ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

তিতাসের চিহ্নিত ২২ দুর্নীতি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৯, ১৭ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিতাসের চিহ্নিত ২২ দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক : তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ২২টি সম্ভাব্য দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম অনুসন্ধানকালে ওই উৎসগুলো চিহ্নিত করে।  বুধবার বাংলাদেশ সচিবালয়ে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর নিকট এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

চিহ্নিত দুর্নীতির ২২ উৎসগুলো হলো-
অবৈধ সংযোগ :
তিতাস গ্যাস কোম্পানিতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি সংঘটিত হয় গ্যাসের অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে।  এক গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন বলছে, তিতাসে ৬ শতাংশ সিস্টেম লস হয় অবৈধ সংযোগের কারণে।  ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে বিশেষ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল সংখ্যক অবৈধ গ্যাসলাইন সংযোগের তথ্য পাওয়া যায়।  গৃহস্থালির চেয়ে শিল্পেই বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে।  তিতাসে কর্মরত নয় এ রকম কিছু টেকনিক্যাল ব্যক্তির সাথে যোগসাজশে চোরাই লাইনে সংযোগ দেওয়া হয়।

অবৈধ সংযোগকে বৈধ করা : বৈধ সংযোগের নামে একটি সিন্ডিকেট বড় আকারের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।  ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, অবৈধ সংযোগ নিতে তিতাসের কর্মচারীকে ৪৫ হাজার টাকা ঘুষ হিসেবে দিতে হয়, বর্তমানে যা আরো বেশি।

অবৈধ লাইন পুনঃসংযোগ : অনেক সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলেও রাতের আঁধারে সেটি অর্থের বিনিময়ে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয় বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

অবৈধ সংযোগ বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়া : অবৈধ সংযোগ চিহ্নের পরও গ্রাহকের মামলার প্রেক্ষিতে আদালতের আদেশে তা বন্ধে সহজে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

অবৈধ সংযোগে অদৃশ্য হস্তক্ষেপ : অদৃশ্য হস্তক্ষেপে অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা যায় না।  জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কমিটি থাকলেও অদৃশ্য প্রভাবে তা কাজ করে না।

নীতিমালা অনুসরণ না করা : শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ প্রদানে জ্বালানি উপদেষ্টাকে সভাপতি ও পেট্রো বাংলার চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি রয়েছে।  কমিটির সিদ্ধান্তেই গ্যাস সংযোগ প্রদান করা হয়।  তবে অধিক স্বচ্ছতার জন্য নীতিমালা প্রয়োজন।

এক কর্মকর্তার একাধিক দায়িত্ব পালন : একই কর্মকর্তা একাধিক দায়িত্ব পালন করায় কোনো দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন না করে দুর্নীতির আশ্রয় নেন।

বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহককে শিল্প শ্রেণিতে সংযোগ প্রদান : শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের কম মূল্যে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার নিয়মকে অপব্যবহার করে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বেকারি ও সুপারশপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া হয়।

মিটার টেম্পারিং : মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমেও দুর্নীতি হয়ে থাকে।  কিছু অসাধু কর্মকর্তা ঘুষের বিনিময়ে মিটার টেম্পারিং করে গ্রাহকের প্রকৃত বিল গোপন করে অবৈধ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

অতিরিক্ত বয়লার ও জেনারেটরে গ্যাস সংযোগ : ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুমোদনের অতিরিক্ত বয়লার ও জেনারেটর সংযোগ দেওয়া হয়।

বৈধ সংযোগ দিতে হয়রানি : বৈধভাবে সংযোগ নিতে গ্রাহকদের অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।  অন্যথায় বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।

মিটার বাইপাস করে সংযোগ প্রদান : ঢাকা ও এর আশপাশের অনেক কোম্পানির মিটার বাইপাস করে অবৈধ সংযোগ আছে, যার সাথে জড়িত তিতাসের কর্মীরা ঘুষ গ্রহণ করে থাকে।

ইচ্ছাকৃতভাবে গৃহস্থালিতে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেওয়া : ইচ্ছাকৃতভাবে তিতাসের কর্মচারীরা গৃহস্থালিতে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দিয়ে ওই সময়ে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে বাইপাস করে।

ইলেকট্রনিক ভলিউম কারেক্টর (ইভিসি) না বসানো : তিতাসসহ অন্যান্য কোম্পানি অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রাহক পর্যায়ে অনুমোদনের কম/বেশি গ্যাস সাপ্লাই দেয়।  কিন্তু সাপ্লাই ভেরিয়েশন পরিমাপ করার জন্য মিটার আছে, যাকে ইভিসি বলে।  জড়িত কর্মীরা ইচ্ছাকৃতভাবে ইভিসি না বসিয়ে হিসাব গড়মিল করে।

দীর্ঘদিন শিল্প এলাকায় পোস্টিং : কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে অর্থের বিনিময়ে শিল্প এলাকায় পোস্টিং নিয়ে আছেন, যার কারণে এরা খুব সহজেই সিন্ডিকেট গড়ে দুর্নীতি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বানানো সিস্টেম লস দেখানো : ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনা অনুযায়ী, আবাসিক খাতে এস্টিমেটেড প্রবাহ ছিল ১০ হাজার ৩১৭ কোটি ৬৯ লাখ ৩৫ হাজার ৫৬৮ সিএফটি। কিন্তু ব্যবহার হয় ৮ হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৪ লাখ ৯৬ হাজার ৮৯৯ সিএফটি।  যেখানে ব্যবহার কম দেখানো হয় ১ হাজার ৪৭৭ কোটি ৯৪ লাখ ৩৮ হাজার ৬৬৯ সিএফটি।  তারপরও ওই বছর সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে।  অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধ সংযোগ বা বাইপাসকে বৈধ করতেই সিস্টেম লস হিসেবে দেখানো হয়।

দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া বিল আদায় না করা : ২০১০-২০১১ অর্থবছর থেকে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের সরকারি অডিট পর্যালোচনা অনুসারে বিভিন্ন শিল্প কারখানা যেমন-এশিয়ান টেক্সটাইল মিলস, পিংক ফুড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ, লিথুন ফেব্রিক্স, কুশিয়ারা কম্পোজিট, বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের গ্রাহক, আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের কাছে তিতাসের শত কোটি টাকার বেশি বকেয়া পাওনা আছে।  কারখানার মালিক কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করে অথবা অদৃশ্য প্রভাব খাটিয়ে গ্যাস সংযোগ অব্যাহত রেখেছে।  অথচ গ্যাস নীতিমালা অনুযায়ী কোম্পানি যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে তারা মামলা করার সুযোগ পেত না।

এ ছাড়া, চিহ্নিত অবৈধ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে অর্থ আত্মসাৎ, গ্যাস বিক্রি বেশি দেখিয়ে আত্মসাৎ, ভুয়া সংকেত দিয়ে অবৈধ গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায়, আঞ্চলিক ব্যাংক হিসাব থেকে তিতাসের মাদার একাউন্টে যথাসময়ে টাকা স্থানান্তর না করা, মালামাল ক্রয় ও দরপত্রে অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং  জরিমানা, সংশোধিত বিল ও জামানত আদায়ে গ্যাস বিপণন নীতিমালা অনুসরণ না করা ইত্যাদি অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে তার সত্যতা পেয়েছে দুদক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৯/এম এ রহমান/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়