ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বাড়ছে ডাবের কদর

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৬, ৬ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাড়ছে ডাবের কদর

আরিফ সাওন : দিন দিন রাজধানীতে বাড়ছে ডাবের পানির কদর। পথেঘাটে পিপাসা নিবারণের জন্য সচেতন মানুষ বেছে নিচ্ছেন ডাবের পানি।

গ্রাহকদের মতে, রাজধানীতে যত পানীয় পাওয়া যায় তার মধ্যে ডাবের পানিই সবচেয়ে নিরাপদ। তাই অনেক ক্ষেত্রে কোমল পানীয়র বদলেও তারা বেছে নেন ডাবের পানি।

গ্রামে ঘুরে ঘুরে ডাব কেনা, গাছ থেকে পাড়ানো, ট্রাকে ওঠানো, রাজধানীতে পাঠানো, আড়তে নামানো, পাইকারি বিক্রি ও খুচরা বিক্রি পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার সাথে বহু মানুষ জড়িত। রাজধানীতে অনেকেই এখন বেছে নিচ্ছেন ডাব বিক্রির পেশা। ডাবের উপর নির্ভর করে সংসার চলছে অনেকেরই। রাজধানীতে কিছু দূর পরপরই চোখে পড়ে ভ্যানে করে ডাব বিক্রির দৃশ্য।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান ডাবের দোকানে ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতার ডাব পছন্দ এবং দরদাম ঠিক হলে বিক্রেতা দা দিয়ে একপাশে কেটে ফুটো করে দেন। এরপর ছোট পাইপ দিয়ে ক্রেতা পানি পান করেন। কারো পছন্দ কচি ডাব, কেউ চান ভেতরে হালকা একটু শাঁস, আবার কেউ চান শক্ত শাঁস।

কিছু ক্রেতা ডাবের পানি পান করা হলে ভেতরের শাঁস খাওয়ার আগ্রহ দেখান। তার কাছ থেকে ডাবের খোল হাতে নিয়ে তা দা দিয়ে কেটে দুই ভাগ করে দেন বিক্রেতা। আর খোলের কোনা থেকে একটু খোসা উঠিয়ে দেন তা দিয়ে শাঁস তুলে খাওয়ার জন্য। গ্রাহক ওই এক টুকরো সবুজ খোসা দিয়েই ডাবের শাঁস চেঁছে তুলে খেয়ে নেন।

অনেকে শুধু ডাবের পানিই পান করেন। ভেতরের শাঁস বা নারকেল খান না। আকার ভেদে একেকটি ডাবের দাম ৪০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়। 

রাজধানীতে শুধু রাস্তার পাশে নয়, ফলের দোকানে ও অভিজাত সুপার চেইন শপগুলোতেও ডাব পাওয়া যায়। তবে রাস্তার পাশে ডাবের ভ্যানের থেকে ফলের দোকানে দাম একুট বেশি। তার চেয়ে আরো বেশি দাম চেইন শপগুলোতে।

বারডেম হাসপাতালের চিফ নিউট্রিশন অফিসার আক্তারুন্নাহার বলেন, ‘ডাবের পানি প্রাকৃতিক পানীয়। এতে প্রচুর পটাশিয়াম আছে। ১০০ গ্রাম  ডাবের পানিতে প্রায় ১৮০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম থাকে। ডাবের পানি খাওয়ার পর পটাশিয়ামের কারণে শরীরে একটা শীতল অনুভুতি আসে। ডাবে ক্যালরি কম থাকে। তাই ডাব খেলে অনেক মোটা মানুষেরও কোন সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। কার্বোহাইড্রেডও তুলনায় কম থাকে। ক্যালসিয়াম ভালই থাকে। তা প্রায় ১৫ মিলিগ্রামের মত। ডাবে সোডিয়াম থাকে খুব কম।’

তিনি বলেন, ‘অনেকের ধারণা, ডাব খেলে সর্দি হয়। কিন্তু এ ধারণা একেবারেই ভুল। কারণ, ডাবের সাথে সর্দি বা ভাইরাসের কোন সম্পর্ক নেই। গরমে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা যায়। ডায়রিয়া রোগে ডাবের পানি খুবই উপকারী। এটি শরীরের পানি শূন্যতা দূর করে। আমাদের ঘামের সঙ্গে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফ্লোরাইড-অনেক কিছুই শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এগুলো পুরণ করার জন্য আমরা প্রতিদিন যদি একটা বা দুটো ডাব খেতে পারি তাহলে আমাদের শরীর বেশ ভাল থাকবে। সুতরাং ডাব শরীরের জন্য সব দিক থেকে ভাল।’

অন্য সফট ড্রিঙ্কের তুলনায় ডাবের দাম বেশি অভিযোগ করে এই পুষ্টিবিদ বলেন, ‘একটু ভালো ডাব ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকার কমে পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে বলব ডাব খুব ব্যয়বহুল পানীয়। দাম বেশি হওয়ায় অনেক মানুষ ডাব না খেয়ে অন্য পানীয় পান করেন। তারা মনে করেন, সফট ড্রিঙ্ক ১৫ টাকা করে হলে, একটা ডাবের টাকায় তিনটা সফট ড্রিঙ্ক খেতে পারবেন। তাই টাকা বাঁচাতে ডাব না খেয়ে তারা সফট ড্রিঙ্ক খেয়ে থাকেন। আর টাকা বেশি খরচ হলেও একটু সচেতন যারা তারা ডাব খান। সকলে যাতে ডাব কিনে খেতে পারেন সেজন্য দাম সাধ্যের মধ্যে রাখা যায় কিনা সে ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি ভাবে ভেবে দেখে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।’

উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, এক কাপ ডাবের পানিতে যা খনিজ পদার্থ আছে, তা অনেক স্পোর্টস ড্রিংকের চাইতেও বেশি। ডাবের পানি কিডনির পাথর সৃষ্টি রোধ করে এবং ডায়রিয়া, আলসার, গ্যাসটাটাইটিস বা অ্যাসিডিটি, মূত্রনালীর সংক্রমণ ও ইউরোলিথিয়েসিস প্রতিরোধ করে। ডাবের পানিতে এন্টিসেপটিক গুণ থাকাতে কাটা-ছেড়া জায়গায় ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। মুখের ক্ষত যেমন ব্রণ, মেছতা ও বসন্তের ক্ষত ডাবের পানি দিয়ে ধুয়ে নিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এতে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন সি, রিবোফ্লোভিন ও কার্বোহাইড্রেট আছে। ডাবের পানি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।

গনমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন বলেন, ‘আমি মনে করি সবচেয়ে হালাল, নিরাপদ, স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ পানীয় হচ্ছে ডাবের পানি। তাই আমি চেষ্টা করি প্রতিদিন একটি ডাব কিনে খেতে।


                                                                                                                ছবি : শাহীন ভূঁইয়া

৬ জুন রাজধানী ঢাকায় তোপখানা রোডে জাতীয় প্রেসক্লাবের কোনায় ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করছিলেন মো. শহিদুল্লাহ। তিনি ৪০ বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করে আসছেন। দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে তিনি ডাব হাতে নিয়েই বুঝতে পারেন কোনটায় কতটুকু পানি আছে, কোনটায় সর বা শাঁস হয়েছে, কোনটার শাঁস শক্ত হয়েছে, কোটায় পানি কম।

শহিদুল্লাহ জানান, ৪০ বছর আগে একশ ডাব কিনতেন ৭০ টাকায় আর এখন একটু বড় সাইজের একশ ডাব কিনতে অন্তত সাড়ে চার হাজার টাকা লাগে। ডাব বিক্রিতে তার খুব সুনাম রয়েছে। অনেকেই তার কাছ থেকে ডাব কিনে খান। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও তার কাছ থেকে ডাব কিনে খেয়েছেন।

শহিদুল্লাহ জানান, তার বাড়ি লক্ষিপুরের রামগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাও ইউনিয়নের সাউদিরখিল গ্রামে। রাজধানীর ইসলামপুরে কয়েকজন মিলে মেস করে থাকেন। তার পরিবার থাকে গ্রামে। তিনি চার মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা। বড় মেয়েকে এসএসসি পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। মেজো মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সেজো মেয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ও ছোট মেয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলে একজন নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে আর পড়ে নি। ছোট জন মাদ্রাসায় পড়ে।

শহিদুল্লাহ জানান, ডাবের ব্যবসা করেই সংসারের খরচ এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চলছে। যা আয় করেন খরচ হয়ে যায়। অতিরিক্ত কিছু জমাতে পারেন নি। এখন রমজান মাস থাকায় ডাব বিক্রি কম হচ্ছে। দিনে ৫০টির মত বিক্রি হয়। রমজান মাস ছাড়া অন্য সময় দিনে অন্তত দেড়শ’ ডাব বিক্রি করতে পারেন। তার কাছে সবচেয়ে বড় একটি ডাবের দাম ৭০ টাকা। তাতে সাড়ে তিন থেকে চার গ্লাস পানি হয়। তবে গুলশান এলাকায় বড় সাইজের প্রতিটি ডাব ৯০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়।

তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন আবুল কালাম নামের একজন ডাব কিনছিলেন। তিনি জানান, তিনি প্রায়ই তার কাছ থেকে ডাব কিনে খান। কারণ, তিনি মনে করেন ডাবের পানি সবচেয়ে নিরাপদ। এখন রমজান মাস হওয়ায় ডাব কিনে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। ইফতার করে খাবেন।

উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের মত ভারত ও মধ্য আমেরিকার অনেক দেশে (যেমন কোস্টারিকা ও পানামা) রাস্তার পাশে বিক্রেতারা আস্ত ডাব বিক্রি করেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে টাটকা ডাবের পানির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। এছাড়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহে ক্যানে ভরে অথবা বোতলে ভরে ডাবের পানি বিক্রি করা হয়। মাটির গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে ডাবের পানির স্বাদ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন, ভারতের ডাব মিষ্টি হয়, কিন্তু ব্রাজিলের ডাব হয় একটু পানসে। আবার বাংলাদেশের ডাবের পানি বেশ মিষ্টি হয় আর একটু হালকা নোনতা স্বাদ থাকে।

বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার মসনি গ্রামের মোঃ রাহাতুল ইসলাম তিন বছর ধরে ডাবের ব্যবসা করছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডাব কেনেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ডাব কেনা হয় গড়ে ১৫ টাকা করে। এরপর পরিবহন খরচ রয়েছে। একদিন পর পর তিনশ থেকে চারশ ডাব গাড়িতে করে রাজধানীর পোস্তগোলা পাঠাই। কখনো কখনো যাত্রাবাড়িতে পাঠাই। আড়তে যাওয়ার পর ডাব তিন সাইজে বিক্রি হয়। একেক সময় একেক দামে বিক্রি হয়। ছোট সাইজ ডাব গড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা, মাঝারি সাইজের ২২ থেকে ২৮ এবং বড় সাইজের ২৮ থেকে ৪০ টাকা করে বিক্রি হয়। বাগেরহাট থেকে শুধু ঢাকায় নয়, কোন কোন ব্যবসায়ী মাগুরা ও বগুড়া পাঠান।

যাত্রাবাড়ি, পোস্তগোলা ও কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ডাবের আড়ৎ রয়েছে। একেক আড়তে একেক রকম দাম। কারওয়ান বাজারে মেসার্স মাহফুজ ট্রেডিং-এর মালিকের পক্ষে মো. মিসকাত জানান, কারওয়ান বাজারে ডাবের অন্তত ১৫ টি আড়ৎ রয়েছে। সেখানে সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি হয়। বরিশালের বিভিন্ন জেলা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর অঞ্চল, নড়াইল, নোয়াখালি থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডাব ঢাকা মহানগরীতে আসে। বেশি আসে বরিশাল ও নোয়াখালি থেকে।

তিনি বলেন, ‘আড়তে ডাব বিক্রি হয়  শ’ হিসেবে। সময় ও চাহিদার উপর দাম ওঠানামা করে। ছোট একশ ডাব গড়ে ১৫শ থেকে দুই হাজার টাকা, মাঝারি ২২শ থেকে  ২৮শ টাকা এবং বড় ডাব তিন হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।

দিন দিন ডাবের চাহিদা বাড়ছে জানিয়ে  তিনি বলেন, ‘শতভাগ নিশ্চিত যে ডাবে কোন ভেজাল নেই। তাই ডাবের চাহিদা বাড়ছে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলে নারকেল তেল মিলগুলোয় গত কয়েকবছর ধরে মন্দা যাচ্ছে। কোন কোন নারকেল তেল ব্যবসায়ী এই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। নারকেল তেল ব্যবসার মন্দার পেছনে যতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে ডাব বিক্রি হয়ে যাওয়ায় মিল গুলোয় নারকেলের সংকট।

চাহিদা মেটাতে ডাবের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং এর অতিরিক্ত উপপরচিালক (ফল ও ফুল) মাহবুবা মুনমুন বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকায় অর্থাৎ উপকূলীয় ১৭ জেলায় নারকেল চাষ বেশি হয়। এখন নতুন যে খাটো জাতের (বামন জাতের গাছ) নারকেল এসেছে, তা উপকূলীয় জেলাসহ সারা দেশে চাষের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত সারা দেশে ২ লাখ ১০ হাজার খাটো জাতের নারকেল গাছ লাগানো হয়েছে।’



রাইজিংবিডি/ ঢাকা/৬ জুন ২০১৭/সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়