ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ঈদে মতিরহাটে পর্যটকের ঢল!

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৮ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদে মতিরহাটে পর্যটকের ঢল!

জুনাইদ আল হাবিব : ‘এখানে দৃশ্যটা খুবই চমৎকার লাগছে আমার কাছে। এমন মনোমুগ্ধকর জগতে এসে মনে যেন প্রশান্তির ঢেউ এসেছে। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ মিলেছে। ছয়-সাতজন বন্ধু মিলে ঘুরতে এসেছি। খুব মজা করলাম। অন্য যে বন্ধুরা আসতে পারলো না, তারা খুব মিস করবে। নদীর প্রায় সমান কূল আছে, চিকচিকে বালুতে হাঁটা যায়, একদম কাছে মেঘনার বুকে দ্বীপ আছে, নদীর তীরেই নারকেল-সুপারির বিশাল বাগান- মোটকথা এগুলো দেখে অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত উপভোগ করেছি। আর অনেক বড় ইলিশ ঘাট তো আছেই।’

উপকূলের অন্যতম দর্শনীয় পর্যটন কেন্দ্র লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের মতিরহাট মেঘনাতীরে ঈদুল ফিতরে ভ্রমণকালে পর্যটক হিসেবে নিজ অনুভূতি প্রকাশ করছিলেন সিলেটের জিন্দাবাজারের কলেজ পড়ুয়া আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু।

শুধু মঞ্জু নয়। ঈদে শহর থেকে গ্রামে ফিরেছেন মো. রাব্বি আলম, নেছার আহেমদ, মো. রাজুসহ অনেকেই। এদের বেশির ভাগই এ প্রাণ জাগানো দৃশ্য সম্পর্কে নিজেদের অনুভূতি জানালেন। মতিরহাট মেঘনাতীর পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় নাম। সবুজ ঘাসে মোড়ানো তেপান্তরে মেঘনার বুক বয়ে আছড়ে পড়া ঢেউ কূলের সৌন্দর্য্য আরো অপরূপ করেছে। সুপ্রশস্ত এ বালুময় তীরে দলবেঁধে ঘুরতে পারেন পর্যটকরা। বিশেষ সময়ে এখানে ভিড় করেন দেশি-বিদেশি রেকর্ড সংখ্যক ভ্রমণপিপাসু।

 



পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণ মতিরহাট নিকটবর্তী দ্বীপ। মূল ভূখণ্ড থেকে ট্রলারে চেপে গেলে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। খরচও মোটামুটি সবার সাধ্যের মধ্যে। যার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলছে। দ্বীপে বাস করেন ২৫টি পরিবার। এসব মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইও দেখা যায় খুব কাছ থেকে। গত কয়েক বছরের চেয়ে এবারের রোজার ঈদে মতিরহাটের মেঘনাতীর দেখতে আসা পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে তিনগুণ! পর্যটকদের এ বিস্ফোরণের কারণ কী? জানতে চেয়েছি, স্থানীয় কয়েকজন তরুণের কাছে। ওমর ফারুক (২৬) বলছিলেন, ‘বেশ কয়েকবার কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার আছে। মতিরহাটের উত্তর পাশে নদীর কূলেই নারিকেল গাছের দৃশ্য আর দক্ষিণ পাশে যে সমান্তরাল তীর আছে এর সঙ্গে কক্সবাজার ও কুয়াকাটার তেমন কোনো পাথর্ক্য দেখছি না। হ্যাঁ, তবে এটাকে মিনি পর্যটন কেন্দ্র বলতে পারি। গত কয়েক বছর যোগাযোগ ব্যবস্থার তেমন কোনো অগ্রগতি ছিল না। এখন সে সমস্যা নেই। রাস্তা ভালো হয়েছে। মতিরহাট মেঘনাতীরে ব্লক দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয়েছে। এজন্য পর্যটকদেরও উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। আশা রাখি, এ সংখ্যা দিন দিন আরো  বাড়বে।’

২৬ বছর বয়সি তরুণ মো. খোকন। মতিরহাটের পর্যটকদের নিরাপত্তা কেমন? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মতিরহাটগামী পর্যটকদের নিরাপত্তার প্রতি আমরা সবাই সজাগ রয়েছি। সকল পর্যটক এখানে নিরাপদ। নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার তারা রাখে। এখানের পর্যটন বিকাশে আমরা তরুণরা সব সময় খেয়াল রাখছি। এ পর্যটন স্পট আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়।’

পর্যটকদের আগমনে সম্ভাবনার বার্তা পাচ্ছেন অনেকেই। স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ী হুমায়ুন মোল্লা (২৯) বলছিলেন, ‘আমাদের এ পর্যটন স্পটটি কোনো সরকারি তালিকাভুক্ত নয়। অন্যান্য পর্যটন স্পটে যেভাবে বসার সুযোগ আছে বা ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছে, এখানে কিন্তু তেমনটা নেই। তবুও পর্যটকদের ঢল আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিরাট ভূমিকা রাখছে। নতুন পর্যটকরা একদিকে যেমন মতিরহাটের মনোরম প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলছেন, অন্যদিকে মতিরহাটের ইলিশ ঘাটের সঙ্গে তারা পরিচিত হচ্ছেন। ফলে মতিরহাটকেন্দ্রিক ইলিশের ব্যবসা জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিরাট ভূমিকা রাখছে।’

 



ঘাট থেকেই জেলেরা ছুটে যায় উত্তাল মেঘনার মোহনায় ইলিশের খোঁজে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে রোদে জ্বলে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঘূর্ণিঝড়সহ অন্যান্য দুর্যোগের ভয়কে জয় করে শিকার করে আনে রুপালি ঝিলিক দেয়া টাটকা ইলিশ। মহাজনের হাত ঘুরে সেই ইলিশের একটা বিরাট অংশ চলে যায় ঢাকার বড় বড় বাজারে, অভিজাত সুপার মার্কেটে আর বাকিটা বিমানে করে বিদেশে। ইলিশ ঘাট হতে শুরু করে নদীর গা ঘেঁষে আদুরে ভঙ্গিতে হেলেদুলে এঁকেবেঁকে দু’দিকের দিগন্তে মিলিয়ে গেছে সবুজ ঘাসের কার্পেটে আচ্ছাদিত মেঘনাতীর। মেঘনার ইতঃস্তত মৃদু ঢেউ আনমনে আলতো করে ভিজিয়ে দিচ্ছে সবুজ কার্পেট। নদীতীরে নীরবতা। এই অখণ্ড নীরবতায় ছোট ছোট ঢেউ ভাঙার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, দিগন্ত ছোঁয়া মুক্ত আকাশ আর বিশাল মেঘনার বুকে ডিঙি নৌকার নাচন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

নদীতীরের নারকেল-সুপারি বাগান, বিশাল ছাতার মতো ছড়ানো রেইন ট্রি আর অসংখ্য গাছগাছালিতে ভরা গ্রামগুলোতে চোখজুড়ানো সবুজে সেজেছে প্রকৃতি। শেষ বিকেলে নিঃসঙ্গ ঘুঘুর ডাক শেষে সূর্য যখন বিদায় নিতে ব্যস্ত, তখন অধিক ব্যস্ততায় বাড়ির পথ ধরে রাখাল বালক তার গরুর পাল, দুরন্ত শালিকের ঝাঁক আর শ্বেতশুভ্র বলাকার দল। ইট-পাথরে আচ্ছাদিত শহরের যান্ত্রিকতা আর জীবনের জটিল সমীকরণে মন যখন হাঁপিয়ে উঠবে তখনই প্রকৃতির এই অপরূপ স্বর্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ছুটে আসতে পারেন আপনিও। বিশাল নদী, খোলা আকাশ আর সবুজ প্রকৃতির সান্নিধ্যে বিষণ্নতা আর একঘেয়েমি মনোভাব কাটিয়ে মনকে ভরিয়ে তুলুন প্রাণপ্রাচুর্য আর উচ্ছ্বলতায়। ফেরার সময় বোনাস হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাবেন রুপালি ঝিলিক দেয়া তাজা ইলিশ।

কীভাবে যেতে হবে: সড়কপথে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে রামগতির বাসে প্রথমে তোরাবগঞ্জ নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি, রিকশা, মটরসাইকেলে মতিরহাট পৌঁছানো যাবে। নৌপথে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ যোগে চাঁদপুর লঞ্চ ঘাট অথবা চাঁদপুরের ভৈরবী লঞ্চ ঘাট। সেখান থেকে সিএনজিতে লক্ষ্মীপুর ঝুমুর স্টেশন, এরপর সেখান থেকে সিএনজি বা বাসে তোরাবগঞ্জ যেতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি, রিকশা বা মটরসাইকেলে মতিরহাট পৌঁছানো যাবে।

 



চট্টগ্রাম থেকে সড়কপথে চট্টগ্রামের অলঙ্কার থেকে লক্ষ্মীপুরের বাসে প্রথমে তোরাবগঞ্জ যেতে হবে। তারপর তোরাবগঞ্জ থেকে সিএনজি, রিকশা বা মটরসাইকেলে মতিরহাট পৌঁছানো যাবে। নৌপথে লঞ্চ রিজার্ভ করে সরাসরি আসা যাবে।

বরিশাল থেকে সড়কপথে বরিশালের ছোট লঞ্চঘাট থেকে লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট যেতে হবে। সেখান থেকে সিএনজিতে লক্ষ্মীপুর ঝুমুর স্টেশন, এরপর সেখান থেকে সিএনজি বা বাসে তোরাবগঞ্জ যেতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি, রিকশা বা মটরসাইকেলে মতিরহাট পৌঁছানো যাবে।

নৌপথে লঞ্চ রির্জাভ করে সরাসরি মেঘনা পাড়ি দিয়ে মতিরহাটে আসা যাবে।

 



ভোলা থেকে সড়কপথে ভোলার ইলিশা ঘাট থেকে লঞ্চ যোগে মজুচৌধুরীর হাট ঘাট, সেখান থেকে সিএনজি যোগে জেলা সদরের ঝুমুর স্টেশন। এরপর বাস বা সিএনজিতে তোরাবগঞ্জ নেমে তোরাবগঞ্জ থেকে পশ্চিম দিকে সিএনজি, রিকশা বা মটরসাইকেলে মতিরহাটে পৌঁছানো যাবে।

নৌপথে ইলিশা ঘাট থেকে ট্রলারে করে অথবা লঞ্চ রির্জাভ করে সরাসরি মতিরহাটে আসা যাবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়