিন র্ধায করেন।

এর আগে এদিন খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে গাড়ীতে করে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়। সেখান থেকে সরাসরি তাকে কারাগারের ভেতরের আদালতে একটি হুইল চেয়ারে করে হাজির করা হয়। এজলাস কক্ষেও তিনি হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন।

বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে মামলার কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমে দুদকের প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, আগে আপনি (বিচারক) বকশি বাজারস্থ আদালতে বসতেন। এখন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আপনাকে এখানে আনা হয়েছে। এ মামলায় উচ্চ আদালতের কোন স্থগিত আদেশ নেই। তাই আমরা চার্জ শুনানি শুরু করতে পারি।

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, মামলায় মওদুদ আহমদের পক্ষে চার্জ শুনানি চলমান আছে। তিনি হাইকোর্টে রিভিশন করেছেন। আমাদের চার্জ শুনানি মওদুদ আহমদের শুনানি শেষ হওয়ার পর হবে। আমরা আজ মুলতবি চেয়েছি।

এরপর মওদুদ আহমদ বলেন, আমার রিভিশন মামলা এখনো বিচারাধীন। কোন আদেশ পাইনি। তাই আমিও মুলতবি চাচ্ছি।

জবাবে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ২০০৮ সালের ৫ মে থেকে এ মামলায় চার্জ শুনানি শুরু হয়। আজও শেষ হয়নি। মওদুদ আহমদ সাহেবের জন্যই শুনানি ঝুলে আছে। এ মামলায় এ পর্যন্ত এহাজার, চার্জশিট ও প্রসিডিংসহ অনেক বিষয়ই তারা চ্যালেঞ্জ করেছেন। কিন্তু কোন আদেশ আনতে পারেননি। তাই এখন আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই।

এরপর মওদুদ আহমদ আদালতের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, এখানে তো মামলার বিচারকাজ চলার মতো পরিবেশ নেই। বসার জায়গা নেই। ওয়াশ রুম নেই। আমি যে লিগ্যাল ওপিনিয়ন দিয়েছিলাম তাও আমাকে দেওয়া হয়নি। তাই সময় চাচ্ছি।

এরপর বিচারক বলেন, যেহেতু উচ্চ আদালতের কোন স্থগিতাদেশ নেই, তাই সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করা হলো। চার্জশুনানি শুরু করুন।

এরপর মওদুদ আহমদ বলেন, বেশি সময় থাকতে পারব না। মামলা রেখে এসেছি। জবাবে বিচারক বলেন, আপনি (মওদুদ) যতো দেরি করবেন আপনার নেত্রীকেও (খালেদা জিয়া) ততসময় বসে থাকতে হবে। আপনি বিলম্ব করলে তার কষ্ট হবে। তাই আপনি যতো তাড়াতাড়ি শেষ করবেন বেগম জিয়া তত তাড়াতাড়ি যেতে পারবেন। তার তত কষ্ট কম হবে।

এরপর মওদুদ আহমেদ বলেন, জানলাম, আজই (বৃহস্পতিবার) তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে এখানে আনা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে চিকিৎসা তাকে দেওয়া হয়নি।

এরপর তিনি শুনানি শুরু করেন। যেখানে তিনি মামলার এজাহার দেখে দেখে পড়তে থাকেন। এক পর্যায়ে বলেন, মামলার ঘটনা শুরু ২০০৬ সাল থেকে। তাই আমরা শুধু বর্তমান সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। আমি যে মতামত দিয়েছি, তা আমাকে দেয়া হয়নি। সেখানে আমি ছাড়াও ৮ জন স্বাক্ষর করেছেন। অথচ আমাকে আসামি করা হয়েছে। আমাকে ডকুমেন্ট না দিলে কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করব।

এ সময় বিচারক বলেন, আপনি বোধ হয় জানেন, চার্জশুনানির সময় আসামি পক্ষের কোন ডকুমেন্ট নিয়ে মামলা থেকে কাউকে অব্যাহতি দেয়ার সুযোগ নেই।

তখন মওদুদ আহমদ বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪১ (এ) ধারাটি আসামির জন্যই করা হয়েছে। আপনি যদি সন্তুষ্ট হন, আমি নির্দোষ তবে কেন হব না? এর মধ্যে দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আদালতে উপস্থিত হন। তাকে আদালত কক্ষে একটি চেয়ারে বসতে দেয়া হয়।

মওদুদ আহমেদ পুনরায় এজাহার থেকে পড়া শুরু করেন, সেখানে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ আসলে বিচারক বলেন, আপনি (মওদুদ আহমেদ) এর আগে দুদিন চার্জ শুনানি করেছেন, সেখানে এজাহার পড়ে চার্জশিটে গিয়েছেন, আজ আবার এজাহার পড়ছেন। আর অপানার বিষয়ে যেখানে অভিযোগ সেখানে পড়লেই পারেন।

ওই সময় খালেদা জিয়া বিচারকের উদ্দেশ্যে বলেন, উনি মন্ত্রনালয়ে ছিলেন। আপনাকে (বিচারক) ওনাকে বলার সুযোগ দেয়া উচিত। ওনাকে বলতে দিন। তিনিও (শেখ হাসিনা) তো এ মামলার আসামি।

তখন বিচারক বলেন, তিনি ( শেখ হাসিনা) এ মামলার কেউ নন। তাই বলতে পারবেন  না। ওনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে সেটা বলবেন।

উত্তরে খালেদা জিয়া বলেন, উনিও (শেখ হাসিনা)  এ মামলার আসামি। ওনাকেও আদালতে আনতে হবে। আমরা তো তার করা চুক্তির শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। তাই ওনাকে আদালতে আনতে হবে। ওনাকে আদালতে এসে জবাব দিতে হবে। আপনারা একজনকে সেভ করে আরেক জনকে বলি দিবেন, তা হবে না।

এরপর মওদুদ আহমেদ বলেন, আসলে উনি (খালেদা জিয়া) বলতে চেয়েছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সরকারই এ চুক্তি অনুমোদন করে গিয়েছিলেন। আমরা শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছি। এ নিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও একটি মামলা হয়েছিল। তাই এ নিয়ে ওনার একার কেন বিচার হবে।

এরপর বিচারক খালেদা জিয়ার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনার আইনজীবী বলার সুযোগ পাবেন। প্রয়োজনে তখন আপনিও বলতে পারবেন।

এরপর মওদুদ আহমদ পুনরায় এজাহার পড়া শুরু করে ১২টা ৫৫ মিনিটে তা শেষ করে বলেন, আজ এ পর্যন্ত থাক, ম্যাডামও অসুস্থ।

তখন বিচারক বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম, আপনি যতো দেরি করবেন, আপনার ম্যাডামের তত কষ্ট হবে।

এরপর মওদুদ আহমেদ বলেন, আমার বয়স ৮১ বছর। আপনি কি আমাকে জোর করছেন, যে আজই শেষ করতে হবে।

এ সময় খালেদা জিয়া বলেন, উনিতো করেছেন, আর আমিও অসুস্থ, অনেক সময় বসে থাকতে পারব না।

তখন বিচারক বলেন, উনি (মওদুদ আহমেদ) ঘুরে ফিরে এককই স্থানে চলে আসছেন। এসময় প্রসিকিউটর কাজল বলেন, এভাবে চলতে পারে না। যদি উনি না করেন, তাহলে উনারটা শেষ করে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুরু করুন।

এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী বোরহান উদ্দিন বলেন, উনি (মওদুদ) উচ্চ আদালতে রিভিশন মামলা থাকাবস্থায়ও আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে চার্জ শুনানি করেছেন। আর সামনে আমাদের অসুস্থ নেত্রী বসে আছেন, এ অবস্থায় আমাদের কথা বলার সাহস শান্তিও হারিয়ে যায়। তাই আজকের মতো শেষ করতে পারেন। এছাড়া এ সময় আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, আমাদের সিনিয়র আইনজীবী রেজ্জাক খানও নেই। তাই আমাদের সময় দিতে হবে।

তখন বিচারক বলেন, ঠিক আছে আগামী রোববার পর্যন্ত সময় দিলাম। ওই সময় মওদুদ আহমেদ বলেন, ওইদিন আমার একটি মামলা আছে। ওই মামলায়ও আমি আসামি। তাই পিছিয়ে বৃহস্পতিবার দিন।

ওই সময় দুদকের প্রসিকিউটর কাজল আপত্তি দিলে বিচারক আগামী বুধবার ১৪ নভেম্বর চার্জ শুনানির পরবর্তী দিন ধার্য করেন এবং ওইদিন মওদুদ আহমদকে তার শুনানি শেষে করতে হবে বলেও জানান।

শুনানি কালে মামলার অপর আসামিদের মধ্যে তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী একে এম মোশাররফ হোসেন, ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া (সিলভার সেলিম), সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন উপস্থিত ছিলেন।

জামিনে থাকা অপর আসামি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম অনুপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আসামি নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ, তখনকার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক পলাতক রয়েছেন।                      

উল্লেখ্য, গত ৩ সেপ্টেম্বর মামলাটিতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করেন আদালত।

নাইকো মামলায় ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর আদালতে খালেদা জিয়া আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৮/মামুন খান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়