ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অর্থপাচার তদন্তে গতি ফেরাতে এনবিআর-বিএফআইইউর সমঝোতা

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩২, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অর্থপাচার তদন্তে গতি ফেরাতে এনবিআর-বিএফআইইউর সমঝোতা

এম এ রহমান মাসুম : গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকা৷ যা বাংলাদেশের দুটি বাজেটের সমান। ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ অর্থই পাচার হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে৷

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটিসহ (জিএফআই) বেশকিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এমন তথ্যে উদ্বিগ্ন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

অর্থপাচার প্রতিরোধ এবং এ সংক্রান্ত অপরাধের তদন্ত গতিশীল করতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

মূলত বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার এবং অবৈধ তহবিল স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণে এনবিআর বিএফআইইউর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করবে। আগামীকাল (রোববার) ওই দুই সংস্থার মধ্যে এ সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে।

বিএফআইইউ হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সংস্থা, যা সন্দেহজনক লেনদেন এবং মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসীদের অর্থায়ন সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণের কাজ করে থাকে।

এ বিষয়ে এনবিআর সূত্রে জানা যায়, আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও শুল্ক সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধ তদন্তে এনবিআরকে প্রায়ই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য চাইতে হয়। বিশেষ করে বিএফআইইউর কাছে। তবে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেক সময় তথ্য পেতে দেরি হয় কিংবা তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের জাটিলতার মুখোমুখি হতে হয় প্রতিষ্ঠানটিকে। বিশেষ করে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এজন্য এনবিআর থেকে বিএফআইইউর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এনবিআর জানায়, বিএফআইইউর সঙ্গে সমঝোতা সই হলে তথ্য আদান-প্রদানে অবাধ প্রবাহ সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে কাঠামোগত বাধ্যবাধকতা দাঁড়াবে। এর ফলে অর্থপাচার বা রাজস্ব সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রদানের ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে। আগে তথ্য চাইলে না দেওয়ার প্রবণতা ছিল। এতে এনবিআরের অনেক তদন্ত কাজে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হতো না। এনবিআরের তদন্ত কর্মকর্তাদের তথ্য পেতে অনেক বেগ পেতে হতো।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসোন ভূঁইয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সঙ্গে কাজ করলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান আগের চেয়ে সহজ হবে। এই চুক্তিটি মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত তথ্য বিনিময় করতে সহায়তা করবে। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে আমরা অর্থ ফেরতের উপায় খুঁজতে বিএফআইইউর মাধ্যমে পরামর্শদাতা বা অন্যান্য সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে পারব।

অন্যদিকে এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান রাইজিংবিডিকে এ বিষয়ে বলেন, তথ্য বিনিময়ের জন্য একটি প্রোটোকল স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এতে আমাদের তদন্ত আরো প্রমাণভিত্তিক হবে।

তিনি আরো বলেন, এ সমঝোতা স্মারক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধের জন্য যেসব তথ্য প্রয়োজন তা দ্রুত পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। ভবিষ্যতে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলা ও চার্জশিট দায়ের এবং সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে অধিক কাজ করবে। প্রকৃত অপরাধীকে যদি চিহ্নিত করে সাজা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। মানুষ এ সংক্রান্ত কাজ করতে নিরুৎসাহিত হবে।

মইনুল খান বলেন, আমরা চাই বড় বড় মানিলন্ডারিং অপরাধ নিয়ে কাজ করতে। যাতে মানুষ একটা বড় দৃষ্টান্ত দেখতে পায়। মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করলে সাজা পেতে হয় ও সমাজিক মর্যাদার হানি হয়, এ ধরনের বার্তা দিতে পারলে মানুষ এই অপরাধ থেকে সরে আসবে।

২০১৫ সালে মানিলন্ডারিং আইন সংশোধনের পর এনবিআর ও পুলিশের সিআইডিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অর্থপাচার সংক্রান্ত অপরাধ অনুসন্ধান ও তদন্ত করার ক্ষমতা পায়। আইনি ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে শুল্ক গোয়েন্দা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত ২৭টি অপরাধের বিষয়ে তদন্ত করার এখতিয়ার পায়। এরপর শুল্ক সংক্রান্ত যতগুলো আটক বা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে, সবগুলোতেই মানিলন্ডারিং উপাদান আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে। ইতিমধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা মানিলন্ডারিং আইনের ১২টি মামলা করে, যা এখন তদন্তাধীন। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে ১২ কন্টেইনার মদ, সিগারেট ও টিভি আটকের চাঞ্চল্যকর ঘটনায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। এছাড়া আরো ২০টির মতো অর্থপাচার সংক্রান্ত অনিয়মের ঘটনা অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে বলে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।

২০১৭ সালের ২ মে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) অর্থপাচারের যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা৷

জিএফআইর প্রতিবেদন মতে, ২০০৪ সালে পাচার হয় ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার৷ ২০১২ সালে পাচার হয়েছে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার৷ ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে৷




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়