ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আয়কর বিভাগে ১৩ দুর্নীতি : প্রতিরোধে দুদকের ২৩ সুপারিশ

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৪, ৮ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আয়কর বিভাগে ১৩ দুর্নীতি : প্রতিরোধে দুদকের ২৩ সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক : আয়কর বিভাগে দুর্নীতির ১৩টি উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ২৩ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বৃহস্পতিবার দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সারোয়ার মাহমুদের স্বাক্ষরিত সুপারিশমালা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে অভ‌্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর সুপারিশমালা পাঠানো হয়েছে।

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রনব কুমার ভট্টাচার্য‌্য রাইজিংবিডিকে এসব তথ‌্য জানিয়েছেন।

এর আগে দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের প্রাতিষ্ঠানিক দলের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে তা অনুমোদন করে দুদক।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবরে পাঠানো সুপারিশমালায় আয়কর বিভাগের দুর্নীতির উৎস এবং তা প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক দল বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা, আয়কর বিভাগ এবং কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট সংক্রান্ত বিভিন্ন নথি/রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা, সরেজমিনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিদর্শন, গণমাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্যাদি এবং কমিশনের গোয়েন্দা উৎস থেকে পাওয়া তথ্যাদি পর্যালোচনা করে।

আয়কর বিভাগের দুর্নীতি ও অনিয়মের উৎসসমূহ:
১. ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় আয়কর নথি গ্রহণ। অর্থাৎ আয়কর বিভাগে করদাতার রিটার্নের তথ্য, কর আদায়ের তথ্য সংক্রান্ত সকল রেজিস্টার ম্যানুয়ালি সংরক্ষণ করা হয়। ফলে রেজিস্টার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকছে।

২. নথি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত নেই। যার ফলে কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় না।

৩. নতুন করদাতা চিহ্নিতকরণে সংশ্লিষ্ট কর কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত অতিরিক্ত স্বেচ্ছামাফিক ক্ষমতাকে অনেকেই দুর্নীতি/ অনিয়মের অন্যতম উৎস বলে মনে করেন। সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায় নতুন করদাতা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।

৪. কর প্রণোদনা এবং কর মওকুফের ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত স্বেচ্ছামাফিক ক্ষমতা।

৫. আয়কর বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা কর্তৃক আইন, বিধি এবং নিয়মবহির্ভূত আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অঘোষিত পরামর্শক হিসেবে কাজ করা।

৬. কর পরিদর্শক কর্তৃক প্রণীত পরিদর্শন প্রতিবেদনের সত্যতা দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাই না করা। অর্থাৎ পরিদর্শন প্রতিবেদন যথাযথভাবে যাচাই না করা।

৭. চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, আয়কর আইনজীবী প্রমুখ পেশাজীবীদের রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত না করা।

৮. নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ (সিএ ফার্ম) ও করদাতা প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে প্রণীত অডিট রিপোর্ট জালিয়াতি। সিএ ফার্মসমূহের জবাবদিহিতা না থাকায় এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

৯. বদলি, পদায়নে প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।

১০. আয়কর বিভাগের অভ্যন্তরে এবং আয়কর বিভাগের সাথে কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ এবং এনবিআরবহির্ভূত সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দপ্তর যেমন: বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি ক্রয় সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের দপ্তর, ভূমি অধিদপ্তর, বিআরটিএ, আরজেএসসি, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদির সাথে প্রাসঙ্গিক তথ্য আদান-প্রদান, যোগাযোগ, সমন্বয়, সহযোগিতার অভাব, অপ্রতুলতা আয়কর ফাঁকির সুযোগ সৃষ্টি করে।

১১. কেন্দ্রীয় জরিপ অঞ্চলে কোনো আয়কর অধিক্ষেত্র নেই। এর মূল কাজ হচ্ছে নতুন করদাতা শনাক্ত করে তা সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে আয়কর নথি খোলার জন্য প্রেরণ করা। কেন্দ্রীয় জরিপ অঞ্চলে আয়কর অধিক্ষেত্র না থাকলেও এখানে প্রায় ১০ হাজার আয়কর নথি রয়েছে, যার আইনগত অধিক্ষেত্র না থাকা সত্বেও এই অঞ্চলে এই সমস্ত আয়কর নথির কর নির্ধারণ করা হচ্ছে, যা বেআইনি। এ কারণে কেন্দ্রীয় জরিপ অঞ্চলের কোনো আয়কর নথির হিসাব না থাকায় এ কর অঞ্চলে প্রকৃত আয়কর নথির সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।

১২. বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে বর্ণিত অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ ও অর্থ ধারণকারীকে যে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে তা জনগণের মাঝে অবৈধ বা অপ্রদর্শিত অর্থ অর্জনের প্রবণতাকে উৎসাহিত করতে পারে।

১৩. আয়কর মেলার প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রয়োজন রয়েছে। তবে আয়কর মেলার নামে বিলাসবহুল প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে মনে করা হয়।

দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৩ সুপারিশ হলো-
দেশের আর্থিকভাবে সামর্থবান সব নাগরিক, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর গ্রহণপূর্বক আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা।

সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ টিমের মাধ্যমে কর বিভাগের জন্য এ যাবৎ প্রস্তুতকৃত উপরিউক্ত অটোমেশন মডিউলগুলো পর্যালোচনা করে এগুলোকে হালনাগাদ করা।

ই-ট‌্যাক্স সিস্টেম পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে তা কার্যকর করা। একই সঙ্গে এর সাথে সম্পৃক্ত কর সেন্টার ও সার্ভিস সেন্টার প্রস্তুত করা।

উৎসে কর ব্যবস্থাপনাকে জরুরি ভিত্তিতে অটোমেশনের আওতায় আনা এবং এর জন্য একটি পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো সৃজন করা।

কাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর প্রশাসন ক‌্যাপাসিটি ও ট‌্যাক্স সার্ভিস প্রকল্পের আওতায় টিআইআরএস পদ্ধতিতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, ভূমি প্রশাসন ইত্যাদি সংস্থার সাথে অনলাইনে সংযুক্তির মাধ্যমে তাদের ডাটাবেস ব্যবহার করে নতুন করদাতা শনাক্ত করার প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা হয়। অথচ এই পদ্ধতিটি প্রবর্তনের পর ব্যবহার না করার জন্য এর সুফলপ্রাপ্তি থেকে আয়কর বিভাগ বঞ্চিত হয়। কেন্দ্রীয় জরিপ অঞ্চলকে একটি কর নির্ধারণী অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার না করে এর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সুস্পষ্ট নিদের্শনা এবং পরিপালনের নীতিমালা প্রবর্তনের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে ব্যবহারযোগ্য নতুন করদাতা শনাক্তকরণের কাজে লাগানো।

আয়কর বিভাগের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলসহ প্রতিটি দপ্তরের নথি নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ।

কর্মকর্তা/কর্মচারীদের খেয়ালখুশিমতো করদাতাদের কর মামলা অডিটের জন্য নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ করা এবং প্রচলিত নিরীক্ষার পরিবর্তে কম্পিউটারের সহায়তায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় বস্তুনিষ্ঠ নিরীক্ষার প্রবর্তন।

বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে বিভিন্ন দুর্বলতা রয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে কর কর্তৃপক্ষকে প্রদত্ত অতিরিক্ত স্বেচ্ছামাফিক ক্ষমতা, ব্যাপক কর প্রণোদনা ও কর মওকুফ, দুর্বল বাস্তবায়নের কারণে দুর্বল প্রতিপালন। এক কর ব্যবস্থার সাথে অন্য কর ব্যবস্থার এবং তৃতীয় কোনো সংস্থার সাথে সীমিত তথ্য বিনিময়, করদাতার আয় নির্বিশেষে চূড়ান্ত কর হিসাবে ধারণাগত করের উপর অধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট আরো উন্নত এবং করদাতাবান্ধব করার লক্ষ্যে রাজস্ব বোর্ড ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় অ্যাকাউন্টস, কেন্দ্রীয়ভাবে রিটার্ন গ্রহণ ও প্রসেসিং, কেন্দ্রীয়ভাবে রেজিস্ট্রেশন প্রদান ইত্যাদির উন্নয়ন ও ডাটা ম্যানেজমেন্টকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে করদাতাগণকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে কর প্রদানের বিষয়ে আরো বেশি সুযোগ সৃষ্টি করাসহ মোট ২৩টি সুপারিশ করা হয়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৮/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়